বঙ্গবন্ধুর সম্পূর্ণ জীবনটাই বাংলাদেশের ইতিহাস। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার সেই প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শিশু মুজিব থেকে কিশোর, কিশোর মুজিব থেকে যুবক, যুবক মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু মুজিব, বঙ্গবন্ধু মুজিব থেকে পিতা মুজিব হয়ে ওঠার গল্প কিন্তু সহজ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর শৈশব-কৈশোর এবং যৌবন থেকে পরিণত মুজিব পর্যন্ত তাঁর জীবনের প্রত্যেকটি অধ্যায়ই চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে, বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল এই বাঙালি জাতির জন্য, ভাবার জন্য এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য।
একটি জাতির জন্য কতটুকু ভালোবাসা থাকলে একজন মানুষ তাঁর জীবনের সবটুকু সময় ব্যয় করতে পারেন সেই জাতির ভাগ্যোন্নয়নের জন্য। আর একটি জাতি কতটুকু অকৃতজ্ঞ হলে সেই মানুষটির বুক বুলেটের আঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো শব্দ মালায় গাঁথা সম্ভব নয়। তবে বুলেটের আঘাতে রক্ত মাংসের শরীরটা ছিদ্র করা গেলেও পিতা মুজিবের আদর্শ কিন্তু চির অম্লান হয়ে বাঙালি জাতির মনের মনিকোঠায় বিরাজমান।
বঙ্গবন্ধুর জীবনে যদি কোনো দুর্বলতা থেকে থাকে সেটি হলো তাঁর বুকে বাংলার মানুষের জন্য সীমাহীন ভালোবাসা। আর সেজন্যই নিজের কথা না ভেবে, পরিবারের কথা না ভেবে জীবনের স্বর্ণ সময় ব্যয় করেছেন সেই বাঙালিদের ভাগ্যোন্নয়নে। বঙ্গবন্ধু চরিত্রের সব থেকে বড় গুণ বাংলার আপামর জনগণের উপর তাঁর অসম্ভব নিয়ন্ত্রণ ছিল। আর সেই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলার জনগণের প্রতি তাঁর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার জন্য। বাংলার মানুষ বিশ্বাস করতেন যে, বঙ্গবন্ধুতেই বাঙালি জাতির মুক্তি নিহিত। আর সে জন্যই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জমায়েত হয়েছিল প্রায় দশ লক্ষ মুক্তিকামী বাঙালি।
রাজনীতির কবি সেই দিন জনতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে যে কবিতা রচনা করেছিলেন সেই কবিতার প্রেরণা থেকে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙেছিলাম আমরা। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম"। বাঙালি জাতির মুক্তির যে কবিতা সেদিন বঙ্গবন্ধু রচনা করেছিলেন সেই কবিতা আজ পর্যন্ত বাঙালি জাতিকে আলোর দিশারী হয়ে পথা দেখাচ্ছে। কষ্ট লাগে ভাবতে যে মানুষটি বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য নিজের সর্বোত্তম ত্যাগ করেছেন, সেই মানুষটিকে এই বাঙালিরাই নির্মমভাবে সপরিবার হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধুকে শুধু হত্যা করেই ঘাতকরা থেমে থাকেনি। একটি জাতি কতটুকু অকৃতজ্ঞ হলে ইতিহাসের পাতা থেকে বঙ্গবন্ধুর নামটি মুছে ফেলে ভুল ইতিহাস লেখার পায়তারা করেছে, এর জবাব কেউ দিতে পারবে না।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এই একুশটি বছর বাংলাদেশের আপামর জনগণের সাথে বেঈমানি করা হয়েছে। বাংলার ১৯৭৫ পরবর্তী প্রজন্মকে শেখানো হয়েছে ভুল ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন তার বাস্তবায়ন যদি ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যবর্তী সময়ে হতো তাহলে বাংলাদেশের উন্নয়নের চিত্র দেখতে আমাদের এতদিন অপেক্ষা করা লাগতো না বলে। পিতা মুজিবের বাংলাদেশের উন্নয়ন ততোদিন স্থবির ছিল যতদিন স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাই বোধহয় একজন সন্তান, যে পিতা-মাতাসহ পরিবারের সবাইকে হারিয়ে শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে যে কেউ বঙ্গবন্ধু সোনার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে সোনার বাংলা গড়ার ক্ষমতা রাখে, তার জীবিত উদাহরণ।
বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁর দেশ পরিচালনার পরিকল্পনার কৌশল যেমন ছিল, শেখ হাসিনার কৌশলও ঠিক তাই। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই বাঙালি জাতির ভাগ্য তরীর হাল ধরেছিল ধমনীতে পিতা মুজিবের রক্ত বহনকারী শেখ হাসিনা। আর যারই ফলশ্রুতিতে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার দুইবার ৭% অতিক্রম করেছিল, একবার বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এবং দ্বিতীয়বার বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে।
বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়নের চিত্র উল্লেখ না-ই করলাম, তবে একটা কথা ভেবে দেখবেন যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে যদি ঘাতকদের বুলেটের আঘাত থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা রক্ষা না পেত, তাহলে আজ বাংলাদেশের এই উন্নয়নের ইতিহাস ভিন্নভাবে, ভিন্ন কালিতে লেখা হতো। ভুলে যাবেন না, এই বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে কারা বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দিতে চেয়েছিল, কারা নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ভুল ইতিহাস শিখিয়েছিল, কারা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে এই দেশে প্রতিষ্ঠিত করে বাংলার মাটিকে কলঙ্কিত করেছিল, কারা এই দেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল, কারা এই বাংলাদেশে শায়খ আব্দুর রহমান এবং বাংলা ভাইয়ের মতো জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছিল, কারা বঙ্গবন্ধু পরিবারের শেষ চিহ্ন বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে ২০ বারের বেশি চেষ্টা করেছে।
প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার প্রত্যেকটি স্তরে বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত করা এখন সময়ের দাবি। নতুন প্রজন্ম যেন সঠিক ইতিহাসের আলোয় আলোকিত হয়ে নিজেরাই বুঝতে পারে যে, শিশু মুজিব থেকে কিশোর মুজিব, কিশোর মুজিব থেকে যুবক মুজিব, যুবক মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু মুজিব, বঙ্গবন্ধু মুজিব থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠার পেছনের গল্প।
পরিশেষে নির্মলেন্দু গুণের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে "সমবেত সকলের মতো আমারো স্বপ্নের প্রতি পক্ষপাত আছে, ভালোবাসা আছে; শেষ রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি। আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
এই বসন্তের বটমূলে সমবেত ব্যথিত মানুষগুলো সাক্ষী থাকুক, না-ফোটা কৃষ্ণচূড়ার শুষ্কভগ্ন অপ্রস্তুত প্রাণের ঐ গোপন মঞ্জরীগুলো কান পেতে শুনুক, আসন্ন সন্ধ্যার এই কালো কোকিলটি জেনে যাক; আমার পায়ের তলায় পুণ্য মাটি ছুঁয়ে আমি আজ সেই গোলাপের কথা রাখলাম, আজ সেই পলাশের কথা রাখলাম, আজ সেই স্বপ্নের কথা রাখলাম"।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিবার্তা/মৌসুমী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]