‘দেয়াল’ উপন্যাসের ভূমিকায় প্রফেসর আনিসুজ্জামান লিখেছেন, এই উপন্যাস নিয়ে যতই সমালোচনা হোক, আমি জানি হুমায়ূনের অন্য বইয়ের মতো এই বইটিও পাঠকসমাদৃত হবে।
হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে এই লেখনী হয়তো আনিসুজ্জামানের শ্রদ্ধা এবং ভূমিকা লেখার দায়। তবে পাঠক হিসেবে আমাদেরও কিছুটা দায় রয়েছে। আর সেখান থেকেই এই বিনীত সূত্রপাত :
ইতিহাস নিয়ে লেখা ঐতিহাসিকদের দায়বদ্ধতা। আর সে দায়বদ্ধতা সবাই নিতে জানে না বা পারেও না। হুমায়ূন আহমেদ সে সাহস করেছেন। এজন্যে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। তবে এও বলতে দ্বিধা নেই, তিনি যেভাবে একজনকে ও তার পরিবারকে হিরো বানানোর চেষ্টা করেছেন তা সত্যিই আপত্তিকর। আর এর দায়ভার তাঁকে নিতেই হবে।
উপন্যাসের প্লট বিবেচনায় মেজর রশিদ, মেজর ডালিম, কর্নেল ফারুক প্রমুখের নেতৃত্ব এবং জিয়াউর রহমান, খন্দকার মুশতাকের প্ররোচনা ও সম্মতিতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। বিপথগামী এই চক্রকে গ্রেফতার করে সেনাপ্রধান হন মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ।
কিন্তু রক্তপাতের খেলা তখনও শেষ হয়নি। বন্দী জেনারেল জিয়া তাঁর বন্ধু কর্নেল তাহেরের কাছে সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠালেন। ব্যস, তাহের সাহেব সিপাহীদের দিয়ে স্লোগান তুললেন, ‘সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই, হাবিলদারের উপর অফিসার নাই’, ‘সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’।
আর এভাবেই মৃত্যু ত্বরান্বিত হয় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের গ্রেফতারকারী এবং প্রথম প্রতিবাদকারীদের একজন মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ এবং তার সহযোগী মেজর হুদা, মেজর হায়দার প্রমুখের।
দূর্ভাগা খালেদ মোশারফ! তিনি যেদিন সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নিলেন ঠিক সেদিনই আকস্মিকভাবে ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার ভোরা এলেন তাঁর সাথে দেখা করতে এবং সেদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্যে মিছিল হলো এবং তার অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিলেন খালেদ মোশারফের মা। সব মিলিয়ে একটা চক্রের ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং সামগ্রিক সংকট সবটাকে মিলিয়ে দারুণ প্রোপাগান্ডায় এগিয়ে চলল তাদের ষড়যন্ত্র।
কিন্তু বিস্ময়কর বিষয় হলো, লেখক তাঁর উপন্যাসের প্লট সম্পর্কে পাঠককে স্বচ্ছ ধারণা দিলেও একটা সময়ে কর্নেল তাহেরের দিকে ঝুঁকে গেছেন, যেখানে খোদ ইতিহাস তাহেরের বিরুদ্ধে। কর্নেল তাহেরের যোগ্যতা নিয়ে কারো প্রশ্ন নাও থাকতে পারে! কিন্তু এও তো মানতে হবে, যোগ্যতার অর্থ সাতখুন মাফ নয়।
ভিন্নভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের যে মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ গ্রেফতার করেছিলেন সেই ব্যক্তি কর্নেল তাহেরের কারণে মারা পড়লেন। কিন্তু তাঁর জন্যে লেখকের কলম থেকে এক ফোঁটা অশ্রু বের হলো না। বরং ইঙ্গিত করলেন নায়ক (!) তাহেরের প্রস্থানকে।
রক্তপাতের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল ছিল তখনকার মৌলিক বাস্তবতা। আর তাই হয়তো রক্তপাতকে ঘৃণা করা মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ তখনকার বাস্তবতা এবং লেখকের সুদৃষ্টি কোনোটাই পাননি।
জিয়া ক্ষমতা দখলের দু’মাসের মাথায় ১,১৪৩ জন জওয়ান এবং অফিসারকে হত্যা করা হয়েছিল। এর দায়ভারও কিন্তু তাহেরকেই নিতে হবে। কারণ, খাল কেটে কুমিরটা কিন্তু তিনিই এনেছিলেন!
তবে চরিত্র বিচারে হুমায়ূন আহমেদ গদিনসীন পীর হাফেজ জাহাঙ্গীর চরিত্রটির গভীরতা এঁকেছেন চমকপ্রদ এবং চমৎকারভাবে। এই চরিত্রটির মাধ্যমে পাঠক বুঝতে পারেন তখনকার ধর্মীয় চাতুর্যের ফাঁকে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের পাঁয়তারাকে। আবার এও সত্য, পীর চরিত্রটির দ্বারা তিনি এঁকেছেন সমাজের শিক্ষিত শ্রেণীর অন্ধ বিশ্বাসের ছবি এবং তাদের অসহায় আত্মসমর্পণকে।
ইতিহাসকে আশ্রয় করে উপন্যাস নির্মাণ কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। হুমায়ূন আহমেদ সেই কঠিনেরে ভালবেসেছেন। আর এজন্যে হলেও তাঁর প্রতি রইবে অগাধ শ্রদ্ধা। তবে সাথে এও বলব, ইতিহাসের আশ্রয় করে এগোতে গিয়ে তিনি একপাক্ষিক চিন্তায় ডুবে গেছেন।
বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]