এক অভাবনীয় চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পর্কে সেদিন হঠাৎ করেই জানতে পারলাম আমার স্ত্রী ও ছোট মেয়ের সৌজন্যে। মেয়ে তার মায়ের সামান্য সমস্যার প্রতিকার খুঁজতে গিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবেই খোঁজ পেয়ে গেল এ চিকিৎসাবিদ্যার। ভাবলাম, কারো কারো হয়তো এ সম্পর্কে জানা থাকতেও পারে, আবার কেউ হয়তো আমার মতোই জানেন না। তাই ঠিক করলাম, সবাইকে জানিয়ে দেই, কারো যদি উপকারে আসে।
চিকিৎসাব্যবস্থাটিকে ‘অভাবনীয়’ বললাম এ কারণে যে, এটি আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা: তাঁর মাইগ্রেন, পায়ের ও পিঠের ব্যথার জন্য এ চিকিৎসাটি নিয়ে সুস্থ হয়েছিলেন। এ চিকিৎসাব্যবস্থাটির নাম ‘হিজামা’ (Hijama )। এটি একটি আরবি শব্দ। অর্থ হলো ‘টেনে নেয়া’ (To Suck)। শরীরের বিভিন্ন নির্দিষ্ট অংশ থেকে জমাট বাঁধা রক্তকে ছোট্ট বায়ুশূন্য কাপ দিয়ে ‘vacuum sucking’, অর্থাৎ বিঃ wet cupping করে শরীর থেকে বের করে নেয়া হয় বলে এ ব্যবস্থার নাম ‘টেনে নেয়া’ বা হিজামা।
হিজামার সাহায্যে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন, রক্তসঞ্চালনজনিত সমস্যা, বিভিন্ন ধরনের ব্যথা, বন্ধ্যত্ব, ইনফেকশন, ডায়াবেটিসসহ নানা জটিল রোগের চিকিৎসা হয়। চীনে তাদের মতো করে অনেকটা আকুপাংচার ধাঁচে এ চিকিৎসার প্রচলন রয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এটি শুধুই একটি চিকিৎসাব্যবস্থা হিসেবে প্রচলিত থাকলেও মুসলমানদের কাছে এর ভিন্ন তাৎপর্য রয়েছে।মুসলমানেরা একে রোগ নিরাময়ের পাশাপাশি রাসূল সা: নির্দেশিত সুন্নাহর অংশ হিসেবে চর্চা করে থাকে।
বুখারি শরিফের বর্ণনা অনুসারে, নবী করিম সা: তাঁর মাইগ্রেন ব্যথার জন্য মাথায় হিজামা নিয়েছিলেন। এ ছাড়া আবু দাউদে বর্ণিত আছে, তিনি ঘাড়ে ও শরীরের নিচের অংশে ব্যথার জন্যও হিজামা চিকিৎসা নিয়েছিলেন। বিভিন্ন হাদিসে এর তাৎপর্য তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, মুসলিম শরিফে বর্ণিত হাদিস অনুসারে হিজামা গ্রহণে রোগমুক্তি ঘটে। আবার সহি বুখারি শরিফে আছে, হিজামা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসা এবং মানবজাতির জন্য এটি সবচেয়ে সফল চিকিৎসাব্যবস্থা। হজরত আবু হুরায়রা রা:-এর বর্ণনা মতে, নবীজী সা: বলেছিলেন, হিজামা একটি চমৎকার চিকিৎসাব্যবস্থা (আবু দাউদ)। হিজামা এতই উপকারী চিকিৎসা যে, শবে মেরাজে ঊর্ধ্বাকাশে হজরত জিব্রাইল আ: রাসূলে করিম সা:কে বলেছিলেন, হে মুহাম্মদ সা:, আপনি আপনার উম্মতদের অসুস্থতায় হিজামা চিকিৎসা নিতে বলুন (তিরমিজি)।
চিকিৎসাবিদ্যাটি বেশ প্রাচীন। আরবি নাম ‘হিজামা’ হলেও সেই আদিযুগ থেকে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরা বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য এ ব্যবস্থাটি ব্যবহার করে আসছেন। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, ইউরোপের প্রখ্যাত গ্রিক চিকিৎসক গ্যালেন (১৩১-২০০ খ্রি:), প্যারাসেলসাস (১৪৯৩-১৫৪১ খ্রি:) এবং অ্যামব্রয়েস প্যারে (১৫০৯-১৫৯০ খ্রি:) রোগীদের এ চিকিৎসাব্যবস্থা দিতেন। পারস্য অঞ্চলের চিকিৎসকেরাও এ ব্যবস্থা দিতেন।
কেউ হয়তো বলতে পারেন, রাসূলে করিম সা:-এরও চার-পাঁচ শ’ বছর আগে তো গ্রিসে হিজামা ব্যবহৃত হয়েছে, তাহলে তাঁর এ চিকিৎসা গ্রহণে নতুনত্ব কী আছে? আসলে আল্লাহ তায়ালা তো শুধু মুসলিম দেশ আর মুসলমানদেরই সৃষ্টি করেননি। তিনি জগৎস্রষ্টা। এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড (কুল মাখলুকাত) এবং পুরো মানবজাতিকেই তিনি সৃষ্টি করেছেন - সে মুসলিম হোক আর অমুসলিম হোক। তা ছাড়া রাসূলে করিম সা:-এর আগেও অসংখ্য নবী ও বহু আসমানি কিতাব তিনি প্রেরণ করেছেন। সেসব নবী ও কিতাবের অনুসারীসহ মুসলিম-অমুসলিম সব মানুষেরই সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর ব্যবস্থা ভোগ-উপভোগ করার সমান অধিকার আল্লাহ সবাইকেই দিয়ে থাকেন। তাই এ চিকিৎসা সবার জন্য।
আমাদের প্রায় ৭০ শতাংশ রোগ বা শারীরিক সমস্যা শরীরে রক্তপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা থেকে সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও রক্তে নানা রকম দূষণ ও বিষক্রিয়া থেকেও বিভিন্ন রোগের উৎপত্তি ঘটে। বিভিন্ন রোগের জীবাণু শরীরের বিভিন্ন নির্দিষ্ট অংশে রক্তকে নষ্ট করে দেয়। ফলে বিষাক্ত রক্ত সেসব স্থানে জমাট বেঁধে স্বাভাবিক রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত করে এবং বিভিন্ন রোগপ্রতিরোধী antibody-কেও নষ্ট করে দেয়। ফলে বাধাগ্রস্ত স্থানে তীব্র ব্যথা হয়। আবার antibody নষ্ট হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আর থাকে না। তাই বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। এ দূষণযুক্ত ও বিষাক্ত রক্ত না সরালে যে শুধু সংশ্লিষ্ট রোগগুলোই হয় তা নয়, এর প্রভাবে আরো নতুন নতুন রোগেরও উদ্ভব ঘটে। তাই হিজামা পদ্ধতিতে জমাটবাঁধা রক্ত টেনে নেয়া হয়।
তবে রক্ত পরীক্ষার জন্য আমাদের শরীর থেকে যেভাবে বিশুদ্ধ প্রবহমান রক্ত সিরিঞ্জ দিয়ে intravenously টেনে নেয়া হয়, এ ক্ষেত্রে তা নয়। এ চিকিৎসায় রোগ নিরাময় ও প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন হিজামা পয়েন্ট থেকে বিষাক্ত জমাট বাঁধা রক্তকে টেনে শরীর থেকে বের করে নেয়া হয়। আধুনিক চিকিৎসায় ব্যথা নিবারক ট্যাবলেট দিয়ে সাময়িক ব্যথা নিবারণ করা হয়। এর ক্রিয়াকাল শেষ হয়ে গেলে আবার ব্যথা শুরু হয় অথবা ওষুধ দিয়ে রোগজীবাণু নষ্ট করে রোগ নিরাময় করা হয়, যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও আছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে যা সুদূরপ্রসারী। কিন্তু হিজামা একটি প্রাকৃতিক প্রতিরোধমূলক (preventive) পদ্ধতি। বিষাক্ত রক্ত সরিয়ে নিলে antibody আবার সৃষ্টি হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আবার জন্মায়। তাই রোগ নিরাময় হয়ে যায় স্থায়ীভাবে। সুতরাং সাধারণ চিকিৎসায় যেখানে বাহ্যিক ওষুধ প্রয়োগে রোগ নিরাময় করা হয়, সেখানে হিজামা ব্যবস্থায় রোগের উৎসই নষ্ট করা হয়। এ ছাড়া আধুনিক চিকিৎসায় রক্ত পরীক্ষার জন্য intravenouslyরক্ত টেনে নিলে যে ব্যথা পাওয়া যায়, এ ক্ষেত্রে সে ব্যথাও হয় না। কারণ, হিজামা চিকিৎসায় ত্বকের ওপর সুচ দিয়ে ছোট ফোঁড় করে গরম কাপ চাপ দিয়ে উপুড় করে বসানো হয়। এতে vacuum সৃষ্টি হয় এবং জমাটবাঁধা রক্ত স্বাভাবিক নিয়মে বেরিয়ে কাপে জমা হয়। আর এ রক্ত বেরিয়ে যাওয়ায় ব্যথা উপশম হয়। এ ক্ষেত্রে রক্ত বেশি কম যাওয়ার সুযোগ নেই, কারণ জমাটবাঁধা রক্তটুকুই বের হয়ে যায়।
মাসের নির্দিষ্ট তারিখে ও সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে এ চিকিৎসা নিতে হয়। সাধারণত চান্দ্রমাসের বিজোড় দিন যেমন - ১৭, ১৯ ও ২১ তারিখ হতে হয়। এ তারিখগুলো আবার সপ্তাহের সোম, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবারে পড়তে হয়। আমাদের রাসূল সা: শুক্র, শনি ও রোববার এবং খুবই জোর দিয়ে বুধবার ‘হিজামা’ গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। খালি পেটে হিজামা গ্রহণ সবচেয়ে ভালো।
হিজামার জন্য প্রথমে শরীরের নির্দিষ্ট স্থান বাছাই করে নিতে হয়। যে জায়গায় হিজামা করা হয়, সে জায়গায় লোম থাকলে তা পরিষ্কার করে নিতে হয়। এর পর তেল (অলিভঅয়েল বা সুবিধাজনক অন্য তেল) মাখিয়ে জায়গাটি নরম করে নিতে হয়। ত্বকের ওপর খুব ছোট সুচের ফোঁড় দিতে হয়, যাতে রক্ত বেরোয়। এর ওপর উত্তপ্ত ছোট কাপ (যাতে বায়ু অপসারিত হয়ে ভ্যাকুয়াম তৈরি হয়) চেপে ধরলে রক্ত আসে। কয়েক মিনিট লাগে। রক্ত অপসারণের সময় তেমন কোনো ব্যথা পাওয়া যায় না। কিন্তু রক্তপ্রবাহের শক্তি বেশ বেড়ে যায়, শরীর অনেক হালকা ও সুস্থ বোধ হয়। মনে প্রশান্তি আসে।
হিজামা চিকিৎসায় একটাই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা হলো infection। আজকাল অবশ্য সে ভয়ও নেই। কারণ স্যাভলন বা ডেটল দিয়ে ত্বক পরিষ্কার করে নিলে এবং রক্ত বের করার পর anti infectious sticker seal লাগিয়ে দিলে আর ক্ষত হয় না। ‘হিজামা’ ব্যবস্থা রোগ চিকিৎসা ছাড়াও এটি একটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। অর্থাৎ অসুখ-বিসুখ না হলেও বছরে দু-একবার এ ব্যবস্থা নিলে এমনিতেই শরীর ভালো থাকে। হিজামা মানুষের সৃজনশীলতা, বুদ্ধিদীপ্ততা ও স্মরণশক্তিও বাড়ায়।
হিজামার গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে একটি খবর দিয়ে শেষ করছি। এবারের রিও অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করছেন পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদদের একজন মার্কিন সাঁতারু মাইকেল ফেলপস। বর্তমান বিশ্ব অলিম্পিকসহ পরপর চারটি অলিম্পিকে অংশ নিয়ে তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। এরপর আবার সর্বকালের সর্বোচ্চসংখ্যক স্বর্ণপদক জিতে তিনি এক অনতিক্রম্য রেকর্ডও স্থাপন করেছেন। তিনি এ পর্যন্ত ২৩টি স্বর্ণপদকসহ বেশ কয়েকটি রৌপ্য পদকও জিতে নিয়েছেন। বিশ্বক্রীড়ার এ মহানায়ক তার শরীরিক সক্ষমতা এবং ক্রীড়ানৈপুণ্যের সর্বোচ্চ উৎকর্ষ বজায় রাখার জন্য নিয়মিত হিজামা চিকিৎসা (পশ্চিমা বিশ্বে ‘কাপিং’নামে পরিচিত) নিয়ে থাকেন। এ সম্পর্কিত সচিত্র প্রতিবেদন বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড
E-mail: [email protected]
বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]