
স্পেশাল ক্লাসের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি নিচ্ছে রাজধানীর ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজ। এই অতিরিক্ত ফি না দিলে পরীক্ষায় বসতে না দেয়ার হুমকির অভিযোগও উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সাথে কথা বলেএসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সাথে আলাপ করে ও অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নিয়ম বহির্ভূতভাবে কথিত 'স্পেশাল ক্লাস'সহ বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের জন্য শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে রেখেছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজ। চাহিদার ভিত্তিতে টাকা পরিশোধ না হলে পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে দেয়া হচ্ছে না শিক্ষার্থীদের।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিভিন্ন অজুহাতে ক্লাস অ্যাসাইনমেন্টে নম্বর কম দেয়ার হুমকি-ধমকিও দেয়া হয় শিক্ষার্থীদের। প্রথমে ৩৬ মাসের বেতন পরিশোধের কথা বলা হয়। ওই সময় শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে শুধুমাত্র ২৪ মাসের বেতন পরিশোধের কথা বলা হয়। এরপরে হঠাৎ করেই নিয়ম বহির্ভূতভাবে কথিত স্পেশাল ক্লাসের নাম করে ছেড়ে দেয়া ১২ মাসের বেতনও আদায়ের পায়তারা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা।বিভিন্ন খাতের নাম করে এ অতিরিক্ত টাকা আদায়ের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কলেজের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
আরো পড়ুন :শিক্ষাখাতে দুর্নীতি : অতিরিক্ত ফি আদায় করছে ড্যাফোডিল! (পর্ব-১)
জানা যায়, গত ৩ আগস্ট গাইড শিক্ষক রানা শিক্ষার্থীদের মেসেঞ্জার গ্রুপে স্পেশাল ক্লাস বাবদ অতিরিক্ত ৬ হাজার টাকা দেয়ার নির্দেশনা দেন। উক্ত ফি পরিশোধ করা ছাড়া পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে দেয়া হবে না বলেও জানান তিনি। পরে শিক্ষার্থীদের বাসায় মোবাইলে ফোন করেও বাড়তি ৬ হাজার টাকা প্রদানের বিষয়ে অভিভাবকদের জানান অন্য সেকশনগুলোর গাইড শিক্ষকরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজের একজন শিক্ষার্থী বিবার্তাকে বলেন, পারিবারিকভাবে অর্থনৈতিক সঙ্কটে আছি। আমাকে নিজের খরচ নিজেকেই বহন করতে হয়। এটা আমার গাইড শিক্ষক জানা সত্ত্বেও একাধিকবার আমাকে এবং বাসার নাম্বারে ফোন দিয়ে স্পেশাল ক্লাসের অতিরিক্ত ৬ হাজার টাকাসহ কলেজের সকল পাওনা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। আমি একজন শিক্ষকের মাধ্যমে কলেজের প্রিন্সিপালের কাছে স্পেশাল ক্লাসের ফি মওকুফের আবেদন করলে তিনি তা প্রত্যাখান করেন।
কলেজের এক নারী শিক্ষার্থী বিবার্তাকে বলেন, আমাদের গাইড মিস আমাকে ১৭ আগস্ট ফোন করে ১৯ আগস্টের মধ্যে স্পেশাল ক্লাসের টাকাসহ সকল বাকি টাকা পরিশোধ করে ফরম ফিলাপ করতে বলেন। আমার সমস্যার কথা শোনার পরেও তিনি ১৯ তারিখের মধ্যেই টাকা পরিশোধের তাগিদ দিয়ে ফোন রেখে দেন।
কলেজের আরেক শিক্ষার্থী বিবার্তাকে বলেন, আমার গাইড শিক্ষক বাসায় ফোন দিয়ে ধমকের সুরে বলেন, কলেজের সকল ধরণের পাওনা পরিশোধ না করলে আমার ফরম পূরণ করতে দেয়া হবে না। আমি মাত্র তিন দিন স্পেশাল ক্লাসে উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু এর আগে আমাদের স্পেশাল ক্লাসের বাধ্যতামূলক ফিসহ বিস্তারিত কোনো কিছুই জানানো হয়নি। বরং ইতোপূর্বে কলেজ আমাদের থেকে ২৪ মাসের অতিরিক্ত কোনো টাকা নেয়া হবে না বলেই জানানো হয়েছিল।
ক্ষোভ প্রকাশ করে এক অভিভাবক বিবার্তাকে বলেন, কলেজ থেকে হঠাৎ করে ফোন দিয়ে বলা হলো ফরম পূরণ করতে হলে ৭৬৭০ টাকা দিতে হবে। অথচ আমার ছেলের কলেজের সকল পাওনা পরিশোধ আছে, বলার পরেও আমাকে বলা হলো স্পেশাল ক্লাসের ৬ হাজার টাকা বাধ্যতামূলক ভাবে পরিশোধ করতেই হবে। ছেলে স্পেশাল ক্লাস করেনি বলার পরেও টাকা পরিশোধ করতেই হবে জানিয়ে তিনি ফোন কেটে দেন।
কলেজের আরেক শিক্ষার্থীর বাবা বিবার্তাকে বলেন, আমাকেও কলেজ থেকে বেশ কিছুদিন এই অতিরিক্ত টাকা চেয়ে ফোন করা হয়েছে। অথচ আমার ছেলে কোনরকম স্পেশাল ক্লাস করেইনি। আমি কলেজের এই অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমি জেনেছি আমার ছেলে ও তার সহপাঠিরা প্রথম থেকেই এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে। তাদের এই নৈতিক অবস্থানের জন্য বাবা হিসেবে আমি গর্ববোধ করছি।
অভিযোগ প্রসঙ্গে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজে গেলে সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পরেও হয়রানির শিকার হয় এ প্রতিবেদক। কলেজের দাড়োয়ান মো.আরিফ হোসেন তাকে কলেজে প্রবেশে বাধা দেন। এসময় দুই ঘণ্টার বেশি সময় তাকে বাহিরে দাঁড় করিয়ে রাখেন। এরপর প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে কলেজে কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার মুঠোফোনে কল ও ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
কলেজের সাইনবোর্ডে থাকা নাম্বারে যোগাযোগ করলে একপর্যায়ে কল রিসিভ করে। এসময় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রসঙ্গে কলেজ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে চাইলে ঐশ্বর্য চৌধুরী নামের একজন জানান, শনিবার (২১ আগস্ট) তারা অভিযোগের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিবেন।
তবে এর কিছুক্ষণ পরই কলেজের দাড়োয়ানের মাধ্যমে প্রতিবেদককে কলেজের প্রশাসনিক কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল একাডেমির সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) মো. মজিবুর রহমান খোকন, কলেজ শিক্ষক আবদুল হাকিম, ইংরেজি শিক্ষক মিল্টনসহ কয়েকজন।
মো. মজিবুর রহমান খোকন জানান , প্রতিটি বেসরকারি কলেজের নিজস্ব কিছু নীতিমালা থাকে, আমরা আমদের নিজস্ব নিয়ম মেনেই সব পরিচালনা করি।
এসময় স্পেশাল ক্লাস ও এর ফি বাধ্যতামূলক কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্পেসাল ক্লাস আমাদের শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নের জন্য এবং এটা বাধ্যতামূলক । আমরা যেহেতু শিক্ষার্থীদের সেবা দিচ্ছি , সেটার বিনিময়ে ফি তো আমরা দাবি করতেই পারি। তবে কেউ যদি সঠিক উপায়ে আমাদের কাছে ফি মউকুফের আবেদন করে। সেক্ষেত্রে তার ফি আমরা শিথিল করতে পারি।
এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে নির্দেশিত ফরম ফিলাপের শেষ সময় নিয়ে মজিবুর রহমান খোকন বলেন, ১৯ তারিখ ফরম ফিলাপের শেষ সময় হলে সমস্যা কি? শিক্ষা মন্ত্রনালয় দিয়ে তো আর অফিস চলে না । সময়মত ফরম ফিলাপ কার্যক্রম শেষ করার জন্যই এধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল ।
উপস্থিত ইংরেজি শিক্ষক মিল্টন বলেন , ইতোমধ্যে বেশ কিছু শিক্ষার্থী ও অভিভাবক আমাদের কলেজের পাওনা পরিশোধ করেছেন । ৩০০ জনের মধ্যে ১০০ জনের কাছাকাছি শিক্ষার্থী যদি কোন প্রশ্ন ছাড়াই টাকা দিতে পারে। বাকিদের কি সমস্যা? আর সমস্যা হলে তো আমাদের কাছে এসে বলতে হবে , আপনাদের কাছে অভিযোগ দিয়ে কি সমাধান হবে?
সুনির্দিষ্ট এসব অভিযোগের বিষয়ে উপস্থিত অপর শিক্ষক আবদুল হাকিম প্রতিবেদককে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনি তো মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলছেন। শিক্ষার্থীদের বা আপনাদের কোনো অভিযোগ থাকলে উচিত কলেজ প্রশাসনের সাথে কথা বলা। আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকারা তো একাডেমিক দিক দেখেন, উনারা তো টাকা পয়সার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। স্পেশাল ক্লাসের ব্যাপারে আমরা অভিভাবক মিটিং ডেকে বহু আগেই বিষয়টি পরিস্কার করেছি। শুধু এই স্পেশাল ক্লাসের ফি নয়, যে কোন বিষয়ে শিক্ষার্থীরা আমাদের কাছে আবেদন করলে মানবিক দিক থেকেই আমরা সেটা বিবেচনা করে থাকি।
বিবার্তা/আদনান/রাসেল/গমেজ/শাহিন
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]