শিরোনাম
ইন্টারনেটের দাম কমলে ই-কমার্সের প্রচলন বাড়বে
প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০১৬, ১৮:৫৯
ইন্টারনেটের দাম কমলে ই-কমার্সের প্রচলন বাড়বে
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

সময়ের সাথে সাথে সম্প্রসারিত হচ্ছে আমাদের অনলাইন কাভারেজ। অনলাইনের প্রসার যত বাড়ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে অনলাইনে ব্যবসার নানান সুযোগ। বর্তমানে অনলাইনের বাজারে পরিচিত হয়ে ওঠা এই ব্যবসার নাম ই-কমার্স।


বিডিজবসডটকমের চেয়ারম্যান ও আজকেরডিলডটকমের প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর মতে বর্তমানে দেশে ই-কমার্স একটি বিকাশমান খাত। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বিশাল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে খাতটি নিয়ে। কেননা এই সেক্টরে কাজ করার জন্য দেশের অনেক উদ্যোক্তা এগিয়ে আসছেন। এছাড়াও বিশ্বের বড় বড় মার্কেটপ্লেসগুলো দেশে আসতে শুরু করেছে। দেশীয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগ আসতে শুরু করেছে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল (ভিসি) থেকে।


সম্ভাবনাময় এই খাতটির শুরু থেকে বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও নানান বিষয় নিয়ে সম্প্রতি বিবার্তা২৪.নেটের প্রতিবেদকের সাথে আলাপ করেন ই-কমার্স ব্যবসায়ী ফাহিম মাশরুর। তার সাথে দীর্ঘ আলাপের কিছু চুম্বক অংশ বিবার্তার পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন প্রতিবেদক উজ্জ্বল এ গমেজ


বিবার্তা : দেশে ই-কমার্স ব্যবসার বিপ্লবটা আসে কীভাবে?


ফাহিম মাশরুর : ই-কমার্স ব্যবসাটা ইন্টারনেট সম্পর্কিত। বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছরে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ই-কমার্স এখন বাংলাদেশে সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠছে। শুরুর দিকে ইন্টারনেটের ব্যবহারটা শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক ছিল। ধীরে ধীরে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।


আশার কথা হলো, বর্তমানে এই সেক্টরে কাজ করার জন্য আমাদের অনেক উদ্যোক্তা এগিয়ে আসছেন। তবে উন্নত দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ ক্ষেত্রে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। আমেরিকায় যেমন অ্যামাজন ই-কমার্সকে পরিচালনা করেছে। আমাদের দেশে ই-কমার্সের শুরুটা তেমন কোনো বড় কম্পানি করেনি। ছোট উদ্যোক্তারা ফেসবুকে তাদের উদ্যোগগুলোর প্রচার দিয়েই শুরু করেন অনলাইন বিজনেস। ফেসবুকের মাধ্যমে ই-কমার্স ব্যবসা করাটা অনেকটা চ্যালেঞ্জিং। আগে একজন উদ্যোক্তা তার ফেসবুকের ফ্যানপেজের মাধ্যমে খুব সহজেই প্রোডাক্ট প্রোমোট করতে পারতো। এখন তা একটু কঠিন। তবে আমরা যে বেশি দূর এগিয়েছি তা না। মোটামুটি এই ব্যবসার প্লাটফর্ম তৈরি করতে পেরেছি।



বিবার্তা : কোন মাধ্যমে বর্তমানে বেশি ই-কমার্স সম্পন্ন হচ্ছে?


ফাহিম মাশরুর : বেশিরভা্গ ই-কমার্স সাইটই তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইট থেকে এই ব্যবসা পরিচালনা করছে। অনেকে আবার ফেসবুককেও ব্যবসার প্ল্যাটপর্ম হিসেবে ব্যবহার করছে। তবে বেশির ভাগ গ্রাহক ফেসবুকে বিজ্ঞাপন এবং সাইটে পণ্য দেখে ফোনেই অর্ডার দেন।


বিবার্তা : দেশের ই-কমার্সের বর্তমান অবস্থা কেমন ?


ফাহিম মাশরুর : বর্তমানে দেশে চার থেকে পাঁচ হাজার উদ্যোক্তা ই-কমার্স ব্যবসায় জড়িত আছেন। তাদের বেশির ভাগই ছোট উদ্যোক্তা। কেউ বাসা থেকে করে, কেউ দোকান থেকে আবার কেউ কোনো অফিস ভাড়া নিয়ে বড় আকারে কর্মীদের নিয়ে কাজ করছে।


বর্তমানে আমাদের দেশে প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজারের মতো ট্রানজেকশন হয়। এই সংখ্যা খুবই কম। প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ লাখ ট্রানজেকশন হয়। সে হিসেবে আমাদের দেশে প্রতিদিন প্রায় কমপক্ষে এক থেকে দুই লাখ ট্রানজেকশন হওয়া উচিত ছিল। এ দিক থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের ট্রানজেকশনের পরিমাণ আরো বাড়বে। তবে এই বাড়ার পেছনে কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে।


বিবার্তা : প্রতিবন্ধকতাগুলো কী কী?


ফাহিম মাশরুর : আমার মতে এই মার্কেটটা ছোট হয়ে আছে দুটি কারণে। একটা হলো আমাদের দেশের ইন্টারনেটের দাম বেশি। কোনো কোনো অঞ্চলে এখনো ইন্টারনেট পৌঁছেনি। ঢাকার একজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী যেভাবে সহজেই ব্রডব্যান্ড ব্যবহার করতে পারে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তা করা সম্ভব না। তারা মোবাইলের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। সেটা অনেক ব্যয়বহুল। আর ই-কমার্স সাইটগুলোতে সব পণ্যেরই বেশি রেজুলেশনের ছবি দেয়া থাকে। এগুলো ফেসবুক বা নিউজ সাইটগুলোর মতো না। এগুলো দেখতে ইন্টারনেট ডেটা বেশি খরচ হয়।


আর দ্বিতীয়টা হলো ঢাকার বাইরে প্রোডাক্টগুলো পৌঁছানো কঠিন। ঢাকার মধ্যে যে কোনো পণ্য পৌঁছে দেয়া অনেক সহজ, কিন্তু বাইরে সেটি অনেক চ্যালেঞ্জের। এক্ষেত্রে আমাদের যেসব ই-কমার্স কম্পানি আছে তারা সাধারণত এসএ পরিবহন, করতোয়া, সুন্দরবন পরিবহনের মাধ্যমে পণ্য পাঠায়। কাস্টমারকে সেখান থেকে নিয়ে নিতে হয়। এটা অনেক কাস্টমারের জন্য সমস্যা হয়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায় কাস্টমাররা ঠিক সময়ে পণ্যটা বুঝে নেয় না। সেটা আবার উদ্যোক্তার জন্য বড় সমস্যা হয় দাঁড়ায়।



অমাদের ই-কমার্স সাইট আজকেরডিলডটকমে প্রোডাক্টের প্রায় ৬০% অর্ডার আসে ঢাকার বাইরে থেকে। কারণ হলো ঢাকায় যারা থাকে তাদের অনেকগুলো অপশন আছে। যেমন, নিউমার্কেট, বসুন্ধরাসিটি, সিজনপয়েন্টসহ অসংখ্য শপিংমল। কিন্তু ঢাকার বাইরে তো এতো অপশন নাই। তারা যদি ভাল মানের জিনিস কিনতে চায় তাহলে লোকাল মার্কেটে তো পাওয়া যায় না।


আমার মনে হয়, দেশে ইন্টারনেটের দামটা যত কমবে তত বেশি ই-কমার্সের প্রচলনটা বাড়বে। আর মানুষও তখন ই-কমার্স সাইট থেকে সহজে পণ্য কিনতে পারবে। আর বাংলাদেশের সর্বত্র ই-কমার্সকে ছড়িয়ে দিতে হলে যে জিনিসটি এখন সবচেয়ে দরকারি তা হচ্ছে, ই-কমার্সের উন্নত জ্ঞানসম্পন্ন উদ্যোক্তা তৈরি করা।


বিবার্তা : ই-কমার্স ব্যবসায় কারো কারো বিরুদ্ধে ধোঁকাবাজির অভিযোগও উঠছে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?


ফাহিম মাশরুর : দেশে যে কোনো ব্যবসাই ‍যখন শুরু হয় তখন ওখানে কিছু কিছু সুযোগসন্ধানী থাকে। সেটা আমরা আউটসোর্সিং ও ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রেও দেখেছি। অন্যান্য ব্যবসায় তো আমরা রেগুলারই দেখি। যেহেতু এটা নতুন এবং প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসা, তাই এখানেও থাকাটাই স্বাভাবিক। নতুন ব্যবসা হিসেবে লোকজনেরও সচেতনতার অভাব আছে। আবার কেউ কেউ এর অপব্যবহারও করে। আমাদের যে চার থেকে পাঁচ হাজার উদ্যোক্তা আছেন তাদের মধ্যে সবাই যে সৎ, তা তো না। এদের অনেকেই ভুঁইফোড় টাইপের। অনেকেই হয়তো মানুষকে ঠকানোর জন্যই এই ই-কমার্সকে পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে।


এই জিনিসটা একটু হয়তো থাকবেই। কিন্তু এটাকে যতটা না আইন দিয়ে মোকাবেলা করা যাবে, এর চেয়ে বেশি করে মানুষের সচেতন হতে হবে। আজকে কেউ যদি ফেসবুকে পেজ খুলে কোনো প্রতারণার ব্যবসা শুরু করলো তাকে তো আর আইন দিয়ে ঠেকানো যাবে না। এ ক্ষেত্রে মানুষের সচেতনতার কোনো বিকল্প নাই। মানুষ যেন ফেসবুকে কোনো বিজ্ঞাপন দেখে হুট করে অর্ডার না দেয়। আগে সাইটটা দেখতে হবে, এ সম্পর্কে জানতে হবে, বুঝতে হবে। যে কোনো সাইট থেকে পণ্য অর্ডার দেয়ার আগে দেখতে হবে সাইটটা কত দিন থেকে মার্কেটে কাজ করছে, কি কাজ করছে, আসলে বিশ্বাসযোগ্য কিনা, এগুলো সব দেখে পণ্য অর্ডার দিতে হবে। তাহলেই আর ধোঁকার কবলে পড়তে হবে না।



বিবার্তা : ই-কমার্স ব্যবসার চ্যালেঞ্জগুলো কি?


ফাহিম মাশরুর : একটি ই-কমার্স সাইট বা ফেসবুক পেজ খোলা অনেক সহজ। কিন্তু ব্যবসা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা বা ব্র্যান্ড তৈরি করা অনেক চ্যালেঞ্জিং। একটি ই-কমার্স কোম্পানি একজন ক্রেতাকে কিভাবে আনলো এবং তাকে ধরে রাখতে পারলো কি না এটা হচ্ছে মূল বিষয়। এটাই বড় চ্যালেঞ্জ। কখন সে ধরে রাখতে পারবে? ক্রেতার অর্ডারের পরে যদি তার অভিজ্ঞতা ভালো হয় তাহলে সে আপনার কাছ থেকে আরও আরও পণ্য নেবে। এজন্য ই-কমার্সের ক্ষেত্রে কাস্টমার আনার চাইতেও ধরে রাখাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।


বিবার্তা : ই-কমার্স ব্যবসায় নীতিমালার প্রয়োজন আছে কি?


ফাহিম মাশরুর : আমি মনে করি সরকারের পলিসি থাকা দরকার। যে কোনো ব্যবসায় নীতিমালা থাকলে সরকার ওই সেক্টরকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে পারে। নীতিমালার মাধ্যমে এই সেক্টরকে সরকার কীভাবে সাহায্য করবে তার একটা রোডম্যাপ পাবে। আমরা চাই, আয়কর ও ভ্যাট পলিসি। আরেকটি হলো ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদের জন্য ট্যাক্স পলিসি। বাংলাদেশে ‘ফরেন ইনভেস্টমেন্ট ইন ই-কমার্স’ -এর কোনো পলিসি নেই, যেমনটি ভারত ও ইন্দোনেশিয়ায় আছে। এজন্য ভারতে একটা কম্পানি এসেই সারাদেশের মার্কেট দখল করে ফেলতে পারে না। এক্ষেত্রে সরকার যদি ডাকবিভাগকে কাজে লাগাতে পারে তাহলে তারা এখান থেকেই লাভ করতে পারে। ই-কমার্সের পণ্য ডেলিভারির সেবা দিয়ে তারা মুনাফা করুক, সমস্যা নেই।


বিবার্তা: ই-কমার্সে যে ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা আসছে, এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?


ফাহিম মাশরুর : ভারত যে ই-কমার্সে এতো সাফল্য পাচ্ছে এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে ভেঞ্চার ক্যাপিটালের। ভারতের ই-কমার্সে বিনিয়োগের প্রায় ৯০ শতাংশই ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদের টাকা। টাইগার গ্লোবাল, সফট ব্যাংক এখন আলিবাবা ভেঞ্চার ফান্ড নিয়ে আসছে দেশটিতে। এরা সবাই বিশ্বের ই-কমার্সের বাজার তৈরিতে বিনিয়োগ করছে। আমাদের দেশেও ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা আসছে, তবে তাদের সংখ্যা অনেক কম। যত বেশি আসবে, দেশের ই-কমার্স ব্যবসাও তত বেশি বাড়বে।



বিবার্তা : নবগঠিত বাংলাদেশ অ্যালাইয়েন্স ফর ফেয়ার কম্পিটিশনের (বাফকম) ভূমিকা নিয়ে কিছু বলুন।


ফাহিম মাশরুর : দেশে সামগ্রিক প্রতিযোগিতামূলক বাজার গড়ে তুলে স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিযোগিতার সুযোগ তৈরি এবং সকল খাতে বৈষম্যহীন উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ অ্যালাইয়েন্স ফর ফেয়ার কম্পিটিশন (বাফকম) নামের নতুন অলাভজনক জোট যাত্রা শুরু করেছে। এই জোটটি সকল খাতের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করবে।


আমাদের দেশে অনেক মাল্টিন্যাশনাল কম্পানি, টেলিকম কম্পানি এবং এধরনের আরো কম্পানি আছে যারা দেশের মধ্যে আনফেয়ার বিজনেস প্র্যাক্টিস করছে। এগুলো অনেক ক্ষেত্রে বেআইনি। টেলিকম অ্যাক্ট নামে একটা আইন আছে। ২০১২ সালে কম্পিটিশন অ্যাক্ট নামে একটা টেলিকম আইন তৈরি হয়েছে। তাদের অনেকগুলো অ্যাক্টিভিটি এই আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা মনে করি যে এই সমস্ত কম্পানি মনোপলি হয়ে যাচ্ছে। তারা অনেক কিছুই কন্ট্রোল করছে। এখন তারা যেমন দেশের নেটওয়ার্ক কন্ট্রোল করে, ইন্টারনেটের দাম কন্ট্রোল করে। কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো কম্পিটিশন না থাকায় দাম কমছে না। সম্প্রতি তারা আবার ই-কমার্সে, ডিজিটাল সার্ভিসে ও কনটেন্টে চলে আসছে। এতে ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের কাজ করা অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এই বিষয়ে সবাইকে যাতে সচেতন করা যায়, এজন্যই মূলত বাফকমের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এছাড়াও সরকারকে এক ধরনের প্রেসার দিতে বা গাইডেন্স দিতে, যাতে এ সকল বেআইনি কাজকর্মের বিরুদ্ধে সরকার সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারে।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/মৌসুমী/হুমায়ুন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com