
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা উপেক্ষা করে স্পেশাল ক্লাসের নামে অতিরিক্ত ফি আদায়, শিক্ষার্থীদের সশরীরে কলেজে আসতে বাধ্য করা, ফরম ফিলাপের নির্দিষ্ট তারিখ নিয়ে গড়িমসিসহ অনেক অভিযোগ উঠেছে রাজধানীর ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজের বিরুদ্ধে।বোর্ডের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করা এই কলেজের বেপরোয়া আচরণে অতিষ্ঠ খোদ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলমান বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষার্থীদের সার্বিক দিক বিবেচনা করে বেশকিছু নির্দেশনা জারি করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড। এরমধ্যে করোনায় আটকে থাকা চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ সংক্রান্ত বিশেষ নির্দেশনা জারি করা হয়। এই নির্দেশনায় এইচএসসি পরীক্ষার নির্দিষ্ট ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার।
গত ৩১ জুলাই শিক্ষা বোর্ডের এক নির্দেশনায় বলা হয়, চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষার কোনো নির্বাচনী পরীক্ষা হবে না। এজন্য ফরম পূরণের ফি কমিয়ে বিজ্ঞান বিভাগের জন্য ১ হাজার ১৬০ এবং মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের জন্য ১ হাজার ৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
একই নির্দেশনায় অধিভুক্ত সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করে বলা হয়, রেজিস্ট্রেশন কার্ডে উল্লিখিত সেশন ১ জুলাই ২০১৯ থেকে ৩০ জুন ২০২১ পর্যন্ত এই ২৪ মাসের বাইরে বেতন/ফি বা অন্য কোন ফি আদায় করা যাবে না। এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য দৃষ্টিগোচর হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ফরম পূরণ প্যানেল তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করাসহ প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিবার্তায় আরো পড়ুন>>>শিক্ষাখাতে দুর্নীতি : অতিরিক্ত ফি আদায় করছে ড্যাফোডিল! (পর্ব-১)
শিক্ষা বোর্ডের এই নির্দেশনাকে সম্পূর্ণ বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে অভিযুক্ত ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজ নিজস্ব নিয়মনীতির দোহাই দিয়ে নিয়ম বহির্ভূতভাবে কথিত স্পেশাল ক্লাসসহ বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের জন্য শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে রেখেছে। চলতি বছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসে ১ হাজার ২০০ টাকা হিসেবে ৫ মাসের এক সাথে ৬ হাজার টাকা শিক্ষার্থীদের কাছে দাবি করছে কর্তৃপক্ষ। এই টাকা পরিশোধ না করলে তাদের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসতে না দেয়ার হুমকি দিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন অজুহাতে ক্লাস অ্যাসাইনমেন্টে নম্বর কম দেয়ার হুমকি-ধমকিও দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
ক্ষোভ প্রকাশ করে ড্যাফোডিল কলেজের একাধিক শিক্ষার্থী বিবার্তাকে জানান, ফর্ম ফিলাপের তারিখ দিয়ে হঠাৎ করে বিশেষ ক্লাশের নামে আলাদা ৬ হাজার টাকা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। স্পেশাল ক্লাস যদি বাধ্যতামূলক হয়ই, তবে কেন আমাদের আগে জানানো হলো না? এখন হঠাৎ করে এই টাকা আমাদের বেতনের সাথে যোগ করে দিয়েছে। এই ফি না দিলে আমাদের ফরম ফিলাপ করতে দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন গাইড শিক্ষকরা।
বিবার্তার অনুসন্ধানে জানা গেছে, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজের সকল (বিজ্ঞান, ব্যাবসায় শিক্ষা ও মানবিক) বিভাগের সকল সেকশনের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে একাধিক মেসেঞ্জার গ্রুপ আছে। এরকম একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে গত ২৮ এপ্রিল একজন শিক্ষার্থী চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার আগ পর্যন্ত ৩ বছরের কলেজের বেতনাদি পরিশোধ করতে হবে কিনা জানতে চাইলে কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ঝারকা সুলতানা জানান, অবশ্যই তাকে ৩ বছরের কলেজের পাওনা বেতন পরিশোধ করতে হবে।
এ সময় শিক্ষিকার এমন অপ্রত্যাশিত বক্তব্যের প্রতিবাদ করলে মো. আদনান হোসেন খান নামের এক শিক্ষার্থীকে ওই মেসেঞ্জার গ্রুপ থেকে বের করে দেন ঝারকা। এর কিছুদিন পর থেকেই আবারো অতিরিক্ত টাকা দেয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের চাপ দেয়া হয়।
অভিযোগ রয়েছে, গত ৩ আগস্ট গাইড শিক্ষক রানা শিক্ষার্থীদের মেসেঞ্জার গ্রুপে স্পেশাল ক্লাস বাবদ অতিরিক্ত ৬ হাজার টাকা দেয়ার নির্দেশনার কথা জানান। উক্ত ফি পরিশোধ করা ছাড়া পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করতে দেয়া হবে না বলেও জানান তিনি। পরে শিক্ষার্থীদের বাসায় মোবাইলে ফোন করেও বাড়তি ৬ হাজার টাকা দেয়ার বিষয়ে অভিভাবকদের জানান সকল সেকশনগুলোর গাইড শিক্ষকরা।
অভিযোগের বিষয়ে গাইড শিক্ষক রানা মোবাইল ফোনে বিবার্তাকে বলেন, এটা তো অফিশিয়াল বিষয়। অপনি অফিসে আসেন। কোন অভিযোগ থাকলে সেটা অফিসে এসে বলতে হবে।
শিক্ষার্থীদের করা অভিযোগ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বিবার্তাকে বলেন, আসলে এ ব্যাপারে আমার কোন কিছু বলার নাই। কোথায় কে কি বললো, সেটা আমি কিভাবে বলবো? ধানমন্ডি ২৭ এ আমাদের অফিস। আপনি অফিসে এসে কথা বলুন।
বিবার্তায় আরো পড়ুন>>>শিক্ষাখাতে দুর্নীতি : অতিরিক্ত ফি না দিলে পরীক্ষায় বসতে না দেয়ার হুমকি! (পর্ব-২)
এদিকে অভিযুক্ত এই কলেজের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কলেজ কর্তৃপক্ষ, অসহায় ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীদের যেকোনো প্রকার ফি মওকুফসহ তাদের যেকোনো প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াবে বলে বিবার্তাকে একাধিকবার জানিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় তার ঠিক উল্টো চিত্র।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজের একজন শিক্ষার্থী বিবার্তাকে বলেন, পারিবারিকভাবে অর্থনৈতিক সঙ্কটে আছি। আমাকে নিজের খরচ নিজেকেই বহন করতে হয়। এটা আমার গাইড শিক্ষক জানা সত্ত্বেও একাধিকবার আমাকে এবং বাসার নাম্বারে ফোন দিয়ে স্পেশাল ক্লাসের অতিরিক্ত ৬ হাজার টাকাসহ কলেজের সকল পাওনা পরিশোধ করতে বলেছেন। আমি একজন শিক্ষকের মাধ্যমে কলেজের প্রিন্সিপালের কাছে স্পেশাল ক্লাসের ফি মওকুফের আবেদন করেছি কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখান করেছেন।
অপর এক শিক্ষার্থী জানায়, আমার বাবা মারা যাওয়ার কারণে আমি বেশ অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ে যাই। তখন কলেজের এক শিক্ষকের মাধ্যমে ফি মওকুফের আবেদন করি প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে। তিনি আমাকে ভাইস প্রিন্সিপাল ঝারকা ম্যামের কাছে পাঠালে তিনি সাফ জানিয়ে দেন, কোন ফি মউকুফ হবে না।
শুধু তাই নয়, এই কলেজের অর্থনৈতিক সঙ্কটে থাকা কোনো শিক্ষার্থীকে গাইড শিক্ষক রেফার করলে তাকেও কর্তৃপক্ষের রোষানলে পড়ে লাঞ্ছিত হতে হয়।
এদিকে শিক্ষা বোর্ডের ৩১ জুলাইয়ের ওই নির্দেশনার আরো একাধিক নিয়ম ভঙ্গ করেছে অভিযুক্ত এই কলেজ। বোর্ডের নোটিশে বলা হয়, ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ ও পরীক্ষার ফি সম্পূর্ণ অনলাইনে দিতে হবে। কোন অবস্থাতেই পরীক্ষার্থী বা তার অভিভাবককে প্রতিষ্ঠানে সশরীরে আসতে বলা যাবে না।
এছাড়া, গত ১২ আগস্ট বোর্ড কর্তৃক আরো একটি সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয় যে, ফরম পূরণ কার্যক্রমের জন্য শিক্ষার্থী/অভিভাবককে প্রতিষ্ঠানে আসতে বলার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ফরম পূরণ প্যানেল তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করাসহ প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলেজের বিজ্ঞান জি সেকশনের এক শিক্ষার্থী বিবার্তাকে জানান, আমার গাইড শিক্ষক আফরোজা মিস আমাকে ১৭ তারিখ রাতে ফোন করে কলেজের বকেয়া টাকা পরিশোধের তাগিদ দেন। আমার সমস্যার কথা জানালে মিস আমাকে বলেন, তোমাকে ১৯ তারিখেই কলেজে আসতে হবে এবং বকেয়া টাকা পরিশোধ করে ফরম ফিলাপ করে যেতে হবে।
এছাড়া , ২০২১ সালের ফরম পূরণের তারিখ নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের ওই নোটিশে আরো বলা হয়, ১২ আগস্ট থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অনলাইনে শিক্ষার্থী নির্বাচন করতে হবে এবং ৩০ আগস্টের মধ্যে পরীক্ষার ফি দিতে হবে।
তবে এখানেও পরীক্ষার্থীদের ফরম পূরণের শেষ তারিখ নিয়ে নানামুখী বক্তব্য দেয় ড্যাফোডিল কলেজ কর্তৃপক্ষ। গত ১ আগস্ট কলেজ কর্তৃপক্ষ মেইলের মাধ্যমে এক অফিশিয়াল নোটিশে জানায় শিক্ষার্থীদের ১২ থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত ফরম পূরণ কার্যক্রম চলবে।
কিন্তু ১৬ আগস্ট কলেজ শিক্ষক আব্দুল হাকিম বিবার্তাকে জানান, বোর্ডের নির্দেশ মেনেই আমরা কলেজ পরিচালনা করি। আমাদের ফরম পূরণের শেষ সময় ২৫ আগস্ট।
এর একদিন পরেই গত ১৮ আগস্ট গাইড শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের ফোন করে ১৯ আগস্টের মধ্যে কলেজে সশরীরে উপস্থিত হয়ে সকল ফি জমা দিয়ে ফরম পূরণ নিশ্চিত করতে বলেন।
এই বিষয়ে ১৮ আগস্ট রাত ৮টা ৫০ মিনিটে বিবার্তার সাথে কলেজের শিক্ষক রউশন আরার কথা হয়। তিনি জানান, ১৯ তারিখ লাস্ট ডেট বিষয়টা তেমন না। আমাদের তো অনেক ধরনের শিক্ষার্থীর আছে। তাই তাদের তাগিদ দেয়ার জন্যই তারিখ কিছুটা এগিয়ে বলা। এর কিছুক্ষণ পরেই রাত ১১ টা ১৮ মিনিটে উক্ত শিক্ষিকা শিক্ষার্থীদের একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে জানান, তোমাদের ফরম পূরণের কার্যক্রম ২৪ আগস্ট পর্যন্ত ভার্চুয়ালি চলবে। ফিজিকালি কলেজে আসার প্রয়োজন নেই।
এই বিষয়ে ১৯ আগস্ট সরেজমিনে বিবার্তার সাথে কথা হয় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল একাডেমির সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) মো. মজিবুর রহমান খোকনের। তিনি জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয় দিয়ে তো আর অফিস চলে না। ১৯ তারিখ ফরম ফিলাপের শেষ সময় হলে সমস্যা কি? সময় মত ফরম ফিলাপ কার্যক্রম শেষ করার জন্যই এধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।
সার্বিক বিষয়ে জানতে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজ কর্তৃপক্ষের পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুসারে ২১ আগস্ট সরেজমিনে কলেজে যান বিবার্তার এই প্রতিবেদক। একাধিকবার মুঠোফোন ও ক্ষুদেবার্তায় যোগাযোগ করার পর কলেজের প্রিন্সিপাল শিবলি সাদিক বিবার্তাকে জানান, আজকে আমরা এসব ব্যাপারে কোনো কথা বলব না। আমারা আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছি। আপনাদের যথাসময়ে জানানো হবে।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজের এসব অনিয়ম ও অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের প্রফেসর নেহাল আহমেদ বিবার্তাকে বলেন, কোনো কলেজ শিক্ষা বোর্ডের নির্ধারিত ফি’র অতিরিক্ত ফি আদায় করলে কিংবা বোর্ডের নির্দেশনা না মানলে শিক্ষার্থী, অভিভাবকরা বোর্ডে অভিযোগ করলে ওই কলেজের বিরুদ্ধে সাথে সাথে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অতিরিক্ত ফিসহ অনিয়ম দেখলেই শিক্ষার্থী-অভিভাবককে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে কলেজের প্যানেল বন্ধ করে দেয়া হবে।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে অতিরিক্ত ফিসহ অনিয়মের দায়ে ৫৩টি কলেজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পরে অতিরিক্ত টাকা ফেরত দেয়ায় তাদের প্যানেল খুলে দেয়া হয়েছে।
বিবার্তা/আদনান/রাসেল/গমেজ/আবদাল
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]