শিরোনাম
খোমেনির লাশ নিয়ে যেভাবে চলেছিল মাতম
প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০১৭, ১২:৩২
খোমেনির লাশ নিয়ে যেভাবে চলেছিল মাতম
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

১৯৮৯ সালের ৩ জুন। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি মারা গেছেন। তাঁর জানাজা এবং শোক মিছিলে যোগ দিতে তেহরানে নেমেছিল লাখ লাখ মানুষের ঢল। লাশ নিয়ে চলেছিল মাতম। খুব কাছ থেকে সেই ঘটনা দেখেছেন, এমন দুজনের সঙ্গে কথা বলেন বিবিসির গোলনুশ গোলশানি।

 

মেহেদি খালাজি তখন ১৫ বছর বয়সী এক মাদ্রাসাছাত্র। তিনি তখন থাকেন ইরানের কোম শহরে তার বাবা-মার সঙ্গে। আয়াতুল্লাহ খোমেনি মৃত্যুর দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘তখন সকাল ৭টা। আমরা টেবিলে বসে সকালের নাশতা করছি। রেডিওতে খবর চলছে। সংবাদ পাঠক খবর পড়ছেন, কিন্তু একেবারেই ভিন্ন মেজাজে। তিনি বলছিলেন, আমাদের প্রাণপ্রিয় এবং মহান নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি আমাদের ছেড়ে বেহেশতে চলে গেছেন।’  

 

রেডিওতে এই খবর শুনে মেহেদির মা কাঁদতে শুরু করলেন। তিনি খুবই কান্নাকাটি করছিলেন। কাঁদতে শুরু করলেন তাঁর ছেলেমেয়েরাও। খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সব লোকজন স্বতঃস্ফূর্তভাব তাদের বাড়িঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসলো।  

 

মেহেদি খালাজি বলেন, ‘আমরা সেদিন কোম শহরের রাস্তায় যাকেই দেখেছিলাম, তিনিই কাঁদছিলেন।’

 

১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানের শাহ ক্ষমতাচ্যুত হন। সেই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেন আয়াতুল্লাহ খোমেনি। সেই বিপ্লবের পর থেকে ইরানের সর্বময় ক্ষমতা ছিল খোমেনির হাতে। তার ভক্তদের চোখে খোমেনি শুধ্য একজন রাজনীতিবিদ নন, তিনি ছিলেন অনেকটা ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী।

 

মেহেদি খালাজি বলেন, ‘আমাদের বাড়ির সব দেয়ালে খোমেনির ছবি ঝুলতো। যখন টেলিভিশন বা রেডিওতে খোমেনি কথা বলতেন, সবাই চুপ করে তাঁর কথা শুনতেন। কাজেই বলতে পারেন, খোমেনির উপস্থিতি ছিল সবখানেই। আমার বাবার কাছে তিনি নিজের বাবার চেয়েও অনেক বড় কিছু ছিলেন। খোমেনির জন্য তার যতটা আবেগ দেখেছি, নিজের বাবার জন্যও তার মধ্যে অতটা আবেগ দেখিনি।’

 

মেহেদি খালাজির বাবা ছিলেন ইরানের কোম শহরের এক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় নেতা। মেহেদি যখন শিশু, তখন তার বাবার সঙ্গে গিয়ে সামনা-সামনি আয়াতুল্লাহ খোমেনিকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন।

 

তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে মেহেদি বলেন, ‘তিনি ছিলেন খুবই সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে একেবারেই ভিন্ন দুটি বিষয় দেখেছি। যখন তিনি বড়দের সঙ্গে, তখন তিনি খুবই গুরুগম্ভীর। তাকে হাসতে দেখা যেত খুবই কম। কিন্তু শিশুদের সঙ্গে তাকে দেখা যেত একেবারে ভিন্ন মেজাজে। তিনি প্রচুর হাসতেন, শিশুদের সঙ্গে খেলতেন। শিশুদের সঙ্গে মেশার সময় তার মধ্যে প্রচুর আবেগ দেখা যেত।’  

 

শিশুদের সঙ্গে হয়তো তিনি আবেগপ্রবণ ছিলেন, কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবেলার ক্ষেত্রে আয়াতুল্লাহ খোমেনি ছিলেন খুবই নিষ্ঠুর। বিপ্লবের পরপরই তিনি কঠোর হাতে তার সমালোচকদের দমন করা শুরু করলেন।

 

বহু মানুষকে ফাঁসিতে ঝোলালেন। অনেককে পাঠালেন নির্বাসনে। ইরাকের সঙ্গে তিনি আট বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন, সেই যুদ্ধে মারা গেল হাজার হাজার ইরানি। ইরানের অর্থনীতি তখন ধ্বংসের শেষ সীমায়। শান্তি চুক্তির অবস্থা খুবই নাজুক, এ অবস্থায় অনেক ইরানির মনেই তখন প্রশ্ন- তার অবর্তমানে দেশের হাল কে ধরবে।

 

খোমেনির মৃত্যুর পর সব জায়গায়ই রেডিও বাজছিল। সবাই বিবিসি আর ভয়েস অব আমেরিকা শুনছিল। খোমেনির মৃত্যুর পর ইরানে সামনে কি ঘটতে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে সবাই পশ্চিমাদের বিশ্লেষণ শুনতে চাচ্ছিল।

 

আয়াতুল্লাহ খোমেনির মৃত্যু নিয়ে শুধু ইরানে নয়, তোলপাড় চলছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। ফরাসি আলোকচিত্র সাংবাদিক এরিক বুভে প্যারিস থেকে প্লেনে চড়ে বসলেন ইরানে গিয়ে খোমেনির জানাজার সংবাদচিত্র সংগ্রহের জন্য। কিন্তু তিনি জানতেন, ইরানে ঢোকাটা অত সহজ হবে না।

 

এরিক বুভে বলেন, ‘আমাদের দলে আমরা প্রায় ৮-১০জনের মতো সাংবাদিক ছিলাম। আমাদের কারোই ইরানের ভিসা ছিল না। কাজেই আমরা বুঝতে পারছিলাম না, আমাদের ইরানে ঢুকতে দেয়া হবে কিনা। মধ্যরাতের পর ২টা-৩টার দিকে আমরা ইরানে পৌঁছালাম। বিমানবন্দরে ইরানি কর্তৃপক্ষ আমাদের ঢুকতে দিচ্ছিল না। আমরাও জেদ ধরলাম, কেন আমাদের যেতে দেবে না। তারপর ভোর ৫টার দিকে কি হলো বুঝতে পারলাম না, ইরানি কর্তৃপক্ষ আমাদের ইরানে প্রবেশের অনুমতি দিল। এরপর সকাল ৭টার দিকে আমরা চলে গেলাম জনতার মাঝখানে। সেখানে তখন ১০ লাখের বেশি মানুষ।’

 

 

 

 

৫ জুন তেহরানের রাস্তায় শেষ পর্যন্ত কত মানুষ হয়েছিল তা বলা মুশকিল। কারো হিসেবে ২০ লাখ, কারো হিসেবে তার চেয়েও বেশি, ৩০ লাখ। কালো কাপড়ে আবৃত মানুষেরা তাদের বুক চাপড়ে প্রিয় নেতার জন্য শোক প্রকাশ করছিল। আয়াতুল্লাহ খোমেনির দেহ চাদরে আবৃত করে একটি কাঁচের বাক্সে রাখা হয়েছিল। তার বিখ্যাত পাগড়িটি রাখা ছিল দেহের ওপরে।

 

সেই লাখ লাখ মানুষের ভিড়ের মধ্যে ছিলেন মেহেদি খালাজি। সেদিনের পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘শেষ বিকেলে আমরা সেখানে পৌঁছাই। তখন বসন্তকাল শেষে গ্রীষ্ম মাত্র শুরু হচ্ছে। একটু গরম পড়েছে। আমাদের সবার গায়ে কালো শার্ট। আমরা ঘামছিলাম। ঘাম আর চোখের পানি, দুটিরই নোনতা স্বাদ আমাদের মুখে। অনেকেই তখন আবেগে কাঁদছে, কেউ কেউ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কাঁচের বক্সটির দিকে।’

 

পরদিন সকালে মানুষের ভিড় আরো বাড়লো। উত্তর তেহরানের ওই অংশের সব রাস্তাঘাট তখন মানুষের ভিড়ে বন্ধ হয়ে গেছে। আয়াতুল্লাহ খোমেনির দেহ রাস্তা দিয়ে দক্ষিণ তেহরানের কবরস্থানে নেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। কিন্তু মৃতদেহটি যে কাঁচের বক্সে রাখা হয়েছিল, যখনই সেটা খোলা হলো, তখনই শুরু হলো বিশৃঙ্খলা।

 

মেহেদি খালাজি বলেন, ‘সবাই তখন চিৎকার করছে, কাঁদছে। সবাই খোমেনির দেহ দেখতে চাইছিল, সবাই লাশ স্পর্শ করতে চাইছিল। নিরাপত্তা বাহিনী প্রাণপনে চেষ্টা করছিল জনতাকে ঠেকানোর। তারা খোমিনের মৃতদেহ নিয়ে সামনে এগুতে চাইছিল।’

 

এই বিশৃঙ্খলা আর হুড়োহুড়ির মধ্যে আটজন মারা যায়, আহত হয় কয়েকশো মানুষ। 

 

ফরাসি আলোকচিত্র সাংবাদিক এরিক বুভে আটকে পড়েছিলেন এই জনতার ভিড়ে। হেলিকপ্টারে করে সাংবাদিকদের নেয়া হচ্ছিল কবরস্থানে, যেখানে খোমেনিকে কবর দেয়া হবে। কিন্ত এরিক বুভে ভিড়ে আটকে পড়ায় সেই হেলিকপ্টার মিস করেন। জনতা যখন নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে খোমেনির কফিনের কাছে পৌঁছে গেছে, তখন খুব কাছেই ছিলেন তিনি।

 

এরিক বুভে বলেন, ‘সবাই সবাইকে ঠেলছিল। মনে হচ্ছিল একটার পর একটা জনতার ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে। কফিনটা আমার কাছ থেকে তখন বড়জোর ৫০ বা ৭০ মিটার দূরে। এই ধাক্কাধাক্কির মধ্যে আমি কোনো রকমে কয়েকটা ছবি তুলতে পেরেছিলাম।’

 

নিরাপত্তা বেষ্টনী তছনছ করে শোকার্ত উন্মাদপ্রায় জনতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির দেহ কেড়ে নিল। এরপর আধঘণ্টা ধরে এই মৃতদেহ জনতার মধ্যে হাত বদল হতে লাগলো। মৃতদেহ আবৃত করে রাখা চাদরটি ছিড়ে কুটি কুটি করে ফেলা হয়। পরে নিরাপত্তা বাহিনী আবার লাশের নিয়ন্ত্রণ নেয়। খোমেনির লাশ ঘিরে এই উন্মাদনা দেখে হতবাক হয়ে যান এরিক বুভে।

 

তিনি বলেন, ‘আয়াতুল্লাহ খোমেনিকে এই অবস্থায় দেখব, এটা কখনো ভাবিনি। কারণ তিনি তো একজন নেতা। তিনি বিশ্বের একটা অঞ্চল বদলে দিয়েছেন। তার দেহ নিয়ে যা ঘটলো, তা অবিশ্বাস্য।’

 

লাখ লাখ মানুষের যে শোক মিছিল কবরস্থানের দিকে যাওয়ার কথা, তা কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়ালো। খোমেনির মৃতদেহ উদ্ধারের পর তা নতুন এক চাদরে মোড়া হলো। এবার সেটি একটি লোহার বাক্সে ভরে হেলিকপ্টারে নেয়া হলো কবরস্থানে। সেদিন শেষ বেলায় খোমেনির দাফন সম্পন্ন হলো দক্ষিণ তেহরানের কবরস্থানে।

 

মেহেদি খালাজির ধারণা, আয়াতুল্লাহ খোমেনিকে ঘিরে শুধু ইরানের মানুষ বা মুসলিমদের নয়, বিশ্বজুড়ে যারাই নির্যাতিত বা বঞ্চিত, তাদের তিনি ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিলেন।

 

তিনি বলেন, ‘বিংশ শতাব্দীতে চলতে হলে যা যা দরকার, বিশেষ করে একটি মুসলিম দেশে, তার সবকিছুই তার চরিত্রে প্রতিফলিত হয়েছিল। সেজন্যই তিনি বিশ্বজুড়ে এত বিপুলসংখ্যাক মুসলিমকে এতটা প্রাভাবিত এবং অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিলেন।’

 

আয়োতুল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর তার জায়গায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতার পদে আসেন আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। তিনি এখনো ইরানে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছেন।

 

মেহেদি খালাজি তার ধর্মীয় পড়াশুনা শেষ করেছেন, কিন্তু খোমেনি পরবর্তী ইরানি নেতাদের ওপর তাঁর কোনো আস্থা নেই। তিনি এখন একটি মার্কিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে শিয়া রাজনীতির বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করেন। এরিক বুভে আয়াতোল্লাহ খোমেনির শোক মিছিলের যেসব ছবি তুলেছিলেন, তার জন্য ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো পুরস্কার পান। সূত্র: বিবিসি

 

বিবার্তা/নিশি

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com