উদ্দেশ্যহীন প্রেমে পড়ার কারণ
প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ১০:০৫
উদ্দেশ্যহীন প্রেমে পড়ার কারণ
লাইফস্টইল ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না/ শুধু সুখ চলে যায়, এমনই মায়ার ছলনা/ এরা ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়।’ যা বলতে চাইছি, তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গান দিয়েই বলে ফেলা যায়। প্রেম একটি মাধুর্যপূর্ণ সম্পর্ক। এই সম্পর্ক যখন একজন ব্যক্তির সঙ্গে থাকে, তখন তাতে এই মাধুর্য থাকে। কিন্তু বারবার উদ্দেশ্যহীনভাবে যদি একাধিকজনের সঙ্গে প্রেম হয়, তখন এই মাধুর্যতার জায়গাটা কিন্তু আর থাকে না। গার্ডিয়ানে একটা জরিপ করা হয়েছিল, করোনার আগে ও করোনার পরে একাধিক সম্পর্কে জড়ানোর হার কেমন, সে বিষয়ে। দেখা গেল, করোনা মহামারির আগে প্রতি পাঁচজনের একজন উদ্দেশ্যহীনভাবে এই সম্পর্কে জড়াত। কিন্তু গত দেড় বছর বা দুই বছর লকডাউন-পরবর্তী পৃথিবীতে এই সংখ্যা এখন লাফ দিয়ে দ্বিগুণের বেশি হয়ে গেছে।


এই প্রেক্ষাপটে খুব স্বাভাবিকভাবে আসবে যে এই বারবার উদ্দেশ্যহীন বা প্রতিশ্রুতিহীন প্রেমের সম্পর্কে জড়ানো কেন? উদ্দেশ্যহীনভাবে বারবার প্রেমে পড়ার এই ব্যাপারটাকে দুই ভাগ করে বলতে চাই। একটা মানসিক দিক থেকে, অন্যটি নিউরোসায়েন্সের ব্যাকগ্রাউন্ডে। মানসিক দিক থেকে যদি বলি, তাহলে বারবার এই প্রেম প্রেম ব্যাপারটা কোনো বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন দিক থেকে আসছে না, তাহলে কোন দিক থেকে আসছে? নিজের মনের জানালা নির্দিষ্ট কারও মনের দিকে খুলে যাওয়া। এই প্রেম নয়, কিন্তু প্রেম প্রেম ব্যাপারটা আবার সবার সঙ্গে হয় না। নির্দিষ্ট কারও জন্য অনুভূত হয় এবং পরবর্তী সময়ে আরও অনেকের জন্য অনুভূত হতে পারে। যেমন কোনো পার্টিতে একটি ছেলের সঙ্গে একটি মেয়ের পরিচয় হলো। মুচকি হাসি দিয়ে কাছাকাছি বসে গল্প হলো। আর এই গল্পের ধরনটাও সাধারণ পরিচয়পর্ব নয়, বরং অন্য রকম। ইংরেজিতে যেটাকে আমরা অ্যাবসলিউট ফ্ল্যার্ট বলি। প্রথম ধাপে এটা চলে।


কোনো গন্তব্য়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি না দিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে এই ফ্ল্যার্টিং চলে। পরের ধাপে, বাড়ি গিয়ে ফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগ হতে থাকল এবং ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকল। এরপর একে অপরের সঙ্গে কোথাও দেখা করার এবং সময় কাটানোর ইচ্ছা জাগল। বলে রাখা ভালো, এই ভালো লাগা কিংবা একে অপরের প্রতি আকাঙ্ক্ষা মনের বাউন্ডারি অতিক্রম করে শরীর পর্যন্ত পৌঁছে যায় কখনো। এরপর যেটা হয়, এই প্রেম প্রেম ব্যাপারটা শরীর মন ক্রস করে গেল, কিন্তু কমিটমেন্ট তো নেই। তখন থেকে ফলাফলটা শুরু।


দুজনের একজন দেখল, বিপরীতের মানুষটি তাকে বাদ দিয়ে আরও অনেকের সঙ্গেও তো কথা বলে, ঘনিষ্ঠ হয়। তখন একধরনের দ্বন্দ্ব হয় এবং যুক্তিতর্ক চলে। এটাকে দ্বিতীয় ধাপ বলে। এরপর ওই যে কমিটমেন্ট নেই, দ্বন্দ্ব-ঝগড়া চলছে। এর মধ্যে দুজনের একজনের জীবনসঙ্গী হয়তো ব্যাপারটা জেনে গেলেন বা আঁচ করলেন। অথবা দুজনের একজন অ্যাগ্রেসিভ হয়ে উঠলেন যে এখন আমাকে বিয়ে করে ফেলো। তখন অপর পক্ষ রাজি হচ্ছে না। এখান থেকে তৃতীয় ধাপের শুরু। দুজনের একজন যদি বিবাহিত থাকেন, তাঁদের বিচ্ছেদ হতে পারে, সংসারে অশান্তি হতে পারে, একজন অন্যজনের গায়ে হাত তুলছেন এমন ঘটনাও হয়।


এবার আসি, উদ্দেশ্যহীনভাবে প্রেমে জড়ানোর পরে এই সম্পর্কে কোনো বাউন্ডারি নেই। আর বাউন্ডারি না থাকার কারণে একটা পর্যায়ের পরে যখন সম্পর্কটা ভেঙে গেল, তখন ব্যক্তি দুটি ব্যাপার অনুভব করতে পারে। নিজেকে প্রচণ্ড দোষী ভাবা এবং প্রচণ্ড হতাশাবোধ। এই দুটো বিষয় অনুভব করার আগে এটা ভাবা দরকার যে এই সম্পর্কটা আমি কেন কনটিনিউ করব, কত দিন করব এবং তার আগে ভাবা দরকার, কখন ভেঙে দিতে হবে। এককথায় কত দূর যেতে হবে, কোথায় গিয়ে থামতে হবে এবং কোথা থেকে ফেরত আসতে হবে, তা জানতে হবে। মানে, আমার ভালো লাগতেই পারে, কিন্তু ভালো লাগার বাউন্ডারিটা আমি কখন কোথায় দেব, সেটা আমাকে জানতে হবে।


যাঁরা উদ্দেশ্যহীনভাবে বারবার প্রেমে জড়িয়ে পড়েন, তাঁদের বুঝতে হবে যে প্যাটার্নটা কী। সেটা কি মানসিক চাহিদা, নাকি শারীরিক চাহিদা। সেটা যদি আমি বুঝতে পারি, তাহলে নিজেও সমস্যায় পড়ব না, সঙ্গীকেও ভালো রাখতে পারব এবং অন্যদেরও সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে না।


এবার আসি নিউরোসায়েন্সের ভিত্তিতে এ সম্পর্কের ব্যাখ্যায়। কিছুদিন আগেও কিন্তু তর্ক ছিল, মানুষ প্রাকুতিকভাবে একগামী না বহুগামী? এখন সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিচার করলে দেখা যায়, মনোগামী বা একগামীর পাল্লাটাই বেশি ভারী। এখানে বলে রাখা ভালো, একগামী ও বহুগামীদের মস্তিষ্কের গঠন আলাদা। তাদের যৌন আচরণে কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু রোমান্টিক সম্পর্কে যখন কোনো উদ্দীপনা আসে, তখন এই পার্থক্যটা দেখা যায়। আমাদের মস্তিষ্কে বিভিন্ন এলাকা রয়েছে। লিমবিক সিস্টেম ও রিওয়ার্ড এরিয়া এর অন্তর্ভুক্ত। একগামীদের লিমবিক সিস্টেম ও রিওয়ার্ড এরিয়া—দুই জায়গাতেই রোমান্টিক উদ্দীপনা বেশি হয়। বহুগামীদের সেটা হয় না। একগামীদের মস্তিষ্কের যৌন অনুভূতি ও রোমান্টিক উদ্দীপনার এরিয়া কাছাকাছি থাকে। বহুগামীদের ক্ষেত্রে তা আলাদা, বেশ দূরে। বহুগামীদের কর্টেক্সেও রোমান্টিক উদ্দীপনায় লাড্ডুর মতো ফুটতে থাকে, ফলে তারা যে সবার সঙ্গে যৌন সম্পর্কে জড়াচ্ছে, তা নয়। কিন্তু তারা এই উদ্দীপনা পাওয়ার জন্য বারবার প্রেমে জড়াতে থাকে।


সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে, তারা যদি বিবাহিত হন বা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সম্পর্কে থাকেন, তাহলে তা সঙ্গীর জন্য ভয়াবহতা ডেকে আনে। এ ছাড়া বহুগামী পুরুষদের মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস এলাকাটা বড়। ফলে তারা এই সুখানুভূতির কথা বারবার মনে করতে পারে এবং বারবার প্রেমে জড়ায়। এখন বলি বহুগামিতা ভালো নাকি খারাপ? বহুগামিতার সঙ্গে ওসিডি, বিষণ্নতা, দুশ্চিন্তা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা, ভয় ও সন্দেহবাতিকগ্রস্ততার সম্পর্ক পাওয়া গেছে। সুতরাং উদ্দেশ্য়হীনভাবে প্রেম প্রেম খেলা অস্বাস্থ্যকর। শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক ও সামাজিক স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। সেটা কেবল নিজের জন্য নয়, যার সঙ্গে খেলছে, তার জন্য ও নিজের সঙ্গীর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও।


বিবার্তা/এমবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com