আমাদের কী যে স্বভাব হয়েছে, আজকাল খালি কথায় কথায় ‘আজকালকার বাচ্চা এই করেছে, সেই করেছে’ এই সব গল্পে বিজি থাকি। বাচ্চারা নষ্ট হচ্ছে এটা ডিজিটাল দুনিয়ার দোষ, নাকি আমাদেরও কিছু ত্রুটি আছে - এসব নিয়ে মনে হয় না আমাদের মাথাব্যথা আছে। আর থাকবেই বা কীভাবে? আমরা যে ‘কান নিয়েছে চিলে’র দলভুক্ত।
আমার পরিচিত এক দম্পতির এক ছেলে(পরবর্তীতে আরো একজন হয়েছে)। দুজনেই চাকরিজীবী। হাতে সময় খুব কম। তাই সময় বাঁচানোর জন্য যাবতীয় রান্না করা খাবার একসাথে ব্লেন্ড করে খাইয়ে দেন। সেই সাথে আরো ঝামেলামুক্তির জন্য হাতে তুলে দেন চিপস, বিস্কুট, চকলেট। এতে করে বাচ্চা আজকাল সলিড খাবার খেতেই পারে না।
এক ভাবীকে বলতে শুনলাম তার ছোট মেয়ে রাত ৩টার আগে ঘুমায় না। আগে ঘুমাতে বললে বাপ-মাকে ঝাড়ি দেয়। আর বেলা ১২টায় ঘুম থেকে ওঠে। তাই স্কুলটাইমও সেভাবে সেট করে নিয়েছে। রাত জেগে মেয়ে ইন্টারনেটে বিজি থাকে, সেই সাথে চলতে থাকে টেলিভিশন।
একজন জানেই না তার ছেলে বাচ্চার পায়ের জুতোর সাইজ। এমনকী সে তেমন কিছুই বলতে পারবে না তার বাচ্চার চয়েজ নিয়েও। কেননা ছেলের তিন বছর বয়স থেকে সে থাকছে কাজের লোকের কাছে, এমনকী ঘুমাচ্ছেও তার কাছে। সেই মা কিন্তু ফুলটাইম ফ্রি, শুধু একটু ফোন আর টিভি দেখায় ‘বিজি’ থাকেন।
এক দম্পতি তাদের তিন বাচ্চাকে রেখে ঘুরে বেড়ান। দেশে তো বটেই, দেশের বাইরেও নাকি মাসখানেকের জন্য যান। বাচ্চাদের রেখে যান নিজের মা আর কাজের লোকের কাছে। বাচ্চারা নাকি এতেই অভ্যস্ত। আর বাচ্চা নিয়ে ঘুরলে নাকি ঘোরার মজাই থাকে না।
এক মেয়ে সে জন্ম থেকেই বোবা। বয়স ১৪/১৬। এই বয়সেই সে পুরো পরিবারের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। হাতের কাজ করে সংসার চালাতো, এক পয়সাও সে নিজের কাছে রাখতো না, সব দিয়ে দিত বাবা-মায়ের হাতে। একদিন সেই মেয়ে অসুস্থ হয়ে গেলে ১০/১২ দিন বাসায় ফেলে রাখার পর যখন আর অবহেলা করা যাচ্ছিল না, তখন হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এক মায়ের বাচ্চা অটিস্টিক। মাত্র দুই বছর বয়স। বাচ্চা অটিস্টিক বলে বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি। বাচ্চার নানী তাই বাচ্চাকে নিজের কাছে রেখে মায়ের নতুন জায়গায় বিয়ে দিয়েছে। আর বাচ্চাটাকে কোনোমতে নিজের কাছে রেখেছে না-রাখার মত অবস্থায়।
এমন অনেক মা-বাবা আছেন, যারা বাচ্চাদের স্কুলেও কখনো যান না কিংবা তাদের স্কুলের বই-খাতাও কখনো উল্টে দেখেন না।
উপরের সবগুলো উদাহরণ বাস্তব, আমার চারপাশে ঘটা কাহিনি।
আজকাল আমরা কেমন যেনো হয়ে গিয়েছি। বাচ্চাদের দামী খেলনা, ফোন, ট্যাব, গাড়ি এসব দিয়েই মনে হয় দায়িত্ব শেষ করে ফেলি। আর কোনো কোনো বাবা তো মাসশেষে সংসারখরচের টাকাটা দিয়েই খালাস।
সাম্প্রতিককালে গুলশান ট্র্যাজেডিতে যেসব জঙ্গির সন্ধান পাওয়া যায়, তাদের সবাই ছিল উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান, আর সবার হাতেই ছিল অগাধ টাকা। তাদের কোনো অভাবই ছিল না, অভাব ছিল শুধু পারিবারিক মমতা ও ভালোবাসার।
সন্তানকে একটু বেশি সময় দিলে কিন্তু আমরা খুব বেশি পিছিয়ে যাবো না। সন্তানকে জানতে হবে, বুঝতে হবে। বাচ্চা যেনো অ্যাবিউজড না হয়, তা যেমনটাই হোক না কেন।
কিছুদিন একটা এনজিওর সাথে কাটানোর সুযোগ আমার হয়েছিল। আমি খুব কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী বাচ্চাকে দেখেছি, বুঝতে চেষ্টা করেছি। দেখেছি প্রতি ১০টা বাচ্চার মধ্যে অন্তত দুইটা বাচ্চা বাবা-মায়ের অবহেলায় স্বাভাবিক জীবন থেকে পিছিয়ে গিয়েছে। অনেক বাবা-মাই মাঝপথে এসে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। আর এর পরিণতি হয় ভয়ানক।
বাচ্চা যা-ই হোক না কেন, যে বয়সেরই হোক না কেন, বাবা-মা হিসেবে আমাদের উচিত তাদের খোঁজ রাখা, তাদের সময় দেয়া, জীবনের সব আনন্দঘন মুহূর্তগুলো বাচ্চাদের সাথে শেয়ার করা।
কেউ খেয়াল করেছেন কিনা জানি না, রাস্তার ধারে বসে যে মায়েরা খাবার কিংবা পান-সিগারেট বিক্রি করে তারাও কিন্তু তাদের ছোট বাচ্চাটাকে পাশে বসিয়ে রাখে। যত সমস্যা আমাদেরই, আমরা একটু বেশি ‘ভদ্র’ সমাজের কিনা!
অবশ্য এর যে ব্যতিক্রমও হয় না তা নয়। আমি দেখেছি অনেক মা-ই হায়ার এডুকেশন থাকা সত্ত্বেও তার পুরো সময়টা উজাড় করে দিচ্ছেন বাচ্চাদের।
একটা সময় আসবে বাচ্চার ছোট্ট হাতের উষ্ণতা পাবার জন্য হয়তো আপনার মনটা খুব আকুপাকু করবে, কিন্তু তখন আপনি থাকবেন একা, শুধুই একা। ওদের কিন্তু তখন আর সময় হবে না আপনাকে সময় দেয়ার।
লেখক : সমাজকর্মী
বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]