শিরোনাম
হঠাৎ খলিল (পর্ব- ১৫)
প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৭:০৪
হঠাৎ খলিল (পর্ব- ১৫)
পলাশ মাহবুব
প্রিন্ট অ-অ+

মেয়েটির চিৎকার সব এলোমেলো করে দিল।

 

সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে বেশ খানিক সময় আগে। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এলোমেলো হাঁটছিল খলিল। তার হাতে টেস্টের রিপোর্ট। কিছুদূর এগিয়ে একটা জায়গায় এসে দাঁড়ায় সে।

 

জায়গাটা নিরিবিলি। পরপর তিনটি লাইটপোস্টের দুটি বাতিই নষ্ট। কিছুটা আলো-আঁধারি। লোকজন আছে, তবে দূরে; ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।

 

খলিল যেখানটায় দাঁড়িয়েছে তার পাশেই একটা ডাস্টবিন। ডাস্টবিনের মূল জায়গাটা খালি। তবে আশপাশের অনেকখানি জায়গাজুড়ে ময়লা ছড়ানো।

 

ফাইল থেকে টেস্টের রিপোর্টগুলো বের করে খলিল। একটা একটা করে রিপোর্ট ছেঁড়ে।। তারপর সবগুলো একটা দলার মতো পাকিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়।

 

হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে আবার হাঁটা শুরু করে। নিজের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ নেই। হাঁটার ভঙ্গিতে তা স্পষ্ট। মাথায় হাজারো চিন্তার ভিড়।কি ভেবেছিল সে, আর কি হয়ে গেল?

 

হঠাৎ এক নারীকণ্ঠের চিৎকার, বাঁচান . . . কে কোথায় আছেন . . .ছিনতাইকারী . . .

 

খলিলের চিন্তায় ছেদ পড়ে। সে ঘুরে তাকায়। চিৎকারের উৎস্থল খুঁজে পায়।

 

একটু দূরে তার হাতের ডানে কয়েকজন ছিনতাইকারী রিকশায় বসা একটা মেয়েকে ঘিরে ধরেছে। সংখ্যায় তিনজন। সবার মুখ রুমাল দিয়ে বাঁধা। একজন মেয়েটির ব্যাগ টানছে, আরেকজন মাথার কাছে কিছু একটা ধরে রেখেছে। ছুরি না পিস্তল বোঝা যাচ্ছে না।

 

ছিনতাইকারি দেখে আশপাশের সবাই নিরাপদ দূরত্বে সরে যাচ্ছে। খলিল এক মুহূর্ত ভাবে। তার আয়ু মাত্র ৩০ দিন, ৭২০ ঘন্টা।

 

মইরাই তো যামু। কাইল মরলেও যা, আইজ মরলেও তা। মরতেই যখন হইবো একটা ভালো কাজ কইরা মরি।

 

দৌড় দিয়ে এগিয়ে যায় সে। পেছন থেকে গিয়ে নিজের সব শক্তি দিয়ে পিস্তলধারীর গলা-মুখ চেপে ধরে।

 

খলিলের কাণ্ড এবং হঠাৎ আক্রমণে পিস্তলওয়ালা ঘাবড়ে যায়। সে এতটা চিন্তা করেনি। দীর্ঘ ছিনতাই ক্যারিয়ারে এরকম ঘটনার মুখোমুখি সে এই প্রথম। 

 

পিস্তলে সত্য সত্য গুলি আছে। বাঁচতে চাইলে ভাইগ্যা যা কইলাম। নাইলে গুলি করুম কিন্তু।

 

পিস্তলওয়ালা হুমকি দিলেও খলিল  তোয়াক্কা করে না। তার আয়ু মাত্র ত্রিশদিন। সাতশ বিশ ঘন্টা।

 

পিস্তলওয়ালাকে আরও জোরে জাপটে ধরে তার মুখের রুমাল খুলে ফেলে, ধরছি! ছিনতাইকারি ধরছি! কে কোথায় আছেন ভাই!চিৎকার দেয় খলিল।

 

ঘটনা ঘটে গেলে আমাদের এখানে লোক জড়ো হতে সময় লাগে না। একজন কিছু একটা করেছে টের পেয়ে যারা সটকে পড়েছিল তারাও এগিয়ে আসে।

 

ছিনতাইকারীর অন্য দুই সহযোগী সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে যায়। তাদের একজনের হাতে একটা ছুরি অবশ্য আছে। গেলো কোরবানিতে ব্যবহৃত।

 

কিন্তু তা দিয়ে এত লোক মোকাবেলা সম্ভব না।

 

খলিলকে প্রথমে তারা ভয়-ভীতি দেখানোর চেষ্টা করে। সঙ্গীকে ছাড়ানোর জন্য  টানাটানিও করে। কিন্তু খলিলের শরীরে আজ অসুরের শক্তি ভর করেছে। টানাটানিতে কাজ হয় না।

 

লোকজন যখন প্রায় হাতের দূরত্বে চলে আসে তখন পিস্তলওয়ালাকে ফেলেই জান বাঁচায় অন্য দুই ছিনতাইকারি।

 

খলিলের হাত থেকে পিস্তলওয়ালাকে যখন ছোটানো হয় তখন তার আধমরা অবস্থা। তাকে বাঁধা হয় ল্যাম্পপোস্টের সাথে।

 

ইতিমধ্যে মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। হাত বাঁধা ছিনতাইকারিকে কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পর মেরে বীরত্ব দেখাচ্ছে উপস্থিত অধিকাংশ মানুষ। একই সাথে নানামুখী আলোচনাও হচ্ছে।

 

দেখছেন ভাই, দেখছেন? কেমন চোখ বড় বড় কইরা চাইয়া আছে আবার? সাহসটা চিন্তা করছেন হারামিডার! কইলজাডা কত্ত বড় ওর।

 

একবার খালি কন চোখ দুইডা গালাইয়া দি। চুলায় পুরি ভাজা ত্যাল গরম আছে অহনও। পঞ্চাশ পঞ্চাশ একশ গ্রাম ঢাইল্যা দেই চৌক্ষের মইধ্যে। চোখ যখন পুরিভাজা হইবো তহন আর ছিনতাইয়ের নাম মুখে নিবো না। কত্ত বড় কলিজা, আমগো মহল্লায় ছিনতাই করে!

 

পাশ থেকে দৌড়ে আসে একজন, না না। আইন হাতে তুলে নেয়া ঠিক হবে না। পুলিশ আসতেছে। তাদের হাতে তুলে দেয়াই ভালো।

 

দৌড়ে আসা লোকের কথায় বিরক্ত হয় আগেরজন, আরে ভাই, আপনি আইন-আদালত নিয়া আইসেন না তো! এইদেশে লাঠি হইলো সবচে বড় আইন। যখন ছিনতাই হইতেছিল তখন কই ছিলেন আপনি? হাঁ?

 

দৌড়ে আসা লোকও এবার উত্তেজিত, আমি যদি জানতে চাই আপনি তখন কোথায় ছিলেন?

 

কি কইলেন আপনি . . .

 

আলোচনা-তর্ক এবং ছিনতাইকারিকে কিল-ঘুষি মারা একই সাথে চলতে থাকে।

 

খলিল খুঁজছে তার মোবাইল। ভিড়ের মধ্যে তার মোবাইল হাওয়া। 

 

মোবাইলডা গেল কই! ছিনতাইকারী ধরতে আইসা কি চোরের হাতে পড়লাম নাকি! যাউকগ্যা। জীবনডাই যেইখানে গেছে গা, মোবাইল গেলে আর কি হইবো।

 

খলিলের পাশে কয়েকজন স্থানীয় বসা। তারাও নিজের বাহাদুরি দেখানোর চেষ্টা করছে। একজন খলিলের জন্য এক কাপ চা নিয়ে এসেছে।

 

সে-ই শুরু করলো, চা বানাইতে ছিলাম। চুলার পানি তখনও গরম হয় নাই। হঠাৎ শুনি বাঁচাও বাঁচাও আওয়াজ। চাইয়্যা দেহি রিকশায় বসা মাইয়া মানুষের সামনে পিস্তল ধইরা রাখছে ওই শয়তান-খাটাশ। মায়ের জাতিরে অসম্মান! মাথা কি ঠিক থাকেনি, কন তো? দোকানের ঝাপের লাডিডা লইয়া যেই না বাইর হমু . . .

 

আরে ভাই রাখেন।

 

পাশে বসা ভুড়িওয়ালা মধ্যবয়স্ক একজন খ্যাক খ্যাক করে ওঠে, গপের আলাপ অন্য জায়গায় কইরেন। আফনের ঝাপের লাডি লওনের আগেই তো আমি খালি হাতেই অন দ্য স্পট চইল্লা গেছি। ছিনতাইরে ঝাপটা মাইরা ধরলো কেডা? এই আমি, আমি। আমি না থাকলে তো পলাইয়া গেছিলোই গা। বিশ্বাস না হইলে এই ভাইরে জিগান। কি ভাই, গেছিলো না পলাইয়া?

 

সমর্থনের আশায় লোকটা খলিলের দিকে তাকায়। খলিল কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায় না।

 

মধ্যবয়স্ক ভুড়িওয়ালা খলিলের জবাবের অপেক্ষা না করেই আবার শুরু করে, এইবার পিস্তলের খেলা টের পাইবা। আসল পিস্তলওয়ালারা চইল্যা আসছে। ডিম যখন ওই দিক দিয়া ভইরা এই দিক দিয়া বাইর করবো তখন বুঝবা ডিম সিদ্ধ হইতে কতক্ষণ লাগে।

 

খলিলের ডানপাশে বসা এক তরুণ উসখুস করছিল। তার ধৈর্য্যে কুলালো না। সেও মুখ খুললো, আমাদের এই এক সমস্যা, বুঝছেন ভাই? কাজের সময় কাউরে পাওয়া যায় না, অথচ বাহাদুরি দেখানোর সময় মানুষের অভাব নাই। চাপাবাজি বন্ধ করেন তো আপনারা। আর ভিড় কমাইয়া একটু দূরে যান। ভাইয়ের গায়ে বাতাস লাগতে দেন। যে খেইলডা আজ দেখাইছে ভাইয়ে। টিকেট সিস্টেম থাকলে পাবলিক টিকিট কাইট্টা এই খেলা দেখতো। সিনেমার হিরোও ফেইল। দেখি তো ভাইয়ের লগে একটা সেলফি তুলি। ফেসবুকে একটা পোস্ট দিতে হবে।

 

তরুণ তার মোবাইল ক্যামেরা অন করে, ভাইয়া একটু ক্যামেরার দিকে তাকান। স্মাইল।

 

পুলিশ এসে বন্ধ রাস্তা চালু করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। শত শত লোকের ভিড়ে ফাঁকা রাস্তায় এখন যানজট। যে মেয়েটি ঘটনার শিকার সে আসে খলিলের কাছে, আসলে কি বলবো বুঝতে পারছি না ভাইয়া। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আপনি যা করেছেন, এ ধরনের কাজ এখন আর কেউ করে না। আগে সিনেমায় দেখেছি আজকে বাস্তবে দেখলাম। আপনাকে ধন্যবাদ দেবো না, সালাম দেবো।

 

আমারে কিছুই দেওনের দরকার নাই। খালি একটু দোয়া দিয়েন।

 

মেয়েটির কথায় খলিলের চোখে পানি চলে আসে।

 

স্যার, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে পিস্তলসহ একজন ছিনতাই জনতার হাতে ধরা পড়েছে। ছিনতাইকারি এখন আমাদের হেফাজতে আছে . . . ওয়াকিটকিতে কথা বলতে বলতে পুলিশের একজন এসআইও আসেন। বয়সে তরুণ। এসব ঘটনায় তাই এখনও আন্দোলিত হন। 

 

এসআই খলিলের সাথে হাত মেলায়, আসলেই আনবিলিভেবল। সবাই যদি সন্ত্রাস-ছিনতাইয়ের বিরুদ্ধে এভাবে এগিয়ে আসতো। সাহস করে একজন এগিয়ে এলে আরও দশজন পেছন পেছন আসতো। তাহলে এসব কাজ করতে কেউ সাহস পেত না। আপনি আজ একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।

 

খলিল উঠে দাঁড়ায়, আমি তাইলে এখন যাই। আপনাগোও ধন্যবাদ। আমার লাইগ্যা দোয়া কইরেন। আপনাগো আব্বা-আম্মারে কইয়েন।

 

যাবেন মানে! একা কোথায় যাবেন আপনি? আশপাশে ছিনতাইকারীর লোকজন থাকতে পারে। আমরা আপনাকে বাসা পর্যন্ত নামিয়ে দেব। 

 

হাত ধরে টেনে নিয়ে খলিলকে গাড়িতে বসায় এসআই। ক্রিমিনালটাকে পেছনে তুলে আমি আসছি। (চলবে)

 

বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন

 

>>হঠাৎ খলিল (পর্ব- ১৪)

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com