১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তেজোদৃপ্ত ভাষণ বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার তাগিদ দিয়েছিল; বুকে দিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার সাহস।
সশস্ত্র যুদ্ধের শুরু ২৫ মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনির আক্রমণ রুখে দিয়ে। একাত্তরের ২৬ মার্চ অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে বাঙালি চুড়ান্ত যুদ্ধ-ঘোষণা করে। মানবতাবাদী বিশ্ব বাঙালির মুক্তির লড়াইয়ে অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখে।
দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ প্রাণ এবং দু লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা আসে। বিশ্বমানচিত্রে জন্ম হয় নতুন রাষ্ট্রের।
মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসে থাকা বাঙালিরাও সমানভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এসময় সব থেকে বেশি প্রবাসী বাঙালি ছিল যুক্তরাজ্যে। আমেরিকা, কানাডা, ইন্দোনেশিয়াতেও কিছু প্রবাসী বাঙালি ছিল। সংখ্যায় কম হলেও আমেরিকাপ্রবাসী বাঙালিরা বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা, কানাডা প্রবাসী বাঙালিরা কানাডা অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া প্রবাসীরা আমরা ইত্যাদি নানা সংঘ গড়ে তোলে। যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বাঙালিরা ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট, বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ফ্রন্ট নামে নানান সংঘ গঠনের মাধ্যমে একত্রিত হয়। সবার একমাত্র লক্ষ্য ছিল প্রবাসী বাংলাদেশিদের একই ছাতার নিচে এনে মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করা।
যুক্তরাজ্যপ্রবাসী অনেক বাঙালি সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন বলে মনস্থির করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ওসমানীর কাছে যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের অনুমতি চেয়ে চিঠি লিখেন। ওসমানী তাদের চিঠির উত্তরও দেন। তিনি প্রবাসীদের সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করেন এবং বাংলাদেশের জন্য সারা পৃথিবীতে জনমত গড়ার প্রতি আহবান রাখেন।
তিনি উল্লেখ করেন যে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণের চাইতে তাদের অর্জিত অর্থ দিয়ে সঠিকভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করতে সহায়তাই এখন সব থেকে কার্যকর হবে।
কর্নেল (পরে জেনারেল) ওসমানীর এই জবাব পেয়ে প্রবাসী বাঙালিরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে মনস্থির করেন এবং বাংলাদেশের জন্য ফান্ড সংগ্রহে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে শুরু করে। সরকারি হিসেবমতে প্রবাসী বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রায় ৪,১২,০৮৩,২৬ পাউন্ড সংগ্রহ করে বাংলাদেশ ফান্ডে জমা করেন। আর বেসরকারি হিসেবমতে প্রায় ১৫ লাখ পাউন্ড প্রবাসীরা বাংলাদেশের ফান্ডে জমা করেন।
এছাড়া প্রবাসীরা কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স, ওষুধ, জামা-কাপড়, হাসপাতালের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ইত্যাদি অনেক প্রয়োজনীয় সাহায্য দেন। প্রবাসীদের সাহায্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উন্নত অস্ত্র ও খাদ্য সরবরাহ করা হয়। এতে মুক্তিযোদ্ধারা দারুণ সঞ্জীবনী শক্তি লাভ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ হয়ে ওঠে দুর্বার।
মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের অবদান এখানেই শেষ নয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বাঙালিরা তাদের তাদের গাড়িতে পাকিস্তানবিরোধী বিভিন্ন প্লাকার্ড লাগিয়ে যুক্তরাজ্য থেকে সুদূর প্যারিসে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সাধারণ সভার উদ্দেশে যাত্রা করে। গাড়ি শোভাযাত্রার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ এবং ধর্ষণ, গৃহ পোড়ানো, সম্পদ লুণ্ঠন ইত্যাদি চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন করা।
এতে কাজ হয়। বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ না করা পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সংস্থাটি পাকিস্তানের উপর সকল সাহায্য তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
এভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অনেক বাঙালি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকলেও তাদের আত্মা ছিল অভিন্ন। তাই প্রবাসী বাঙালিরা খাদ্য, ঔষধ, কাপড়, মেডিকেল সামগ্রী এবং কষ্টার্জিত অর্থ সহায়তা দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে যেভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন তা জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
আজ বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে বিনম্র চিত্তে স্মরণ করছি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সকল ভাই-বোনকে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি সেই সব প্রবাসী বাঙালির প্রতি, যাদের নানামুখী সহযোগিতায় পাকিস্তানিদের পরাজিত করে আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]