শিরোনাম
৭ নভেম্বর ইতিহাসে কোনো অর্জন নয় বরং ঘৃণ্য
প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০১৬, ১৮:১১
৭ নভেম্বর ইতিহাসে কোনো অর্জন নয় বরং ঘৃণ্য
ভূঁইয়া মো. ফয়েজউল্লাহ মানিক
প্রিন্ট অ-অ+

৭ নভেম্বরের প্রেক্ষাপট, ঘটে যাওয়া করুন রক্তপাত এবং এই নিয়ে ধোঁয়াশার শেষ নেই। দেশী-বিদেশী কুশীলবদের গভীর ষড়যন্ত্র এবং উচ্চাভিলাষী গুটি কতক পথভ্রষ্ট সেনা কর্মকর্তার নির্মমতায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াবহ রক্তপাতের মাধ্যমে জাতির পিতাকে পরিবারসহ নৃশংসভাবে হত্যার পর বাংলাদেশের ইতিহাসে যে কালো অধ্যায়ের শুরু হয়েছিল, থেমে থেমে তার পুনরাবৃত্তি হয়েছে অসংখ্যবার। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাস ছিল ভয়াবহ রক্তপাতের মাস। নভেম্বর মাসের এ ভয়াবহ রক্তপাতের ঘটনাগুলোর বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের জন্য কারোরই আগ্রহের কমতি নেই। কিন্তু এ বিষয়গুলোকে আরও অস্পষ্ট করেছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখকের ভুল ইতিহাস রচনা আর কাউকে বেঈমান কিংবা হিরো বানানোর প্রবনতা।


বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ৩ নভেম্বর রক্তপাতহীন সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। জিয়াকে ২ নভেম্বর থেকে গৃহবন্দী করা হয়। ধারাবাহিকভাবে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত বর্ণনা করা প্রায় অসম্ভব, কারণ ক্যান্টনমেন্ট থেকে বঙ্গভবন পর্যন্ত এমন হ-য-ব-র-ল বিশৃঙ্খলা ছিল যে ক্রমানুসার করাই সম্ভব নয়।


তবে এটা স্পষ্ট, ৩ নভেম্বর জেলহত্যা সম্পর্কে জিয়া ও তাহের বেশ ভালোভাবেই অবগত ছিলেন। জিল্লুর রহমান কান ও ডালিমের লেখায় এটা স্পষ্ট যে, ৩ নভেম্বর জিয়া এবং তাহের জানতেন যে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের বিষয়ে জাতীয় চার নেতা অবগত। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানটি ছিল প্রায় রক্তপাতহীন। কিন্তু ‘৭৫ এর ১৫ আগস্টের কুশীলবরা সেই রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের প্রতিউত্তরে জঘন্য ও নৃশংস রক্তপাতের মাধ্যমে পুনরায় ইতিহাসে আরেকটি কালো অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছিল। যার নেপথ্যে খন্দকার মোশতাক, জিয়া, তাহেররা ছিল এটা মোটামুটি নিশ্চিত।


কর্নেল হামিদের বইতে উল্লেখ আছে, কর্নেল তাহেরের মূল উদ্দেশ্য ছিল জিয়ার কাঁধে ভর করে ক্ষমতা দখল করা। জিয়ার প্ররোচনাতেই যে মেজর জলিলের উপস্থিতিতে একজন হাবিলদার খালেদ মোশাররফকে হত্যা করে এটা বুঝতে তেমন বেগ পেতে হয় না, যদিও জিয়া বলেছিলেন খালিদকে যাতে প্রাণে না মারা হয়। ৭ নভেম্বর খালেদ মোশাররফকে হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করে, জিয়াকে মুক্ত করে কর্নেল তাহের তার উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছিল। কিন্তু ধুরন্ধর জিয়া যে হিসাব-নিকাশে তার থেকেও পরিপক্ক সেটা তাহের বুঝতে পারেনি। জিয়া সাধারণ সেনাদের আর মানুষের দোহাই দিয়ে নিজেকে সামরিক প্রশাসক ঘোষণা করলে তাহেরের সম্বিত ফিরে আসে। কিন্তু সে ধুরন্ধর জিয়ার তো কিছুই করতে পারেনি বরং পরবর্তীতে নিজেই প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয়। যদিও ৭ নভেম্বরের এই ভয়াল রক্তপাতের মূল কারিগর কিন্তু তাহেরের অনুসারী সেনারা আর জাসদের কর্মীরা ছিল (যদিও জিয়া সবই জানতেন)। এজন্য কর্নেল হামিদ তার বইয়ের একটি জায়গায় উল্লেখ করেছেন, ‘তার (তাহেরের) ক্যালকুলেশনে ভুল হয়েছিল।’


জিয়া এতই চতুর ছিলেন যে, পুরোনো কুশীলবদের ব্যবহার করে ধীরে ধীরে সকল কিছুই তার নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছিলেন। যার কিছুটা অনুভব করা যায় ‘৭৫ সালের ৭ নভেম্বর পরবর্তীতে প্রায় প্রতিটি জাতীয় দৈনিকের নিউজ দেখলে। প্রায় প্রতিটি পত্রিকাতেই এ নৃশংস ঘটনাটি দেখানো হয়েছে জাতীয় অর্জন হিসেবে। আর অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, মোশতাক-জিয়া-তাহেরকে বানানো হয়েছিল হিরো !


আর আর্টিকেলগুলোর মধ্যে ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী জিয়াকে রীতিমতো হিরোই বানিয়ে ফেলেছেন। লে. মাহবুব সাহেব কিছুটা কৌশুলি উপস্থাপন করলেও বিশিষ্ট কলাম লেখক আবুল মকসুদ সাহেবসহ বাকীরা বস্তুনিষ্ঠ উপস্থাপনের চেষ্টাই করেছেন। সুতরাং৭ নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো অর্জনতো নয়ই বরং আরও ঘৃন্য, আরও জঘন্য কিংবা আর নৃশংসতার জন্ম দিয়েছে। ইতিহাসকে বারবার কলঙ্কিত করেছে, যার মূল কারিগর কিন্তু একই, সেই ‘৭৫ এর ১৫ আগস্টের কুশীলব মোশতাক-জিয়া-তাহেরসহ তাদের অনুসারী পথভ্রষ্ট সেনাকর্মকর্তারা।


বিভিন্ন লেখকের বইয়ে তাদের বর্ণনায় ৭ নভেম্বর :


‘৬ তারিখ রাত ১২ টায় সিপাহী বিপ্লবের খবর পেয়ে জেনারেল খালেদ মুশাররফ সঙ্গে সঙ্গে তার প্রাইভেট কার নিয়ে বঙ্গভবন থেকে দ্রুত বেরিয়ে যান। তার সাথে ছিল কর্নেল হুদা ও হায়দার। খালেদ প্রথমে রক্ষীবাহিনী প্রধান ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের বাসায় যান। নুরুজ্জামান তাকে খাকি ড্রেস পাল্টিয়ে নিতে অনুরোধ করেন। সে তার নিজের একটি প্যান্ট ও বুশ শার্ট খালেদকে পরতে দেয়। ৪র্থ বেঙ্গলে সর্বশেষ ফোন করলে ডিউটি অফিসার লে. কামরুল ফোন ধরেন। সে তাকে প্রকৃত অবস্থা অবহিত করেন। এবার খালেদ বুঝতে পারেন অবস্থা খুবই নাজুক। তিনি অবস্থান পরিবর্তন করে শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত ১০ম বেঙ্গল রেজিমন্টে আশ্রয় গ্রহন করতে যান। প্রথমে নিরাপদেই তার বিশ্বস্ত ইউনিটে আশ্রয় নেন। কমান্ডিং অফিসার ছিলেন কর্নেল নওয়াজিশ। তাকে দেয়া হয় খালেদের আগমনের সংবাদ। তিনি তাৎক্ষনিক টেলিফোনে টু-ফিল্ডে সদ্যমুক্ত জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তার ইউনিটে খালেদ মুশররফের উপস্থিতির কথা জানিয়ে দেন। জিয়ার সাথে জলিলের ফোনে কিছু কথা হয়। কর্নেল আমিনুল হক বলেছেন, তিনি ওই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং জিয়াকে বলতে শুনেছেন, যেন খালেদকে প্রানে মারা না হয়। যাহোক, ভোরবেলা দেখতে দেখতে সিপাহী বিদ্রোহের প্রবল ঢেউ ১০ম বেঙ্গলে গিয়ে লাগতে শুরু করল। পরিস্থিতি কর্নেল নওয়াজিশের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। তারা খালেদ ও তার সহযোগীদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সিপাহীরা তাদের টেনে হিচড়ে বের করে। জানা গেছে মেজর জলিল কয়েকজন উত্তেজিত সৈনিক নিয়ে মেসের ভিতর প্রবেশ করে। তার সাথে একজন বিপ্লবী হাবিলদারও ছিল। সে চিৎকার দিয়ে জেনারেল খালেদকে বলল, ‘আমরা তোমার বিচার চাই।’ খালেদ শান্ত কন্ঠে জবাব, ঠিক আছে তোমরা আমার বিচার কর। আমাকে জিয়ার কাছে নিয়ে চলো।’ স্বয়ংক্রিয় রাইফেল বাগিয়ে হাবিলদার বলল, ‘আমরা এখানেই তোমার বিচার করব’। খালেদ ধীরস্থির, বললেন, ‘ঠিক আছে তোমরা আমার বিচার কর’। খালেদ দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন। ট্যা-র-র-র-র! একটি ব্রাশ ফায়ার! আগুনের ঝলক বেরিয়ে এল বন্দুকের নল থেকে। মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী খালেদ মোশররফ। সাঙ্গ হল বিচার। শেষ হল তার বর্নাঢ্য জীবনেতিহাস।” (তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা: লে. ক. আব্দুল হামিদ)


খালেদ মোশাররফের অভ্যূত্থানে চার নেতার সায় ছিলঃ


‘খালেদ মোশাররফের অভ্যূত্থানের বিষয়ে জেলে চার নেতা অবহিত ছিলেন। এটা ছিল একটা মুজিবপন্থি একটা পাল্টা অভ্যূত্থান। কারন চার নেতা বীরদর্পে জেল থেকে বের হয়ে এসে সরকার গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।’ (Leadership Crisis in Bangladesh : জিল্লুর রহমান খান)


‘১৯৭৫ সালের ৫ ও ৬ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টসহ সারা শহরে ছড়ানো হলো হাজার হাজার প্রচারপত্র। এই কাজগুলো করল বামপন্থী জাসদ। এ সময় রাজনৈতিক দল জাসদ ছিল নিষিদ্ধ। কিন্তু তারা কাজ করছিল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এবং বিপ্লবী গণবাহিনীর আবরণে। একটি ব্যাপারে ডান ও বাম উভয় রাজনৈতিক দলই একমত ছিল, আর তা হচ্ছে—খালেদ মোশাররফ একজন বিশ্বাসঘাতক, ভারতের দালাল এবং সে ঘৃণিত বাকশাল ও মুজিববাদ ফিরিয়ে আনতে চাইছে।’ (বাংলাদেশ এ লিগ্যাসি অফ ব্লাড: অ্যান্থনি মাসকারেনহাস)


লে. ক. ডালিম ৭ নভেম্বর তথা নভেম্বর বিপ্লবের প্রেক্ষাপট বর্ননা করতে গিয়ে বলেন, ‘ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন চেষ্টা চালাচ্ছে আর্মির মধ্যে কিছু লোকের মাধ্যমে একটি প্রতি বিপ্লব ঘটিয়ে জাতীয় পর্যায়ে বিভক্তি সৃষ্টি করে দেশকে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়ে ২৫ বছরের আওতায় বাংলাদেশে সরাসরিভাবে হস্তক্ষেপ করে জনাব তাজুদ্দীনের নেতৃত্বে একটি অনুগত সরকার গঠন করে বাংলাদেশকে একটি করদ রাজ্যে পরিনত করা।’ (লে. ক. শরীফুল হক ডালিম : যা দেখেছি, যা বুঝেছি ও যা করেছি, পৃষ্ঠা ৫০৩)


‘২ নভেম্বর দুপুর থেকেই সেনানিবাস থেকে ট্রুপস মুভমেন্ট শুরু হল।… ৩ নভেম্বর দিনের মধ্যেই ফারুক-রশীদরা ক্যান্টনমেন্টের সঙ্গে একটা আপোস রফায় আসেন। ৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে মুশতাকের সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠক চলাকালে কর্নেল সাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে একদল সৈনিক সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে সবাইকে হ্যান্ডসআপ করায় এবং মুশতাককে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী বলে গালিগালাজ করতে থাকে। মুশতাক ও তার মন্ত্রিপরিষদের সব সদস্যকে হত্যা করে ৩২ নম্বর থেকে শুরু করে জেলখানা পর্যন্ত সব হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয়ার হুমকি দেয়। মুশতাকসহ মন্ত্রিপরিষদের সবারই তখন অত্যন্ত করুণ অবস্থা। তারা তাক করা অস্ত্রের সামনে ভীত ভেড়ার মত কাঁপতে থাকে। এ সময় জেনারেল খলিলুর রহমান উত্তেজিত সৈনিকদের বোঝানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ধমক খান। তবে শেষ পর্যন্ত জেনারেল ওসমানী তাদের নিবৃত্ত করেন। এ সময় খন্দকার মুশতাক উদাসভাবে জিজ্ঞেস করেন, তোমরা আমার কাছে কি চাও” জবাবে তারা জেনারেল জিয়াকে বরখাস্ত করে তার স্থলে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করতে বলে। মুশতাক তাদের এই দাবি মেনে নেন।” (রাজনীতির তিনকাল :মিজানুর রহমান চৌধুরী, পৃষ্ঠা: ১৭২-১৭৩)


লেখক : কার্যকরী সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ


বিবার্তা/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com