শিরোনাম
দেশের রাজনীতি নিয়ে যদি আমরা না ভাবি, ভাববে কে?
প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০১৭, ১৮:৩৯
দেশের রাজনীতি নিয়ে যদি আমরা না ভাবি, ভাববে কে?
আদম তমিজি হক
প্রিন্ট অ-অ+

মানুষ পরিবর্তনশীল, তবে পরিবর্তনে আগ্রহী না। আমরা কমবেশি সবাই সমালোচক, তবে সমালোচিত হতে চাই না। আমাদের দেশে এখনো মানুষ বিশ্বাস করে, আলাদিনের চেরাগ বলতে সত্যিই কিছু একটা আছে। এ চেরাগই সব ঠিক করে দেবে।


অন্যদিকে রাজনীতির প্রশ্নে আমাদের অনেকেই বলে, রাজনীতি বুঝি না অথবা এই নোংরা রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে আমার ভাল লাগে না ইত্যাদি। একটা জিনিস বুঝতে পারি না, এভাবে রাজনীতিকে এড়িয়ে চলা আর কতদিন চলবে? আমরা কথায় কথায় রাজনীতিবিদদের গালি দেব আবার রাজনীতির প্রশ্নে এসে এসব কথা বলে এড়িয়ে যাব। এভাবে চললে কি আমাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? নাকি একদিন এমন একটা জায়গায় আমরা চলে যেতে পারি যেখান থেকে আমাদের আর সুস্থ রাজনীতিতে ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না?


ব্যাপারগুলো নিয়ে আমরা একবারও ভাবছি না। কিন্তু দেশের রাজনীতি নিয়ে যদি আমরা না ভাবি, ভাববে কে? আমরা যদি মাথা না ঘামাই, ঘামাবে কে? বর্তমান ধারার রাজনীতির পরিবর্তনের শুরু যদি আমরা না করি, করবে কে?


নতুন ধারার রাজনীতির কথা বলা হয়, সুস্থ রাজনীতির কথা বলা হয়, পরিবর্তনের কথা বলা হয়। প্রতিদিন টক শোতে, সম্পাদকীয়তে, ব্লগে, ফেসবুকে, মাঠে, বাজারে, চায়ের দোকানে সব জায়গায় পরিবর্তনের কথা। সবাই পরিবর্তন চায়। কিন্তু এই পরিবর্তন কি আপনাআপনি চলে আসবে নাকি আলাদিনের যাদুর ছোঁয়ায় পরিবর্তন হয়ে যাবে? আসলে এসব ঘরে বসে বসে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের গালি দিলে শুধু আড্ডাটাই জমজমাট হবে, দেশের কোনো লাভ হবে না, পরিবর্তনও আসবে না।


আমরা যদি আসলেই পরিবর্তন চাই, আমাদের সমাজে সুস্থ ধারার রাজনীতি চাই, আমাদেরই সেটা করতে হবে। আলাদিনও এসে করে দেবে না আর আমেরিকা থেকে এসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও করে দিয়ে যাবেন না। আমাদের সমস্যার সমাধান একমাত্র আমরাই করতে পারি।


অনেকেই বলতে পারেন, হাজার কালিমামাখা এই রাজনীতিকে পরিবর্তন করা কি সম্ভব? অথবা বলতে পারেন, একাজ করতে গেলে তো অনেক প্রতিবন্ধকতা আসবে। হ্যাঁ, আসবে। কিন্তু সম্ভব। পরিবর্তন একদিনে হবে না, একশ' দিনেও হবে না, একশ' বছরেও না-ও হতে পারে। কিন্তু একদিন ঠিকই হবে। হবেই। কিন্তু শুরুটা তো করতে হবে! শুরু না করেই তো আমরা শেষের কথা চিন্তা করতে পারি না।


পরিবর্তনের শুরু করতে হলে প্রথমেই যেটা করতে হবে, আমাদেরকে রাজনীতি চর্চা করতে হবে, রাজনীতি নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা করতে হবে, রাজনীতিসচেতন হতে হবে। রাজনীতির প্রশ্নে আমাদের এড়িয়ে গেলে চলবে না, আমাদের সেটা মোকাবেলা করতে হবে। রাজনীতি এমন জিনিস না যে কোনো দলে নাম লিখালাম আর রাজনীতি বুঝে গেলাম। রাজনীতি বুঝতে হলে আমাদের সেটা চর্চা করতে হবে। কোনো ধরনের অপরাজনীতি আমাদের সামনে বাধা হতে চাইলে আমাদের রাজনৈতিক মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়েই সেটার মোকাবেলা করতে হবে। রাজনীতি নিয়ে চর্চা না করলে সেটা কোনোদিন সম্ভব হবে না।


একটু রাজনীতি চর্চা করলে ভবিষ্যতে আমরা কী পেতে পারি সেটা আমাদের পাশের দেশ ভারতের দিকে তাকালেই বুঝতে পারব। সেখানে কিছুদিন আগে প্রথাগত রাজনৈতিক দলের বাইরে থেকে নতুন একটা দল আম আদমি পার্টি ক্ষমতায় এসেছে, যারা দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে, দেশের মানুষের জন্য কিছুর করা্র তাগিদ নিয়ে রাজনীতিতে এসেছিল এবং তারা ক্ষমতায়ও অধিষ্ঠিত হয়েছে। এই আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল পেশায় একজন প্রকৌশলী ছিলেন। তিনি হঠাৎ করে কিভাবে মুখ্যমন্ত্রী হলেন? রাজনীতি কি এমন যে ইচ্ছা হল আর রাজনীতিবিদ হয়ে গেলাম! না, রাজনীতি একটা চর্চার বিষয় যেটা উনি এবং উনার দলের অন্যান্যরা করে এসেছিলেন অনেক আগ থেকেই এবং তারা যে ক্ষমতায় সেটা সেই চর্চারই ফল।


আমাদেরও সময় এসেছে রাজনীতিসচেতন হয়ে ওঠার। সেটা হোক দেশের প্রতি ভালবাসা থেকে, দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে, দেশের মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদ থেকে।


রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন করার নাম দিয়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকে এসি ঘরে বসে তৃতীয় শক্তি বলে নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম দেওয়ার প্রয়োজন নেই। রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের জন্যে দুটো বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ক, দেশের সকল মানুষকে শিক্ষিত করে তোলা (কারণ অশিক্ষিত মানুষ গুজব আর মিথ্যাচারে বেশি বিশ্বাস করে)। খ, দারিদ্র থেকে মুক্তি এবং কর্মসংস্থান।


যেদেশে ১০০ টাকা দিলে মানুষ পাওয়া যায় গাড়িতে পেট্রোল বোমা মারতে, ৫০০ টাকা দিলে মানুষ মানুষকে খুন করে সেদেশে রাতারাতি রাজনৈতক সহিংসতা বন্ধ করা যেমন সম্ভব না, তেমনি রাজনীতিতে আদর্শচর্চাও পুরোপুরি সম্ভব নয়। যারা রাস্তাঘাটে ভাঙ্গচুর, সহিংসতা করে তাদের মাঝে আপনি চাকুরিজীবী পাবেন না ১ভাগ। চাকুরিজীবী যতই সে কোনো না কোনো দলের ভক্ত হোক , রাস্তায় নেমে মারামারি করবে না। কারণ, তার একটা নিশ্চিত জীবন আছে, আয়ের ব্যবস্থা আছে। অন্যদিকে যারা সহিংসতা চালায় তাদের বেশিরভাগই বেকার আর দরিদ্র জনগোষ্ঠী।


কেউ বলতে পারেন, এটা তো অনেক দীর্ঘমেয়াদি বিষয়। আসলে তাই। রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন করে সমাজ কিংবা রাষ্ট্র পরিবর্তন করতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। এটা আলাদিনের চেরাগ না যে ঘষা দিলাম আর তারপরের দিন থেকে দেশের সব মানুষ খুব সহনশীল আর সৎ হয়ে গেল। যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে দেশের সর্বস্তরে গণজাগরণ সৃষ্টি করতে আমাদের ৪২ বছর লেগেছে, সেখানে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতেও আরো ৪২ বছর, হয়তো আরো বেশি লাগবে। মানুষ শিক্ষিত হয়ে গেলেও কিন্তু সমস্যার সমাধান নাও হতে পারে, যদি ওই মানুষগুলো রাজনীতিকে তাদের জীবন থেকে বাদ দিয়ে দেয়।


রাজনীতি একটা প্র্যাকটিস, যে প্র্যাকটিসটা সবার করতে হবে। রাজনীতির প্র্যাকটিস করলে যে আমরা সবাই রাজনীতিবিদ হয়ে যাব সেই রকমটা কিন্তু না, সেটা করলে আমরা রাজনীতিতে নিজেদের জড়াতে পারব, রাজনীতির ভাল-মন্দে আমরা নিজেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারব।


এই জন্য দরকার চর্চা, যার মাধ্যমে আসতে পারে রাজনৈতিক সচেতনতা। সেটা এলে একদিন আমরা নিজেরাই ফিল করতে পারব দেশের স্বার্থে আমাদের কি করা দরকার। আমাদের রাজনীতিকে এড়িয়ে গেলে, অবহেলা করলে চলবে না । এটাকে সাথে নিয়েই আমাদের চলতে হবে।


সচেতনতা তৈরি করে শিক্ষা। মানুষ যখন সুশিক্ষিত হয় তখন তার মাঝে সচেতনতা তৈরি হয়। অশিক্ষিত আর সুবিধাবাদী মানুষের রাজনৈতিক জ্ঞান হলো - এই দেশের বড় দুই দলই সমান। কিন্তু বাস্তবে দুটি দল কখনো সমান হতে পারে না, বাংলাদেশেও নয়। আর সহিংসতা বন্ধ করবে দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা। একটা মানুষের যখন নিশ্চিত আয়ের পথ থাকবে ( চাকরি/ব্যবসা) সে কখনো রাস্তায় নেমে গাড়ি ভাঙ্গচুর করবে না। ভাঙ্গচুর তারাই করে যাদের জীবন অনিশ্চিত অন্ধকারে। যাদের ধর্মীয় অজ্ঞতা দ্বারা ব্রেইন ওয়াশ করা হয়, তারা ত্রাস সৃষ্টি করে দলের মাঝে নিজ অবস্থান সৃষ্টি করতে চায়।


আমাদের সবার জীবনের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্তই রাজনীতির সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। অথচ, এই রাজনীতিকে নিয়েই আমাদের সমাজে রয়েছে নানা নেতিবাচক গুঞ্জন। অনেকেরই ভাষ্যমতে, রাজনীতি একটি খারাপ কাজ। এটি খারাপ মানুষেরা করে থাকেন। এখানে অপকর্ম ছাড়া আর কিছুই হয় না, ইত্যাদি ইত্যাদি। এটি একেবারেই ভুল ধারণা।


প্রকৃতপক্ষে, রাজনীতি ভালো জিনিস হতে পারে, যখন আমরা মানুষকে টেবিলে বসতে, একসঙ্গে কাজ করতে এবং ভালো কাজের জন্য উৎসাহ দিতে পারি। রাজনীতি কোনো পণ্য নয়, তবে একটি প্রক্রিয়া। অন্যান্য মূল্যবোধের মতো এটির জাল নোটও রয়েছে। সত্যের তাৎপর্যকে কবর দেয়া কিংবা নির্দোষ ও আন্তরিক সেবা পরিবর্তনের বদলে চটকদার এবং চূড়ান্ত স্বার্থপরতার অর্থ প্রকাশ করা রাজনীতির উদ্দেশ্য নয়।


রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের জানা উচিত। কারণ রাজনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তবে খুব জটিল কিছু না। একটা ভালো রাজনীতি ভালো নেতা তৈরি করে। আর ভালো নেতা সমাজের জন্য কাজ করেন। সুষ্ঠু রাজনীতির থাকলে দুর্নীতি রোধ করা, সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হয়। সমাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, বিচারবিভাগকে শক্তিশালী করে তোলা, সাধারণ মানুষের সাথে নেতার সম্পর্ক উন্নয়ন করা এগুলো একমাত্র ভালো রাজনীতির বিদ্যা চর্চা দ্বারাই সম্ভব।


পরিশেষে বলব, শুরুটা তো করি। শুরু করলে একদিন লক্ষ্যে পৌছবই অথবা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে দিতে পারব এমন একটা জায়গা, যেখান থেকে লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে সহজেই।


লেখক : চেয়ারম্যান, হক গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ লি.


বিবার্তা/হুমায়ুন/কাফী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com