শিরোনাম
নারী পুলিশ বনাম বর্তমান পুলিশের ইলিশকাহন
প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০১৬, ১৬:১০
নারী পুলিশ বনাম বর্তমান পুলিশের ইলিশকাহন
মোমিন মেহেদী
প্রিন্ট অ-অ+

নারী পুলিশ নির্যাতন হয়; ধর্ষিত হয় জানা
এসব জানি করতে আছে ধর্ম-আইনে মানা
তবু কেন নারীর সাথে চলবে হেন কাজ
নারীবান্ধব বাংলাদেশ খুব প্রয়োজন আজ
তাই তো চলুন নতুনধারায় লড়ে লড়ে যাই
কারন সবাই মা-বোনদের নিরাপত্তা চাই
নিরাপত্তা নিজে দেবো, দেবে সকল লোক
এমন করেই সকল নারী সম্মানিত হোক...


যখন সারাদেশে শান্তি-উন্নয়ন আর রাজনীতির নামে অপরাজনীতির চরম অবস্থা, তখন পত্রিকার পাতায় নির্মম সংবাদ শিরোনাম উঠে আসে ঠিক এভাবে ‘যৌন হয়রানির শিকার ১০ ভাগ নারী।’


কনস্টেবলসি এইচআরআইয়ের গবেষণা অনুযায়ী আমাদের নারী পুলিশ কনস্টেবলদের ১০ ভাগেরও বেশি সদস্য যৌন হয়রানির শিকার হন। পুলিশ বিভাগে কর্মরত নারী কর্মকর্তাদের (উপপরিদর্শক ও সহকারী উপপরিদর্শক) শতকরা তিন ভাগ এ ধরনের ঘটনার শিকার হন। ক্যাডার পর্যায়ের নারী পুলিশরাও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বাইরে নন।


এই পরিস্থিতিতে তাদের জন্য নতুন প্রজন্মের প্রতিটি প্রতিনিধিদের প্রয়োজন নিজেদের অবস্থান থেকে প্রতিবাদ জানানো। এই প্রতিবাদের ভাষা সংবাদপত্রের পাতায় উঠে আসতে পারে, রাজপথে মানববন্ধনের মধ্য দিয়ে-প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়েও প্রতিবাদের কথা উঠে আসতে পারে। তা না হলে এখন যেমন পত্রিকার পাতায় শিরোনাম হয়েছে, ঠিক একইভাবে বেড়েই যাবে ভয়াবহ দুর্নীতি-অন্যায়।


এখন যেমন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে ৬ বছরে ৭৬ হাজার ৪২৬ জনকে বিভিন্ন ধরনের শাস্তির কথা উঠে এসেছে। অপরাধ দমনে উপায় খুঁজছেন পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা, এমন কথাও উঠে এসেছে। পেশাদার অপরাধীদের মতো নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়া পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও সদস্যদের নিয়ে চরম বিপাকে পড়া পুলিশ বাহিনীর অসংখ্য অপরাধের রাস্তায় এগিয়ে যেতে যেতে তারা এখন নারী পুলিশ নির্যাতনের যে জঘন্যতায় অগ্রসর হচ্ছে, তা সত্যিই হুমকি স্বরুপ। তথাকথিত অপরাধের ধরন অনুযায়ী জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও থামছে না তাদের অপরাধ।


সর্বশেষ ১৮ নভেম্বর রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেল মোড়ে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা ছিনিয়ে নেয়ার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েন ট্রাফিক পুলিশের এক কনস্টেবল। ছিনতাইয়ে জড়িত আরেক কনস্টেবলকে পরে উত্তরা থেকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনা পুলিশ প্রশাসনে ছড়িয়ে পড়লে সবাই হতবাক হয়ে যান। কেমন করে সুশৃঙ্খল এ বাহিনীর সদস্যরা দিনের বেলা প্রকাশ্যে এ ধরনের অপরাধ করার সাহস পায় সে প্রশ্নও তোলেন তারা। ছিনতাইয়ে জড়িত পুলিশের দুই সদস্যকে ওইদিনই বরখাস্ত করা হয়।


প্রতিদিন অসংখ্য অপরাধের রাস্তায় এগিয়ে যেতে যেতে ১৩ নভেম্বর পুলিশ হেফাজত থেকে আসামি রুবেলকে পালাতে সহায়তার মত জঘন্য অন্যায় করেছে বাড্ডা থানার এসআই ইমরান উল হাসান ও এক কনস্টেবল। অবশ্য এ ঘটনায় তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। চলতি বছরেই মোহাম্মদপুরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাকে নির্যাতনের ঘটনায় এসআই মাসুদ শিকদারকে প্রত্যাহার করা হয়। পরকীয়ার কারণে এক সিএনজিচালকের পায়ে গুলি করে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় শেরেবাংলা থানার এসআই আনোয়ার হোসেনকে গ্রেফতার করলেও অন্যায় কিন্তু কমেনি। বরং লোকাল বাসে করে আদালত থেকে রিমান্ডের আসামি থানায় নিয়ে আসার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ আনা হয় মোহাম্মদপুর থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মশিউর রহমান, কনস্টেবল মোতালেব ও আবদুল লতিফের বিরুদ্ধে। পরে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় তিন পুলিশ সদস্যকে। তবে যাত্রাবাড়ী থানার ওসি থাকা অবস্থায় অবনি শংকরের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করে এক ভুক্তোভোগী নারী। এ ঘটনার পর তাকে ডিবিতে বদলি করা হয়। ওই মামলা খারিজ করে দেয়া হলেও বিভাগীয় মামলা থাকা অবস্থায় তাকে রংপুরের একটি থানায় ওসি হিসেবে বদলি করা হয়। একইভাবে উত্তরা পূর্ব থানার ওসির দায়িত্ব পালনকালে রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে বাসার ছাদ থেকে ফেলে এক সাংবাদিক হত্যার মত জঘন্য ঘটনাও ঘটেছে এই পুলিশ সদস্যদের দ্বারা।


বিভিন্ন অপরাধে শাস্তি পাওয়া পুলিশ সদস্যদের মধ্যে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চাকরিচ্যুত হয়েছেন ৬২৩ জন । এর মধ্যে ৬০৮ জন কনস্টেবল থেকে এসআই পদের পুলিশ কর্মকর্তা। বাকি ১৫ জনের মধ্যে ২ জন পুলিশ পরিদর্শক ও ১৩ জন এএসপি থেকে তর্দূর্ধ্ব পদের কর্মকর্তা। চাকরিচ্যুত হওয়া পুলিশদের মধ্যে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর তার পারিবারিক অবস্থা ও চাকরির মেয়াদ বিবেচনায় নিয়ে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে ৭২ জন পুলিশকে। এর মধ্যে ৬৮ জনই কনস্টেবল হতে এসআই পদের পুলিশ কর্মকর্তা। বাকি ৪ জনের মধ্যে ২ জন পুলিশ পরিদর্শক এবং ২ জন এএসপি থেকে তদূর্ধ্ব পদের কর্মকর্তা। এরপরও অন্যায় অপরাধের রাজত্ব থেকে তারা যেন বের হতে পারছে না। যা দেখে দেখে খইফোটা রোদ্দুরে যেন অন্ধকারের খেলা দেখতে পাচ্ছি নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে।


যদিও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত পুলিশের বিরুদ্ধে দুই ধরনের বিভাগীয় শাস্তির বিধান রয়েছে। এর একটি লঘুদণ্ড, অন্যটি গুরুদণ্ড বলেই আমরা জানি। কিন্তু কোনো পুলিশ সদস্য ফৌজদারি যে কোনো অপরাধ করলেই গুরুদণ্ড দেয়ার কথা থাকলেও তা থেকে রেহাই পেতে তারা দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছে। অন্যদিকে হুমকি দেয়া, ঘুষ নেয়া, চাকরি শৃঙ্খলাপরিপন্থী কাজ করা, দায়িত্বে অবহেলা করা, নির্দেশ অমান্য করা, ভিত্তিহীন বা তুচ্ছ বিষয়ে অভিযোগের জন্য ইতিমধ্যেই ব্যাপক নাম করেছে পুলিশ।


সারাদেশে ‘মাছের রাজা ইলিশ, দেশের রাজা পুলিশ’ বলে যে বাক্য প্রচলিত হয়েছে; সে বাক্যের সুবাদে পুলিশের নানারকম অন্যায় বেড়েই চলেছে। সেই অন্যায়ের দৌড় এতটাই বেশি হয়েছে যে, মিরপুরে ঝুট ব্যবসায়ী মাহাবুবুর রহমান সুজনকে থানা হেফাজতে হত্যার ঘটনায় ওই থানার এসআই জাহিদকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ ঘটনায় ওই ব্যবসায়ীর স্ত্রী মমতাজ সুলতানা বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে মামলাটি তুলে নিতে চাপ দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করে ভুক্তভোগী পরিবার।


আরেক ঘটনায় দেখা যায়, রাজধানীর আদাবর আশা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানি ও কুপ্রস্তাব দেয়ার ঘটনায় আদাবর থানার এসআই রতন কুমারকে প্রত্যাহার করা হয়। এসআই রতন বিষয়টি মীমাংসা করতে চাপ দিচ্ছে বলে জানান ওই শিক্ষার্থীর পরিবারকে।


একদিকে বাহিনীর বাইরে, অন্যদিকে বাহিনীর ভেতরে অন্যায়ের যে রাজত্ব তৈরি হয়েছে, সে রাজত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে তারা চায় না বলেই অহরহ চলছে অন্যায়ের চাষাবাদ।


সম্প্রতি ‘সমতার কঠিন পথে বাংলাদেশের নারী পুলিশ’ শীর্ষক এক গোল টেবিল বৈঠকে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভের (সিএইচআরআই) যৌথ উদ্যোগে গড়ে উঠেছে সত্য উচ্চারণ। সেই উচ্চাররণে নির্ভয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে পুলিশ বিভাগে নারী সদস্য ১১ হাজার ৩৮ জন। এটি পুলিশের মোট জনবলের ৫ দশমিক ৮৪ ভাগ। এখানে কর্মরত নারীরা মনে করেন, নারীদের কাজের জন্য পুলিশ বিভাগ একটি ভালো জায়গা। বেশির ভাগ নারী পুলিশ মনে করেন, পুলিশের পোশাক তাদের পুরুষের সমান ক্ষমতা দেয় এবং জনগণকে সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে তারা পুরুষ সহকর্মীদের সমান। এ ক্ষেত্রে তারা পরিবারের সমর্থনও পান।পুলিশের জ্যেষ্ঠ পদে নারীদের প্রতিনিধিত্ব কম হওয়ার পাশাপাশি নেতৃত্ব ও মাঠপর্যায়ের ব্যবহারিক ভূমিকা থেকে তাদের দূরে রাখা হয়। অনেক নারী পুলিশ যৌন হয়রানির শিকার হলেও অভিযোগ দায়ের হয় না। কারণ, নারী পুলিশ সদস্যদের সমস্যাগুলো সম্পর্কে পুরুষ কর্মকর্তারা সংবেদনশীল নন। সব মিলিয়ে আমাদের পুলিশ বিভাগের উচিত দ্রুত পূর্ণাঙ্গ জেন্ডার নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।


জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী হওয়ায় পুলিশ বিভাগেও নারীদের সমান প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে, এটা যেমন সত্য, তেমন সত্য তাদের সম্ভ্রম রক্ষায় আমাদের বর্তমান সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। গড়ে তুলতে হবে ভয়হীন নারীবান্ধব পুলিশ বাহিনী, গড়ে তুলতে হবে ভয়হীন নারীবান্ধব সমাজ ও দেশ। যেখানে নিরাপদ আর নিরাপত্তায় আমাদের প্রতিটি ভোর আসবে বয়ে চলা নদীর মত অবিরত...


লেখক : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ-এনডিবি


বিবার্তা/ মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com