ফনিক্স ফাইন্যান্সে
ঋণ অনিয়ম : বরখাস্ত হলেন এমডি, বহাল তবিয়তে ডিএমডি
প্রকাশ : ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৩:৫১
ঋণ অনিয়ম : বরখাস্ত হলেন এমডি, বহাল তবিয়তে ডিএমডি
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

ঋণ অনিয়ম ও আমানতকারীদের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ফনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এস এম ইন্তেখাব আলমকে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর বরখাস্ত করার নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র ১ দিন আগে বরখাস্ত করা হয় ইন্তেখাব আলমকে। নির্দেশনায় ইন্তেখাব আলমের স্থলাভিষিক্ত হন ডিএমডি মোহাম্মদ সাইদুজ্জামান। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। একইসাথে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের সাথে জড়িতদের সম্পর্কে জানতে চাওয়া চিঠির প্রেক্ষিতে ডিএমডি এবং প্রিন্সিপাল ব্রাঞ্চের প্রধান শিরিণ আখতারকে শোকজ লেটার ইস্যু করে ফনিক্স ফাইন্যান্স।


ফনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় মাল্টি প্রোডাক্ট ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন। চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক চিঠি দেয় (স্মারক নং ডিএফআইএমসি/১০৫৪/৫৫২০২৪-২৮৯) ফনিক্স ফাইন্যান্সকে। চিঠিতে ঋণ গ্রহীতা এস এ অয়েল রিফাইনারি লি., আমান সিমেন্ট মিলস লিমিটেড ইউনিট-২, মনোস্পুল পেপার ম্যানোফ্যাকচারিং কোম্পানি লি., মাহিন এন্টারপ্রাইজ, ম্যাক স্টিল ইন্ড্রাস্ট্রিজ এবং গ্রাহক নাজমা পারভিন, ফারহান মোশাররফ এর ঋণ অনিয়মের সাথে কারা জড়িত তা জানতে চাওয়া হয়। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে তা প্রমাণসহ বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে বলা হয়।


বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই চিঠির প্রেক্ষিতে ডিএমডি এবং প্রিন্সিপাল ব্রাঞ্চের প্রধান শিরিণ আখতারকে শোকজ করেছে ফনিক্স ফাইন্যান্স। প্রতিষ্ঠান ওই চিঠি দিতে সময় নিয়েছে প্রায় ১ মাস। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক ২৩ জানুয়ারি ইস্যু করলেও ফনিক্স ফাইন্যান্স ডিএমডিকে শোকজ লেটার দিয়েছে ১৮ ফেব্রুয়ারি (স্মারক নং PFIL/HQ/HRD/2024/0335)। এর আগে ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট (এফআইসিএসডি) পরিদর্শনে ঋণ প্রদানে নানান অনিয়ম খুঁজে পায়।


ঋণ অনিয়ম এবং অনিয়মের সাথে যুক্ত সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ফনিক্স ফাইন্যান্সের কোম্পানি সেক্রেটারি সাব্বিরুল হক চৌধুরী বিবার্তাকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদেরকে স্টেপ বাই স্টেপ অবহিত করা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে রিপোর্টিং করার জন্য যে প্রক্রিয়া সেটি এখনো চলমান। এখানে প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তি বিশেষের সম্পর্কে কোনো ফাইন্ডিংন্স নাই, ঋণ অনিয়মের যোগসাজশের কোনো ব্যাপার এখানে নেই। এই বিষয়ে যাই কিছু করা হোক, আপনি কিছুই পাবেন না। এখানে একটাই সত্য, এখানে কিছু ক্লায়েন্ট লোন নিয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হয়েছে, তাহলে দোষটা কার? তারপরও তদন্ত কাজ চলমান। তারপরও যদি কোনো অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়, তাহলে তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হবে।


সাব্বিরুল হক চৌধুরী আরো জানান, আমি এখানের অনেক পুরাতন অ্যামপ্লোই, এসব ক্লায়েন্টকে আমি জীবনেও দেখিনি। কেউ যদি প্রতিজ্ঞা করে টাকা দিবোই না, তখন কী করা যাবে? এছাড়া, করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ বিষয়ে নিয়ম শিথিল করে দিলো, তখন এরা আরো সাহস পেয়ে গেল। কোম্পানির ব্যক্তিবিশেষ কেউ এগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট নেই। আভ্যন্তরীণ নিরীক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনাক্রমে কন্টিনিউয়্যাস বেসিসে তদন্ত চালাচ্ছে, এখনো পর্যন্ত অপ্রীতিকর কোনো তথ্য উদ্ঘাটিত হয়নি।


যদিও ফনিক্স ফাইন্যান্স কোম্পানি সেক্রেটারি সাব্বিরুল হক চৌধুরী জানান তদন্ত চলমান, ডিএমডি এবং প্রিন্সিপাল ব্রাঞ্চের প্রধান শিরিণ আখতার বিবার্তাকে জানান কোনো অনিয়ম হয়নি এবং তিনি কোনো অনিয়মের সাথে সংশ্লিষ্ট নন।


ঋণ অনিয়ম ও ওই বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং শোকজ লেটার সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএমডি এবং প্রিন্সিপাল ব্রাঞ্চের প্রধান শিরিণ আখতার বিবার্তাকে বলেন, আমাদের এখানে যেসমস্ত ফাইল আছে সেখানে কোনো অনিয়ম সেভাবে নাই। বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের পার্টিকুলারলি বলে নাই, তারা কী ফাইন্ডিংস পেয়েছে। আমাদের ইন্টার্নাল কম্পায়েন্সকে বলেছে, এখানে কী অনিয়ম দেখতে। কিছু কিছু অনিয়ম হয়তো কোনো চিঠিতে ডেট দেওয়া নাই এরকম কিছু আছে। আমার ব্রাঞ্চে যেগুলো ছিল, সেগুলোতে সেধরনের কোনো অনিয়ম পাওয়া যায়নি, যেটার জন্য আমাদের শোকজ করতে হবে। কিছু ডকুমেন্টারি ল্যাপ্সেস থাকতে পারে, এটা ডিফাইন্ড ইস্যু, কিন্তু অনিয়ম বলতে কিছু এখানে নেই। ঋণ অনিয়ম বলতে যা বোঝায় সেরকম আমাদের প্রতিষ্ঠানে হয় নাই। এটা আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি। এখানে কোনো আর্থিক অনিয়ম হয়নি।


শিরিণ আখতার আরো দাবি করেন, আমার ব্রাঞ্চে যে তিনজন ঋণগ্রহীতা আছে- সেখানে কোনো আর্থিক অনিয়ম হয়নি, ফিনিক্স ফাইন্যান্সেও আর্থিক অনিয়ম হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক যে আমাদের শোকজ করল, তারা অডিটে কী পেয়েছে আমরা কিন্তু এখনো জানি না, তারা এ বিষয়ে বলেনি। যখন আমি ঋণ দিয়েছি, তখন সে খুব ভালো গ্রুপ, বিভিন্ন ব্যাংকও দিয়েছে, আমরাও দিয়েছে, সেই গ্রুপ এখন খারাপ হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী মন্দা যাচ্ছে, অনেক ক্লায়েন্টই এখন খারাপ করছে, আমাদের ভেতরের কোনো অনিয়মের কারণে যে ঋণগুলো ক্লাসিফাইড হয়েছে সেরকম না। প্রতিষ্ঠান ভালো ছিল ঋণ দেওয়া হয়েছে, এটার জন্য আমি দায়ী না।


সূত্র জানায়, অস্ট্রেলিয়াতে শিরিণ আখতারের দুটি বাড়ি আছে। মেয়েদের নামে থাকা বাড়ি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিরিণ আখতার বিবার্তাকে বলেন, আমার মেয়েরা একদম ছোটোবেলায় অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছে, ফুপুর কাছে। ওখানেই ওরা বড় হয়েছে। তারা নিজেরা প্রতিষ্ঠিত, আমার এখান থেকে কোনো টাকা দিয়ে ওখানে বাড়ি হয় নাই। তারা সেখানে লোন নিয়েছে, লোনের এগেইন্সটে তাদের ওখানে বাড়ি আছে।


এদিকে, ইন্তেখাব আলমের স্থলাভিষিক্ত ডিএমডি মোহাম্মদ সাইদুজ্জামানকে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।


এই বিষয়ে জানতে চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেসবাউল হককে বিবার্তার পক্ষ থেকে ফোন করা হয়। তবে তিনি কল রিসিভ করেননি।


বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, আজ ২৮ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকে এ সংক্রান্ত বৈঠক রয়েছে। সেখানেই পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।


উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি পাঠিয়ে বলেন যে, সংস্থাটির একটি পরিদর্শন প্রতিবেদনে ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের দ্বারা করা ঋণ অনিয়ম প্রকাশ পেয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমডিকে সাময়িক বরখাস্ত করে তাকে মানবসম্পদ বিভাগের সঙ্গে সংযুক্ত করে কোম্পানির জন্য নতুন প্রধান নির্বাহী নিয়োগের নির্দেশ দেয়।


বাংলাদেশ ব্যাংক ফিনিক্স ফাইন্যান্সের ওপর তাদের একটি বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে চিঠিটি পাঠায়। চিঠিতে বলা হয়, সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্ট (এফআইসিএসডি) কর্তৃক পরিচালিত বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে ফিনিক্স ফাইন্যান্সের এমডি ইন্তেখাব আলমসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের দ্বারা সংঘটিত অনিয়মের তথ্য উদ্‌ঘাটিত হয়েছে।


কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠিতে আরো বলা হয়, গ্রাহক প্রতিষ্ঠান এস এ অয়েল রিফাইনারি লিমিটেড, আমান সিমেন্ট মিলস ইউনিট-২, মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি, মাহিন এন্টারপ্রাইজ, ম্যাক স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ এবং গ্রাহক নাজমা পারভিন, ফারহান মোশাররফের ঋণে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রশাসনিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে প্রশাসনিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন থাকাকালীন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ থেকে বিরত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।


এদিকে, চলতি বছরের ২৫ মার্চ (সোমবার) বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ/নিযুক্তি এবং তার দায়দায়িত্ব সম্পর্কে নীতিমালা উল্লেখ করে একটি সার্কুলার জারি করেছে। যেখানে বলা হয়, কোনো ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বকালে কোনো কর্মকর্তা আর্থিক অনিয়মে জড়িত থাকলে– তাকে ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেব নিয়োগ ও পুনঃনিয়োগ করা যাবে না। এছাড়া কোনো কর্মকর্তা যদি খেলাপি গ্রাহক হন, কর খেলাপি হন অথবা পাওনাদারের অর্থ পরিশোধ বন্ধ করে দিয়েছেন কিংবা আদালত থেকে কোন সময়ে দেউলিয়া ঘোষিত হয়েছেন– এমনটা থাকলেও সেই কর্মকর্তা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হতে পারবেন না।


প্রসঙ্গত, ফনিক্স ফাইন্যান্স পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান। ১৬৬ কোটি টাকা পেইড আপের এই প্রতিষ্ঠানে ১৬ কোটি ৫৯ লাখ শেয়ার রয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য মতে, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখ পর্যন্ত, পরিচালকদের শেয়ার রয়েছে ২৯.১৭ শতাংশ, ইনস্টিটিউটের হোল্ডিং রয়েছে ২৩.০৫ শতাংশ এবং পাবলিক শেয়ার রয়েছে ৪৭.৭৪ শতাংশ।


২০০৭ সালে তালিকাভুক্ত ফনিক্স ফাইন্যান্স এর অথোরাইজড ক্যাপিটাল ৩০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে লং টার্ম লোন ৪১৮.৩ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটিতে ২২ কোটি ৩ লাখ টাকার নেগেটিভ ব্যালেন্স রয়েছে।


২০১৯ সালের পর প্রতিষ্ঠানটি বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয়নি। ২০১৯ সালে ৬ শতাংশ, ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭ সালে প্রতিবছর ২০ শতাংশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে তারা। তবে ২০১৮ সালেও কোনও ডিভিডেন্ড দেয়নি।


ফনিক্স ফাইন্যান্সের সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জের কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম জানান, কাগজপত্র না দেখে তিনি মন্তব্য করতে চান না। বিএসইসি’র কমিশনার অধ্যাপক শেখ সামছুদ্দিন আহমেদকে ফোন করলে তিনি কল রিসিভ করেননি এবং ক্ষুদে বার্তারও উত্তর করেননি।


বিবার্তা/এসবি/রোমেল/মাসুম

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com