
আমাদের দেশে কোনো নির্বাচন হলেই পশ্চিমা, বিশেষ করে মার্কিন পর্যবেক্ষকের দল ছুটে আসেন, নির্বাচন শেষে তারা নির্বাচন কেমন হলো না হলো সে বিষয়ে ভালো-মন্দ সার্টিফিকেট দিয়ে যান। এতোদিন মোটামুটি এটাই রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল।
এই রেওয়াজের একটা বড় কারণ আমাদের দারিদ্র্য এবং কারণে-অকারণে ওদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা। এছাড়া আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিও ওদের কর্মকাণ্ডকে একরকম বৈধতা দেয়। আমাদের রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সংস্কৃতি অনেকাংশেই নানাবিধ নোংরামি ও দুর্বলতায় আকীর্ণ। কাদা ছোড়াছুড়ি, অশালীন বাক্যবাণ নিক্ষেপ, হামলা, নির্বাচনে কারচুপি এবং ফলাফল পক্ষে না গেলে তা মেনে না নেয়া ইত্যাদি।
অপ্রিয় হলেও এটাই বাস্তবতা। এসব থেকে আমরা এখনো পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারিনি। বিপরীতে পশ্চিমা নির্বাচন ছিল আদর্শস্থানীয়। আমাদের দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা ভাবতেন, আহা, আমাদের দেশে কবে এরকম নির্বাচন হবে!
আগামী মাসে অনুষ্ঠেয় মার্কিন নির্বাচনী প্রচারণার ধরণ-ধারণ দেখে মনে হচ্ছে, আমরা বুঝি সেই ভাবনার জায়গাটাও হারাতে বসেছি। দেখেশুনে এটা পরিষ্কার যে, তৃতীয় বিশ্ব এবং মার্কিন নির্বাচনী রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সংস্কৃতির মাঝে আজ আর কোনো ভেদ নাই।
লক্ষ্য করুন, প্রতিটি জাতীয় জনমত জরিপে নভেম্বরের নির্বাচনে ট্রাম্পের ভরাডুবির সব লক্ষণ যখন স্পষ্ট, তখন হিলারির সঙ্গে বুধবারের সর্বশেষ বিতর্কে ট্রাম্প আবারো বলে দিয়েছেন যে, পরাজিত হলে ফলাফল মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতি তিনি এখনই দেবেন না।
এর আগেও তিনি দাবি করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনব্যবস্থা দুর্নীতিতে ভরা। ফলাফল নাকি আগে থেকেই ঠিক করা আছে এবং হিলারি ক্লিনটনের হাতে জয় তুলে দিতে তথ্যমাধ্যম, করপোরেট আমেরিকা ও ওয়াল স্ট্রিট হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছে ।
ট্রাম্পের অভিযোগ সমর্থন করে তার সমর্থক অ্যালাবামার রিপাবলিকান সিনেটর জেফ সেশন্সও বলেন, নির্বাচনের ফলাফল উল্টে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
বোঝাই যায়, ট্রাম্পের এই বক্তব্য তার একনিষ্ঠ সমর্থকদের মধ্যে সাড়া জাগাতে পেরেছে। তারাও মনে করে নির্বাচনব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত। পলিটিকোর সর্বশেষ জাতীয় জরিপ অনুসারে, ৭৩ শতাংশ রিপাবলিকান মনে করে নির্বাচনের ফল ‘চুরি’ হতে পারে।
এ যেন তৃতীয় বিশ্বের কোনো নেতা ও তার অন্ধ ভক্তসমর্থকদের প্রতিচ্ছবি!
আরো শুনুন,ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার ক্রিস সিলিজা জানিয়েছেন, নির্বাচনে হারলে ট্রাম্প নতমস্তকে সরে দাঁড়াবেন এবং তাঁর উচ্চকণ্ঠ ও ষড়যন্ত্র-তত্ত্বে বিশ্বাসী সমর্থকেরা নীরবে প্রস্থান করবেন বলে মনে হয় না।
মনে পড়ে, ২০০০ সালে জর্জ বুশ ও আল গোরের মধ্যে ফ্লোরিডার কয়েকটি নির্বাচনী এলাকার প্রতিটি ভোট পুনর্গণনা নিয়ে এক মাসেরও বেশি সময় ব্যয় করতে হয়। তাতেও সে প্রশ্নের সুরাহা না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট ৫-৪ ভোটে জর্জ বুশকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। সমর্থকদের আপত্তি সত্ত্বেও আল গোর সে রায় মেনে নিয়েছিলেন। আর এখন অতি আশাবাদী ব্যক্তিরাও মনে করেন না যে, আল গোরের দেখানো সে পথ ট্রাম্প অনুসরণ করবেন।
আরো ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সালোন পত্রিকার বব সেসকা। তিনি জানিয়েছেন, ট্রাম্পের অনেক সমর্থক প্রয়োজন হলে অস্ত্র হাতে ট্রাম্পের পক্ষে লড়তে প্রস্তুত। তারই অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় তা্রা ডেমোক্রেটিক ভোটারদের ভয় দেখানো শুরু করেছে। তিনি জানিয়েছেন, গত সপ্তাহে ভার্জিনিয়ার পালমিরায় ডেমোক্রেটিক পার্টির একটি অফিসে একদল সশস্ত্র যুবককে পাহারা দিতে দেখা গেছে। ট্রাম্পের সমর্থক এই যুবকেরা বলে, অনেক রিপাবলিকান সমর্থক ভীত যে তাদের ভোট দিতে দেয়া হবে না। এসব লোককে সাহস জোগাতেই তারা টহল দিচ্ছে।
কী ভয়ঙ্কর ! ওই যুবকদল যা-ই বলুক, আকাট মূর্খও বুঝবে যে,এই টহলদারির আসল লক্ষ্য হলো ডেমোক্রেটিক পার্টির ভোটারদের মনে ভয় জাগানো এবং তাঁদের ভোট কেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত রাখা।
বিপরীত দিক থেকেও ঘটনা ঘটনা ঘটছে। যেমন, নর্থ ক্যারোলিনা অঙ্গরাজ্যের হিলসবরো শহরে রিপাবলিকান পার্টির একটি অফিসে 'বোমা' হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলায় রিপাবলিকান পার্টির অফিসটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যদিও হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
২.
পৃথিবী নামের এই ছোট গ্রহটি ক্রমেই দূষিত হচ্ছে - বায়ু দূষণ, মাটি দূষণ, পানি দূষণ ইত্যাদি কত রকমের দূষণ যে আমাদের প্রতি মুহূর্তে আক্রমণ করছে তার ইয়ত্তা নেই। এমনকী আলো দূষণও আছে। আলো দূষণের কারণে মানুষ নক্ষত্রখচিত রাতের আকাশ দেখতে পায় না।
এইসব ভয়াল দূষণের কারণে পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে, বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। এ তো গেলো পরিবেশ দূষণ। খুব নীরবে যে রাজনীতি দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী, তার কী হবে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই রাজনীতি দূষণের কবলে পড়া আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, পছন্দ হোক অথবা না-ই হোক, এই দেশটি বিশ্বের একক পরাশক্তি। এর সিদ্ধান্তে বিশ্ববাসীর অনেককিছু যায়-আসে।
এই পরাশক্তির ক্ষমতাকেন্দ্রের প্রধান ব্যক্তি হবেন ট্রাম্পের মতো একজন লোক, যিনি কোনোভাবেই পরাজয় মানতে নারাজ। এ তো ফ্যাসিবাদেরই নামান্তর!
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আমাদের অনেক আপত্তি আছে। কিন্তু ব্রিটেনের মতো এই দেশটিও, নানা ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও, গণতন্ত্রের এক ধরণের মডেল - সে কথা তো মানতেই হবে। এই মডেলে যখন দূষণ ও দুর্বৃত্তআয়ণের কালো ছায়া পড়ে, তখন চিন্তিত না হয়ে পারা যায় না।
৩.
হাঙ্গেরী না অন্য কোনো পূর্ব ইউরোপীয় দেশের এক অন্ধ নারী গণক নাকি বহুকাল আগে ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন, একজন কৃষ্ণ মানুষই হবেন আমেরিকার শেষ প্রেসিডেন্ট। তারপর নাকি আমেরিকাই থাকবে না।
ভবিষ্যতবাণীতে আমার আস্থা নেই। কিন্তু হালে যা ঘটছে তা দেখে-শুনে সভয়ে ভাবি, তবে কি ওই অন্ধ নারী গণকের ভবিষ্যতবাণীই সত্যি হতে চললো!
লেখক : সাংবাদিক
বিবার্তা/মৌসুমী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]