
সম্প্রতি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬ লাখ টাকা। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতিমাসে স্বাস্থ্যসেবা বাবদ বরাদ্দ পাবেন মাত্র ৬ টাকা ৬৮ পয়সা। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সীমিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট সকলেই।
জানা যায়, গত ৩০ জুন ১০৪তম সিন্ডিকেট সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোশাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সোলায়মান ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৭৬ কোটি ১০ লাখ টাকার বাজেট উপস্থান করেন। সেখানে স্বাস্থ্য সহায়তা বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬ লাখ টাকা। যা প্রস্তাবিত মোট বাজেটের শূন্য দশমিক শূন্য সাত নয় (০.০৭৯%) শতাংশ। এর আগে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও ৬ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল স্বাস্থ্যখাতে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে অধ্যয়নরত ৬ হাজার ৮৮৮ জন শিক্ষার্থী, ২৮১ জন শিক্ষক এবং ৩০৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের মোট সদস্যসংখ্যা দাঁড়ায় ৭ হাজার ৪৭৬ জন। এরই প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দকৃত ৬ লাখ টাকা সমানভাবে ভাগ করলে প্রতিব্যক্তি মাসে গড়ে ছয় টাকা আটষট্টি (৬.৬৮) পয়সা ব্যয়ের সুযোগ পাবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সূত্রে জানা যায়, মেডিকেল সেন্টারের জন্য বরাদ্দকৃত ৬ লাখ টাকার মধ্যে ২ লাখ টাকা যন্ত্রপাতি ও বাকি ৪ লাখ টাকা ওষুধ ক্রয় বাবদ খরচ করা হবে। এছাড়া প্রতি মাসে ওষুধ ক্রয় করার জন্য উত্তোলন করা হয় ২৫ হাজার টাকা–যার মধ্যে ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা আবার ভ্যাট পরিশোধ করতেই চলে যায়।
এদিকে, মেডিকেল সেন্টারে রয়েছে চিকিৎসকের অপ্রতুলতা। বর্তমানে মেডিকেলে ডাক্তারের সংখ্যা মাত্র ৫ জন আবার এরমধ্যে ১ জন শিক্ষাছুটিতে থাকায় বর্তমানে মাত্র ৪ জন চিকিৎসক কর্মরত রয়েছেন। এছাড়া আছেন একজন নার্স এবং ৩ জন সাপোর্টিভ স্টাফ। এদিকে বিকাল পাঁচটার পর মেডিকেল সেন্টার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অসুস্থতার জন্য বাধ্য হয়ে শহরমুখী হতে হয় শিক্ষার্থীদের।
এসব সংকটের পাশাপাশি রয়েছে ওষুধেরও সংকট। বাজেট সংকুলান হওয়াতে মাত্র ১২ প্রকার ঔষধ দিয়েই চলছে চিকিৎসা সেবা। এছাড়া মেডিকেলে কোনো প্রকার অ্যান্টিবায়োটিক সরবরাহ না করায় অধিকাংশ ওষুধই বাহির থেকে ক্রয় করতে হয় শিক্ষার্থীদের। এতে করে আর্থিকভাবেও সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
আবার, বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স সংকটও। মাত্র দুইটি অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে শিফট অনুযায়ী একটি চলাচল করে। এছাড়া, রয়েছে পর্যাপ্ত জায়গা সংকটও। প্রশাসনিক ভবনের নিচতলায় একটি রুমকে কয়েকটি অংশে ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে মেডিকেল সেবা। ফলে মেডিকেল সেন্টারের প্রত্যাশিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
এর আগে, ২০২৩ সালের ২৮ আগস্টে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের পক্ষ হতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাসেবা উন্নত করার লক্ষ্যে কিছু আধুনিক মেডিকেল সরঞ্জাম প্রদান করা হয়েছে। সেসব সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে দুটি বেড, একটি এক্সরে ভিউ বক্স, একটি ইসিজি মেশিন এবং একটি অপারেশন-সামগ্রী জীবাণুমুক্ত করার অটোক্লেভ মেশিন। তবে এসব যন্ত্রপাতি সঠিকভাবে ব্যবহার না হওয়ায় সেগুলো থেকেও কাঙ্ক্ষিত সেবা বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা।
এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের ইফাত সাবরিন রিনি বলেন, ' বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে দীর্ঘদিন ধরেই অসন্তোষ রয়েছে। প্রয়োজনীয় ওষুধের ঘাটতি এতটাই প্রকট যে, প্রায় সব রোগের জন্য একই ধরনের গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ দিয়ে দায়সারা করা হয়। চিকিৎসকদের উপস্থিতি অনিয়মিত, ফলে অনেক সময় সেবা নেওয়াই সম্ভব হয় না—যেমন সম্প্রতি বিকাল ৪টার দিকে এক বন্ধুসহ মেডিকেলে গিয়ে আমরা কোনো ডাক্তার পাইনি। তাছাড়া একটি মানসম্পন্ন মেডিকেল সেন্টারে যে-সব মৌলিক চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকা উচিত, তার বেশিরভাগই অনুপস্থিত। এসব বাস্তব সমস্যার কারণে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসেবা কার্যকরভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।'
ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষের মো. নাজমুল হাসান ফাহিম বলেন, ‘কুবির মেডিকেল সেন্টার যেন হোমিওপ্যাথিক সেন্টার। হোমিওপ্যাথিক সেন্টারে যেমন যেকোনো রোগের জন্য একই দানা শিশিতে ভরে সকাল-বিকাল তিন বেলা খেতে দেওয়া হয়, তেমনই এখানেও নাপা ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না। না আছে জরুরি সেবা, না আছে ভালো ডাক্তার, না আছে চিকিৎসা সরঞ্জাম, যার ফলে সামান্য পেট ব্যথা হলেই কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে যাওয়া লাগে। সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হলো প্রায় সাত হাজার শিক্ষার্থীর জন্য বাজেট মাত্র ছয় লাখ টাকা।’
এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের প্রধান ডেপুটি চিফ মেডিকেল অফিসার ডা. মাহমুদুল হাসান বলেন, 'মোট ১০ লাখ যদি করা হয়, তাহলে ভালো হতো। কারণ পরিধি বাড়ছে। আমাদের শিক্ষক, শিক্ষার্থী তার স্টেক হোল্ডারদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ছয় লাখ টাকার মধ্যে চার লাখ আমাদের ঔষধে চলে যায়। আর বাকি দুই লাখ টাকা অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয়।'
সার্বিক বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো: হায়দার আলী বলেন, 'প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকার ঔষধ দেওয়া হচ্ছে। আমরা এটার জন্য চিন্তিত না। আমরা কীভাবে রাত পর্যন্ত মেডিকেল খোলা রাখতে পারি এটা নিয়ে ভাবছি। এরমধ্যে আমরা দুইজন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা ইউজিসিকে বলেছি আমাদের দুইজন ডাক্তার লাগবে। কিন্তু পদ না হওয়া পর্যন্ত নিয়োগ দেয়া যাচ্ছে না। যদি কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া যায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি দুইজন নার্স ও হেল্থ থেকে পাস করা দুইজন ডাক্তার দিয়ে বিকাল থেকে ৮ টা পর্যন্ত মেডিকেলটা খোলা রাখবো।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের এখন মূল লক্ষ্য হচ্ছে রাত পর্যন্ত মেডিকেলটা খোলা রাখা। ঔষধের বাজেট নিয়ে আমাদের অন্য পরিকল্পনা আছে, যার জন্য এ বছর পারছি না। আমার পরিকল্পনা হচ্ছে নতুন ক্যাম্পাসে ডায়াগনস্টিক সেন্টার তৈরি করা। যাতে শিক্ষার্থীরা অল্প খরচে উপকৃত হতে পারে। এই পরিকল্পনার জন্য অনেক টাকা লাগবে। এই বছরে আমরা সরকারের কাছে প্রজ্ঞাপন তৈরি করবো।'
বিবার্তা/প্রসেনজিত/এমবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]