
বাড়ির পাশের জমি থেকে মালিককে না বলে শসা খাওয়ায় কিশোর হৃদয়ের চাচা জমির মালিকের কাছে ক্ষমা চান। তবে হৃদয়ের গোষ্ঠীর লোকজন বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। এতে গোষ্ঠীর সম্মান গেছে বলে তারা খেপে যায়। পরে এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে রাত থেকে উত্তেজনা দেখা দেয়। প্রস্তুতি নিয়ে ভোর থেকে দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়ায়। গত ১০ জুন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার বুড়িশ্বর ইউনিয়নের শ্রীঘর গ্রামে এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হয়।
দিন গড়িয়ে রাত। এবার ঝগড়ার বিষয় টিস্যু। ঘটনা জেলার সরাইল উপজেলার। গত ১০ জুন রাতের এ ঘটনায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে ১৫ জন আহত হয়। একটি হোটেলে টিস্যু চাওয়াকে কেন্দ্র করে এই সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে অংশ নেয় কুট্টপাড়া ও পাঠানপাড়ার লোকজন। পাঠানপাড়ার একটি হোটেলে ওই দুই এলাকার যুবকের মধ্যে টিস্যু নিয়ে বিবাদ থেকে এই সংঘর্ষ হয়।
এভাবে গত মার্চ, এপ্রিল, মে, জুন ও জুলাই মাসে তুচ্ছ ঘটনায় কমপক্ষে ৩০০ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। এতে আহত হয় হাজারো মানুষ। নিহত হয় ছয়জন। দুজনের কবজি কেটে ফেলা হয় সংঘর্ষের সময়। হামলা থেকে বাদ পড়েননি ইউএনও, ওসিসহ পুলিশ সদস্যরাও।
সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ হয় জেলা সদরসহ সরাইল ও নাসিরনগর উপজেলায়। এ ছাড়া আশুগঞ্জ, বাঞ্ছারামপুর, নবীনগর ও বিজয়নগর উপজেলায়ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। মাঝেমধ্যে সংঘর্ষ হয় কসবা উপজেলায়।
স্থানীয় সূত্র জানায়, মূলত গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বেই এসব সংঘর্ষ বাধে। ৯টি উপজেলার পাঁচটি পৌরসভা ও ১০০ ইউনিয়নের প্রায় এক হাজার ৪০০ গ্রামের বেশির ভাগ স্থানে রয়েছে গোষ্ঠীগত ঐক্য। আবার কখনো কখনো এক গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য গোষ্ঠীর জোট বাঁধে। এলাকা ভিত্তিক ঐক্যও রয়েছে বিভিন্ন স্থানে। নিজ নিজ গোষ্ঠী কিংবা এলাকা ভিত্তিক নিজেদের সম্মান রক্ষায় কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি হয় না। অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের প্রভাব ঠিক রাখতে কখনো কখনো ঝগড়া উসকে দেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। আবার অনেক সময় প্রবাসীরাও এটাকে নিজেদের ইজ্জত রক্ষার লড়াই হিসেবে দেখে টাকা ছড়িয়ে দেন।
সংঘর্ষকারীদের বেশির ভাগই দেশীয় অস্ত্র, যেমন—দা, লাঠি, বল্লম ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে। সংঘর্ষে অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের রক্ষায় মাথায় হেলমেট পরে। সংঘর্ষপ্রবণ এলাকার বেশির ভাগ বাড়িতেই দেশীয় অস্ত্র থাকে। জানা গেছে, এসব সংঘর্ষের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মামলা করা হয় না। নিয়মিত সংঘর্ষ কমাতে সরাইল উপজেলা প্রশাসন প্রতিটি ইউনিয়নে সচেতনতামূলক সমাবেশ করার উদ্যোগ নিয়েছে।
গত ২২ জুন বিজয়নগর উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের চানপুরে রেলওয়ের জায়গা নিয়ে দুই পক্ষের বিরোধে মো. ইদ্রিস মোল্লা (৬৫) নামের এক বৃদ্ধের বাঁ হাতের কবজি কেটে ফেলা হয়। এ ঘটনার পর গত ২৬ জুন নবীনগর উপজেলার নাটঘর ইউনিয়নের চড়িলাম গ্রামে রফিকুল ইসলাম (৫০) নামের এক ব্যক্তির কবজি বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। স্বজনদের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে তাঁর ওপর এই হামলার ঘটনা ঘটে।
আশুগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামে বিদ্যালয় আঙিনা ও কবরস্থান থেকে ফুল ছেঁড়াকে কেন্দ্র করে ২২ জুন সংঘর্ষে সাতজন পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়। মহাজনের বাড়ি ও জাকেরবাড়ির লোকজনের মধ্যে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
গত ১৬ জুন সদর উপজেলার সুলতানপুর ইউনিয়নের উড়শিউড়ায় পারিবারিক সংঘর্ষে মনির হোসেন নামের এক ব্যক্তি খুন হন। রান্নার চুলার ধোঁয়া ঘরে যাওয়াকে কেন্দ্র করে স্বজনদের হামলায় মনির হোসেন মারা যান বলে অভিযোগ করা হয়।
গত ১৩ জুন রাতে টর্চলাইট জ্বালিয়ে বিজয়নগর উপজেলার বুধন্তী গ্রামে বিএনপি নেতা চমক মিয়া এবং সাবেক যুবদল নেতা মিজানুর রহমানের লোকজনের মধ্যে হামলা-পাল্টাহামলা হয়।
সরাইল সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জব্বার বলেন, ‘এক গোষ্ঠীর লোকজনকে আরেক গোষ্ঠীর লোক মেরে দিলে এটা সহ্য হয় না। এ বিষয়ে কেউ কাউকে ছাড় দিতে চায় না। সে কারণে আমাদের এলাকায় ঝগড়া-ফ্যাসাদ লেগেই থাকে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মো. বাহারুল ইসলাম মোল্লা বলেন, ‘অনেক সময় দেখা যায়, জেলার অনেক সাফল্য ঢাকা পড়ে যায় ঝগড়ার খবরে। কারণে-অকারণে ঝগড়ার এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়ব।’
সচেতন নাগরিক কমিটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুন নূর বলেন, ‘এত বেশি ঝগড়ার পেছনে বিচারহীনতার সংস্কৃতি দায়ী। যার যতটুকু শাস্তি প্রাপ্য, তা নিশ্চিত করা হলে ভবিষ্যতে কেউ আবার কিছু করতে ভাববে।’
বিবার্তা/আকঞ্জি/এসএস
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]