বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাংকিং
এশিয়ার সেরা ১০০তে নেই বাংলাদেশ!
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৩, ১৯:১৩
এশিয়ার সেরা ১০০তে নেই বাংলাদেশ!
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

যুক্তরাজ্যভিত্তিক টাইমস হায়ার এডুকেশন এশিয়ার সেরা ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। তবে এই তালিকায় সেরা ১০০টির মধ্যে নেই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।


তালিকায় এশিয়ার সেরা ২০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশি দুটি বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা করে নিয়েছে। এর মধ্যে একটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যার অবস্থান ১৮৬তম, আর অপরটি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, যার অবস্থান ১৯২তম স্থানে।


আন্তর্জাতিক এই র‍্যাংকিংয়ে এশিয়ার সেরা ১০০তে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় না থাকা, এদিকে ২০০-এর মধ্যে মাত্র দুটি থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।



শিক্ষাবিদরা বলছেন, বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ের নানা সূচকের মান পূরণ করতে না পারায় পিছিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এক্ষেত্রে উন্নতির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবসাইটকে নিয়মিত আপডেট রাখাসহ সূচকের মান উন্নয়নে কাজ করার পরামর্শ তাদের।



বৃহস্পতিবার, ২২ জুন প্রকাশিত এ র‍্যাংকিংয়ের কেতাবি নাম ‘এশিয়া ইউনিভার্সিটি র‍্যাংকিং ২০২৩’। র‍্যাংকিংয়ে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শীর্ষে আছে চীনের সিংহুয়া ও পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়। এশিয়ার সেরা দশের মধ্যে চীনের চারটি, হংকংয়ের তিনটি, সিঙ্গাপুরের দুটি ও জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এ বছর ১৩টি বিষয়কে পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর বিবেচনায় নিয়ে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তালিকা করা হয়েছে।


টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়েবসাইট তথ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক অবস্থা, গ্রাজুয়েটদের চাকরির বাজারে সুনাম, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী সংখ্যা, গবেষণা, শিক্ষক গবেষণা-উদ্ধৃতি, আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক, কর্মসংস্থান প্রভৃতি সূচকের জন্য নম্বর বরাদ্দ থাকে। তারপর সব সূচকের যোগফলের গড় করে স্কোর করে তার ভিত্তিতে র‍্যাংকিং করা হয়।


বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এসব সূচকে পিছিয়ে যায় বলে র‍্যাংকিংয়েও পিছিয়ে পড়ে বলে জানিয়েছেন শিক্ষাবিদরা।


এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিবার্তাকে বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক র‍্যাংকিংয়ে পিছিয়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, যেই সব সূচকের ভিত্তিতে এই র‍্যাংকিং করা হয়, সেগুলোতে আমরা পিছিয়ে আছি। এক্ষেত্রে অনেক সময় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটগুলোও আপডেট থাকে না। ফলে যারা র‍্যাংকিংয়ের তথ্য নেয়, তারা ওয়েবসাইটে তথ্য না পেয়ে মার্ক দেয় না। এটার সমাধানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবসাইট আপডেট করার পাশাপাশি র‍্যাংকিংয়ে আসার ক্রাইটেরিয়াগুলো ভালো করে দেখতে হবে। এরপর নিজেদের দুর্বল জায়গাগুলো খুঁজে অতিদ্রুত সমাধান করতে হবে।


তিনি বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশী শিক্ষার্থী কম। এটাও আমাদের র‍্যাংকিংয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাছাড়াও আমাদের গবেষণায় বরাদ্দও কম থাকে। ফলে গবেষণাও কম হচ্ছে। কাজেই এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিতে হবে।


বিশিষ্ট এই শিক্ষাবিদ বলেন, আমাদের দেশের উচ্চ শিক্ষিতদের অনেকে পাস করে কর্মসংস্থানে ঢুকতে না পেরে বেকার হচ্ছে। আর এ বিষয়টি বিশ্বব্যাপীও আলোচিত হচ্ছে। ফলে র‍্যাংকিংয়ে এর প্রভাব পড়ছে।


র‍্যাংকিংয়ে ভালো করার উপায় কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে গণমাধ্যমেরও যোগসূত্র থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খারাপ কাজ করলে যেভাবে সমালোচনা করা হয়, একইসাথে ভালো গবেষণাসহ কোনো স্বীকৃতিমূলক কাজ করলে সেটাও প্রচার করতে হবে। তাহলে বিশ্ব আমাদের এ অর্জনগুলো সম্পর্কে জানতে পারবে। আমাদের শিক্ষার কারিকুলাম যুগোপযোগী করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটগুলো আপডেট করতে হবে। এছাড়া র‍্যাংকিং মানদণ্ডের সূচকগুলো দেখতে হবে এবং সেটা অনুযায়ী কাজ করতে হবে।


জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, যে গবেষণার জন্য র‍্যাংকিং হয়, সেই গবেষণাগুলো আমাদের কম হচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে বরাদ্দও কম দেয়া হচ্ছে। তবে ইদানিং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক জায়গায় গবেষণার বরাদ্দ বেড়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক পাবলিকেশন্সেও আমাদের গবেষণা ধীরে ধীরে বাড়ছে।


তিনি বলেন, আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, আমাদের ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত খুব বেশি। বিদেশে কোনো শিক্ষকের অধীনে ১১ থেকে ১২ জন শিক্ষার্থী থাকলেও আমাদের এখানে শিক্ষক প্রতি ৫০ থেকে ৬০ জন । তারপরে আবার বিশ্ববিদ্যালয় কতোটা সাবলম্বী সেটাও দেখা হয় র‍্যাংকিংয়ে। কিন্তু এক্ষেত্রে তো আমরা শূন্য প্রায়। তার কারণ হলো, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাবলম্বী নয়।


তিনি আরো বলেন, আমাদের গবেষণা যেগুলো হচ্ছে, সেগুলোও অনেক সময় অনলাইনে আপডেট থাকছে না। ফলে যারা র‍্যাংকিং করেন তাদেরও দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া ল্যাবরেটরিরও কিছু সমস্যা আছে। কাজেই র‍্যাংকিং বাড়ানোর জন্য এটাকেও আপডেট করতে হবে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আমরা বিদেশী শিক্ষার্থী ক্যাটাগরিতে অনেক পিছিয়ে আছি। ফলে এক্ষেত্রে আমাদের র‍্যাংকিং শূন্য আসছে। তাই বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য একটা কোটা রাখা যেতে পারে। যেমন, ধরুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮০টা বিভাগ থাকলে প্রত্যেক বিভাগে যদি ২টা কোটা থাকে,তাহলে ১৬০ জন বিদেশী শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারবে।


ড. মীজানুর রহমান বলেন, আরেকটা জিনিস আমাদের দেখতে হবে, শিক্ষার্থী প্রতি আমাদের বাজেট কত ? শিক্ষার্থী প্রতি বাজেটে তো আমরা বিশ্বে ৫ হাজারের মধ্যে পড়ি না। তাহলে কিভাবে আমরা র‍্যাংকিংয়ে ১০০ এর মধ্যে আসবো? তারপরেও আমাদের হাল ছাড়া যাবে না। আমাদের সঙ্কটগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানে কাজ করতে হবে।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়, কিশোরগঞ্জের উপাচার্য অধ্যাপক ড. জেড এম পারভেজ সাজ্জাদ বিবার্তাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‍্যাংকিংয়ের জন্য মূলত যে প্যারামিটারগুলো ব্যবহার করা হয়- সেগুলো হলো, গ্রাজুয়েটদের মান, কর্মক্ষেত্রে গ্রাজুয়েটদের পজিশন, বিদেশি ছাত্র-শিক্ষকদের অনুপাত, গবেষণা ও প্যাটেন্টের সংখ্যা ইত্যাদি।


তিনি বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র‍্যাংকিংয়ে পিছিয়ে পড়ার কারণ হলো- উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা গবেষণা অবকাঠামো তৈরি করতে পারছি না। শিক্ষকরাও উন্নত বিশ্বের নামিদামি কনফারেন্সে/সেমিনারে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাচ্ছেন না, যেটির মাধ্যমে তার আইডিয়াকে উপস্থাপন করতে পারবেন, একই সাথে সারাবিশ্বে কী ধরনের গবেষণা চলছে, সে সম্পর্কেও বিস্তারিত ধারণা পেতে পারেন।


তিনি আরো বলেন, আমাদের গবেষণাগার তৈরি এবং কনফারেন্সে অংশগ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। বর্হিবিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির টিউশন ফি যেমন অনেক, তেমনি ইন্ডাস্ট্রিগুলোর সাথে তাদের কলাবরেশন আছে। সেই জন্য তাদের পক্ষে এটা খুব সহজেই করা সম্ভব হয়। কিন্তু আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উন্নতমানের গবেষণাগার তৈরীর জন্য যদি প্রথমে পাঁচ থেকে দশ বছর সরকার অর্থায়ন করে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমর্থ হবে ইন্ডাস্ট্রির সাথে কলাবরেশন করে গবেষণা কর্ম চালিয়ে যাওয়ার।


অধ্যাপক ড. পারভেজ সাজ্জাদ বলেন, অধিকন্তু দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেতন কাঠামো এবং পরিবেশ বিদেশী ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য এখনো যথেষ্ট অনুকূল নয়। যা বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। তবে এই সকল সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমাদের দেশের গ্রাজুয়েটদের মান ভালো, তারা সারা বিশ্বের বিভিন্ন নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভালো মানের গবেষক হিসেবেও কাজ করছে।


বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বার খাঁন বিবার্তাকে বলেন, বিশ্ব র‍্যাংকিং যারা করেন তাদের কিছু সূচক থাকে। আর সেই সূচক মানদণ্ড পূরণ করতে পারলে র‍্যাংকিংয়ে আগানো সম্ভব। তবে এর মধ্যে এমন কিছু সূচক রয়েছে যেগুলো বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য খুবই জটিল। যেমন, একটা সূচক রয়েছে যেখানে শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত দেখা হয়। আমাদের দেশে তো শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত হার অনেক বেশি। আমাদের বুয়েটে এটার অনুপাত ৬০:১। কিন্তু যেই বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাংকিংয়ে ভালো করছে তাদের অনুপাত হয়তো ৬:১। এখন এটা চাইলে তো আমি পরিবর্তন করতে পারবো না। এটা ঠিক করতে একদিকে শিক্ষক বাড়ানো যেতে পারে, অন্যদিকে শিক্ষার্থী সংখ্যা কমানো যেতে পারে। আর এই কাজ করার জন্য জাতীয় পলিসি দরকার। এছাড়া কিছু র‍্যাংকিংয়ের এমনও সূচক থাকে, যেখানে বলা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থী কিংবা অ্যালামনাই নোবেল প্রাইজ পেয়েছে কী না? এই ধরণের সূচকগুলোতে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি।


বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশ্ব র‍্যাংকিং এগিয়ে আনার উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে বুয়েটের উপ-উপাচার্য বলেন, বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ের সূচকগুলো দেখে সেই মোতাবেক কাজ করতে হবে। আর এ কাজগুলোকে অবশ্যই নিজেদের ওয়েবসাইটে আপডেট রাখতে হবে। কেননা, ওয়েবসাইট হচ্ছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়না।


বিবার্তা/রাসেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com