শিরোনাম
সেই এক রাতের অভিজ্ঞতা
প্রকাশ : ২১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৮:০১
সেই এক রাতের অভিজ্ঞতা
রেহানা বেগম
প্রিন্ট অ-অ+

দশ বছরের কিশোরী রেহানা। মাথাভর্তি লম্বা চুল, কিন্তু সেই চুল সামলানো, যত্ন করা সম্ভব হয় না। তাই নিত্য মার বকা খেতে হয়।


নানী তার চুলের যত্ন করে, তার সব গুছিয়ে দেয়। অন্য নাতি-নাতনীদের চাইতে বাড়তি খেয়াল , আদরযত্নের জন্যে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে খালা, খালাতো ভাই-বোনদের ইর্ষার পাত্রী সে। নিজের কাজ গুছিয়ে করতে না পারা, লেখাপড়া ঠিকমত না করার জন্যে যখন মা-বাবা শাসন করতে যান তখনও উদ্ধারকারীর ভুমিকায় নানী। ‘মেয়েটা তোমার জন্যে উচ্ছন্নে যাচ্ছে’ মেয়ের এমন ভর্ৎসনায় নিরবে কখনও চোখ মোছেন নানী।


নানী আজ বেশ কিছু দিন হল গ্রামের বাড়ী গেছেন। তাই নিয়ম মেনে চলতে হয় রেহানাকে। এখন মারতে শুরু করলে বাঁচানোর কেউ নেই, বোঝে সে। তাই দুপুরে লক্ষী মেয়ের মতো খেয়েদেয়ে ছোট ভাইদের সাথে ঘুমাতে গেছে। অন্য সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ভেতরের আদারবাদাড় কিছু বাদ রাখতো না। টো টো করে ঘুরে বেড়াত।


রেহানা তার ছোট চার ভাইয়ের সাথে ঘুমায়। ছেলে-মেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে জানালার পাশে খাটে বসে চুল মেলে দিয়েছেন মা। সেই চুলে বিলি কেটে দিচ্ছেন বোনঝি রহিমা। মেয়েটার বয়স পনের কি ষোল। ঢাকার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু পরিবার ভাল হলেও ছেলেটি খুব অলস, দায়িত্বহীন।


রহিমা তাই সদ্য ডিভোর্স নিয়ে খালার বাসায় আছেন। অসম্ভব সুন্দরী আর গুণবতী মেয়েটি সাংসারিক সব কর্মে সুনিপুণা আর করিৎকর্মা।


রহিমা চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে আর গ্রামে ফেলে আসা আত্মীয়-বন্ধুদের গল্প বলছে। হঠাৎ খালা তাকে বললেন, দেখ তো রহিমা, সবাই নিচে সবাই এমন ছুটছে কেন। কি হলো!! সবাই প্রাণপণে কোথায় ছুটছে?


রহিমা খালার দৃষ্টি অনুসরণ করলো। আরে তাই তো! কোথায় ছুটছে সবাই। এমনতো কখনও দেখেনি। হঠাৎ ইলেক্ট্রিসিটি অফ হয়ে গেলো পুরো রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ভেতরে। আতঙ্ক-উৎকণ্ঠায় দুজনেই পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে।


বারান্দার দিকে ছুটলো রহিমা। বারান্দা থেকে চামেলীবাগ এলাকা দেখা যায়। সেখানের পরিস্থিতি কি দেখে এসে রহিমা জানাল, নাহ চামেলীবাগে তো ইলেক্ট্রিসিটি আছে।



উৎকণ্ঠা এবার আশঙ্কায় পরিণত হল। খালা বলল, কারফিউ শুরু হল নাকি! কিন্তু পুলিশ লাইনের ভেতরে তো কারফিউর প্রভাব পড়ে না।


‘তোর খালুও ফিরল না’ বলে উৎকণ্ঠা জানায় খালা। অনেক দিন ধরেই ভাসা ভাসা শুনে আসছিল দেশে আন্দোলন হচ্ছে।


এরই মাঝে দরজায় দুম দুম আওয়াজ। রহিমা দৌড়ে দরজা খুলতেই শামছুদ্দিন আহমেদ, মানে কিশোরী রেহানার বাবা বাসায় ঢোকেন। এরই মধ্যে রেহানারও ঘুম ভেঙ্গে গেছে। বাসায় গা ছমছম করা অন্ধকার। আব্বার মুখে টেনশন। কী সব বলছেন, যুদ্ধ নাকি শুরু হয়ে গেছে। পাক সেনারা পিলখানায় হামলা করে রাজারবাগের দিকে আসছে। পুলিশরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশ অমান্য করেই অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।


বাইরে থেকে গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। দশ বছর বয়সেও রেহানা বুঝে গেছে দেশে সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটছে। আব্বা সবাইকে নিয়ে খাটের নিচে ঢুকে পড়তে বললেন। নিজেও ঢুকলেন। কারণ, জানালা দিয়ে বুলেট বাসার ভেতরেও ঢুকছিল।


যে খাটের নিচে ময়লার মধ্যে ঢোকার জন্যে প্রায়ই মার খেতো রেহানা, আজ প্রাণভয়ে সবাই সেখানেই আশ্রয় নিয়েছে। অবাক কাণ্ড, ছোট্ট ছয় মাসের বাচ্চাটা পর্যন্ত একটু আওয়াজ বা কান্না করছে না। সেও বুঝে গেছে হায়েনার দল হামলে পড়েছে। মা-বাবা সমানে আয়াতুল কুরসী আর ইয়াসিন সুরা পড়ে যাচ্ছেন। কত সময় পেরিয়ে গেলো এর মাঝে, কেউ বলতে পারে না।


মাঝে হঠাৎ থেমে থেমে তারপর ঝড়-বৃষ্টির মতো গুলির আওয়াজ। তীব্র আওয়াজে ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যায়।


অনেক রাতে হঠাৎ দরজায় টোকা পড়লো। টোকা শুনে আর কারও ধড়ে প্রাণ নেই। এবার বুঝি আর প্রাণ বাঁচবে না। হায়েনার দল বাসায় চলে এসেছে। মা নিষেধ করল দরজা খুলতে। কিন্তু বাবা বলল, পাক সেনারা হলে এত আস্তে টোকা মারত না। যাই খুলে দেখি।


মা বললেন, এই দুর্যোগের রাতে আর কে আসবে ওরা ছাড়া? ক্ষীণ কণ্ঠে শোনা গেল , শামছু ভাই, দরজা খোলেন!


সবাই বুঝতে পারল, পাশের বাসার ভদ্রলোক। আব্বা গিয়ে সাবধানে দরজা খুললেন। খুলেই জিজ্ঞেস করলেন, এভাবে হামলার মানে কী। শেখ সাহেবের খবর কি! তিনি কী বলছেন, জানেন কিছু?


তিনি জানালেন, শেখ সাহেব অ্যারেস্ট হয়েছেন। কোথায় আছেন কিচ্ছু জানা যাচ্ছে না। এখন আমাদেরও এই কোয়ার্টারে থাকা আর নিরাপদ না। কিন্তু এখান থেকে বেরোনো তো সম্ভব না। পাক সেনারা দখল নিয়ে নিয়েছে। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে না। কোয়ার্টারের বাকীরা সব পালিয়েছে। আমরা চারতলার এই দুই ফ্যামিলি ছাড়া আর কেউ নেই।


অনেক কথাবার্তার পর সবাই ঠিক করল, নিচ তলা পর্যন্ত গিয়ে সেখানকার কোনো ফ্ল্যাটের তালা ভেঙ্গে বাসায় ঢুকে বারান্দা টপকে কোয়ার্টারের পেছন দিয়ে তারের বেড়া পার হয়ে চামেলীবাগে চলে যেতে হবে। কাজটা খুব সহজ না, খুব সাবধানে করতে হবে।


দুই পরিবারে তের সদস্য। কোনোভাবে টের পেলে জান শেষ। আব্বা বাধ সাধলেন, ধরা পড়লে একেক জনকে একেক দিকে নিয়ে যাবে। তারচেয়ে সবাই একসাথে বাসায় বসেই মরি!


সবার পীড়াপীড়িতে রাজি হলেন। এরই মধ্যে আম্মা সুরা ইয়াসিন পড়তে পড়তে জিভ শুকিয়ে ফেলছেন।


পুরো কাজটাই সম্পন্ন হয়ে গেল। সবাই এক এক করে পার হয়ে চামেলীবাগের দিকে হাঁটলেন। কিন্তু বেশিদূর যাওয়া গেল না। একটি দোতলা বাড়িতে তারা আশ্রয় চাইলেন। কিন্তু পুলিশ পরিচয় পেয়ে কেউ আশ্রয় দিতে রাজি হলেন না।


পুলিশ প্রতিরোধ গড়ে তোলায় রাজারবাগের দখল নিতে বেগ পেতে হয়েছে। তাদের অনেকেই মারা গেছে এই লড়াইয়ে্। তাই পুলিশের ওপর খুব নাখোশ পাক সেনারা। পুলিশকে আশ্রয় দিলে আশ্রয়দাতার বিপদ হবে - সেকথা বার বার বললেন সবাই। হঠাৎ আব্বা বললেন, মারতে চা্ইলে নিজ হাতে আপনারাই মারেন, তবু ওদের হাতে তুলে দিয়েন না।


একথা শুনে বাড়ির মালিকের মন গললো। ‘সকালেই বেরিয়ে যেতে হবে’ এই শর্তে আশ্রয় দিলেন। কিন্তু আশ্রয়দাতার এমন কর্কশ ব্যবহারে পাশের বাড়ির ভদ্রলোক রেগে চলে গেলেন। আশ্রয় নিলেন না এখানে। যাবার আগে কথাও শুনিয়ে গেলেন সেই ভদ্রলোক, পুলিশ তো এই দেশের প্রয়োজনেই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। নিজেদের প্রাণ দিয়েছে। আর আপনারা পাবলিক জায়গা দিতে চাচ্ছেন না। দেশটা স্বাধীন হোক। হিসাব বুঝে নেব।


বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক ঠোঁট ওল্টালেন, দেশ আর স্বাধীন হবে!


লোকটার তাচ্ছিল্যভরা চেহারা আজও মনে পড়ে রেহানার। ৪৫ বছর ধরে মনে আছে সেই চেহারা। সেই অভিব্যক্তি!


১০ বছরের রেহানা আজ ষাট ছুঁই ছুঁই। এখনো স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে সেই রাতের ঘটনা, উৎকণ্ঠা, ভয়। আর সবশেষ তাচ্ছিল্যভরা উক্তি!


সন্দিহান, দ্বিধাগ্রস্ত সেই লোকের চ্যালেঞ্জের বিপরীতে মহান স্বাধীনতা অর্জন। বিজয়ীর গর্ব! কিন্তু সেই লোকটিকে জীবনে দ্বিতীয়বার আর দেখা হয়নি। এখনো মন খুঁজে বেড়ায় তাচ্ছিল্যভরা সেই মুখটি। একবার লোকটির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে, ‘জয় বাংলা!’


লেখক : গৃহিণী


বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com