১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের ঘটনা নিয়ে ধোঁয়াশার শেষ নেই। দেশী-বিদেশী কুশীলবদের ষড়যন্ত্র এবং উচ্চাভিলাষী গুটিকতক পথভ্রষ্ট সেনাকর্মকর্তার নির্মমতায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে পরিবারসহ নৃশংসভাবে হত্যার পর বাংলাদেশের ইতিহাসে যে কালো অধ্যায়ের শুরু হয়েছিল, থেমে থেমে তার পুনরাবৃত্তি হয়েছে অসংখ্যবার। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাস ছিল ভয়াবহ রক্তপাতের মাস।
নভেম্বর মাসের এ ভয়াবহ রক্তপাতের ঘটনাগুলোর বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস জানার জন্য মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। কিন্তু পুরো বিষয়টাকে আরও ধোঁয়াটে করেছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখকের ভুল ইতিহাস রচনা আর কাউকে বেঈমান কিংবা হিরো বানানোর প্রবণতা।
এ বিষয়টি নিয়ে আমি ওই সময়ের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের নিউজ এবং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু লেখা এবং কয়েকটি বইয়ের কিছু অংশ এ লেখায় সংযোজন করব।
ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ৩ নভেম্বর রক্তপাতহীন সেনাঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। জিয়াকে ২ নভেম্বর থেকে গৃহবন্দী করা হয়। ধারাবাহিকভাবে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত বর্ণনা করা প্রায় অসম্ভব,কারণ ক্যান্টনমেন্ট থেকে বঙ্গভবন পর্যন্ত এমন হ-য-ব-র-ল পাকিয়েছিল যে ক্রমানুসার করাই সম্ভব নয়। তবে এটা স্পষ্ট, ৩ নভেম্বর জেলহত্যা সম্পর্কে জিয়া ও তাহের ভালোভাবেই অবগত ছিলেন। জিল্লুর রহমান খান ও ডালিমের লেখায় এটা স্পষ্ট।
খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানটি ছিল প্রায় রক্তপাতবিহীন । কিন্তু ১৫ আগস্টের কুশীলবরা সেই রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের প্রতিউত্তরে নৃশংস রক্তপাতের মাধ্যমে পুনরায় ইতিহাসে আরেকটি কালো অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছিল। এর নেপথ্যে খন্দকার মোশতাক, জিয়া, তাহেররা ছিল - এটা মোটামুটি নিশ্চিত। কর্নেল হামিদের বইতে উল্লেখ আছে, কর্নেল তাহেরের মূল উদ্দেশ্য ছিল জিয়ার কাঁধে ভর করে ক্ষমতা দখল করা। ৭ নভেম্বর খালিদ মোশাররফকে হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করে, জিয়াকে মুক্ত করে কর্নেল তাহের তার উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছিল । কিন্তু ধুরন্ধর জিয়া যে হিসাব-নিকাশে তার থেকেও পরিপক্ক, সেটা তাহের বুঝতে পারেনি । জিয়া সাধারণ সেনা আর মানুষের দোহাই দিয়ে নিজেকে সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করলে তাহেরের সম্বিত ফিরে আসে। কিন্তু সে ধুরন্ধর জিয়ার তো কিছুই করতে পারেনি বরং পরবর্তীতে নিজেই প্রাণদন্ডে দন্ডিত হয়।
যদিও ৭ নভেম্বরের এই ভয়াল রক্তপাতের মূল কারিগর কিন্তু তাহেরের অনুসারী সেনা আর জাসদের কর্মীরা ছিল (যদিও জিয়া সবই জানতেন), এজন্যই কর্নেল হামিদ তার বইয়ের একটি জায়গায় উল্লেখ করেছেন, “তার (তাহের) ক্যালকুলেশনে ভুল হয়েছিল।”
জিয়া এতই চতুর ছিলেন যে,পুরোনো কুশীলবদের ব্যবহার করে ধীরে ধীরে সবকিছুই নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছিলেন, যার কিছুটা অনুভব করা যায় ‘৭৫ সালের ৭ নভেম্বর-পরবর্তী প্রায় প্রতিটি জাতীয় দৈনিকের নিউজ দেখলে। প্রায় প্রতিটি পত্রিকাতেই এ নৃশংস ঘটনাটিকে দেখানো হয়েছে জাতীয় অর্জন হিসেবে আর অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে মোশতাক-জিয়া-তাহেরকে বানানো হয়েছিল হিরো।
সবকিছু মিলিয়ে আমি বলতে চাই,৭ নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো অর্জন তো নয়ই বরং কলঙ্ক। এর মূল কারিগর কিন্তু একই - সেই ১৫ আগস্টের কুশীলব মোশতাক-জিয়া-তাহের এবং তাদের অনুসারী পথভ্রষ্ট সেনাকর্মকর্তারা।
বিভিন্ন লেখকের বইয়ে তাদের বর্ণনায় ৭ নভেম্বর
★ “৬ তারিখ রাত ১২ টায় সিপাহী বিপ্লবের খবর পেয়ে জেনারেল খালেদ মুশাররফ সঙ্গে সঙ্গে তার প্রাইভেট কার নিয়ে বঙ্গভবন থেকে দ্রুত বেরিয়ে যান। তার সাথে ছিল কর্নেল হুদা ও হায়দার। খালেদ প্রথমে রক্ষীবাহিনী প্রধান ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের বাসায় যান। নুরুজ্জামান তাকে খাকি ড্রেস পাল্টিয়ে নিতে অনুরোধ করেন। সে তার নিজের একটি প্যান্ট ও বুশ শার্ট খালেদকে পরতে দেয়। ৪র্থ বেঙ্গলে সর্বশেষ ফোন করলে ডিউটি অফিসার লে: কামরুল ফোন ধরে। সে তাকে প্রকৃত অবস্থা অবহিত করেন। এবার খালেদ বুঝতে পারেন অবস্থা খুবই নাজুক। তিনি অবস্থান পরিবর্তন করে শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত ১০ম বেঙ্গল রেজিমন্টে আশ্রয় গ্রহন করতে যান। প্রথমে নিরাপদেই তার বিশ্বস্ত ইউনিটে আশ্রয় নেন। কমান্ডিং অফিসার ছিলেন কর্নেল নওয়াজিশ। তাকে দেওয়া হয় খালেদের আগমনের সংবাদ। তিনি তাৎক্ষনিক টেলিফোনে টু-ফিল্ডে সদ্যমুক্ত জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তার ইউনিটে খালেদ মুশররফের উপস্থিতির কথা জানিয়ে দেন। জিয়ার সাথে জলিলের ফোনে কিছু কথা হয়। কর্নেল আমিনুল হক বলেছেন, তিনি ওই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং জিয়াকে বলতে শুনেছেন, যেন খালেদকে প্রাণে মারা না হয়। যাহোক, ভোরবেলা দেখতে দেখতে সিপাহী বিদ্রোহের প্রবল ঢেউ ১০ম বেঙ্গলে গিয়ে লাগতে শুরু করল। পরিস্থিতি কর্নেল নওয়াজিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তারা খালেদ ও তার সহযোগীদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সিপাহীরা তাদের টেনে হিচড়ে বের করে। জানা গেছে, মেজর জলিল কয়েকজন উত্তেজিত সৈনিক নিয়ে মেসের ভিতর প্রবেশ করে। তার সাথে একজন বিপ্লবী হাবিলদারও ছিল। সে চিৎকার দিয়ে জেনারেল খালেদকে বলল, ‘আমরা তোমার বিচার চাই।’ খালেদ শান্ত কন্ঠে জবাব, 'ঠিক আছে তোমরা আমার বিচার কর। আমাকে জিয়ার কাছে নিয়ে চলো।’ স্বয়ংক্রিয় রাইফেল বাগিয়ে হাবিলদার বলল, ‘আমরা এখানেই তোমার বিচার করব’। খালেদ ধীরস্থির। বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমরা আমার বিচার কর’। খালেদ দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন। ট্যা-র-র-র-র! একটি ব্রাশ ফায়ার! আগুনের ঝলক বেরিয়ে এল বন্দুকের নল থেকে। মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী খালেদ মোশররফ। সাঙ্গ হল বিচার।” (তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা, লে: ক: আবদুল হামিদ)
★ ক্ষমতা দখলে কর্নেল তাহেরের কুটকৌশল : নজরকাড়া কিছু দাবী দাওয়ার অন্তরালে জিয়ার কাঁধে পা দিয়ে ক্ষমতা দখল করাই ছিল কর্নেল তাহেরের মুল উদ্দেশ্য। ৩ নভেম্বর থেকে পরবর্তী এক সপ্তাহ কর্নেল তাহেরের কার্যকলাপ স্পষ্টতই বলে দেয় তাহেরের মূল লক্ষ্য।
“জিয়াকে মুক্ত করার কিছুক্ষণ পরেই তাহের টু-ফিল্ড রেজিমন্টে ছুটে আসে। তখন রাত প্রায় ২-৩০ মিনিট। ওই সময় জিয়ার কক্ষে গুটিকয় অফিসার: কর্নেল আমিনুল হক, মেজর মহীউদ্দীন, মেজর জুবায়ের সিদ্দীক, মেজর মুনীর, সুবেদার মেজর আনিস প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। জিয়া ও তাহের উভয়ে একে অপরকে আলিঙ্গন করলেন। জিয়া বললেন, তাহের তোমাকে ধন্যবাদ, আমাকে বাচিয়েছো। তাহের বলল, আপনার সাথে আমার জরুরি কথা আছে। এদিকে আসুন প্লিজ!
তাহের তাকে নিয়ে কক্ষের একটি নিভৃত কোণে গেল। বহুক্ষণ ধরে তাদের মধ্যে কথাবার্তা চলতে থাকল। একসময় তাদের মধ্যে বেশ উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় শুরু হল। এক ফাঁকে জিয়া বারান্দায় এসে সুবেদার মেজর আনিসকে কানে কানে বললেন, আনিস সাহেব ওকে কোনভাবে সরিয়ে দিন এখান থেকে। সাবধান, বহু পলিটিক্স আছে।
তাহের জিয়াকে টু-ফিল্ড থেকে বের হয়ে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যেতে চাইছিল। জিয়া যেতে রাজি হননি সংগত কারণেই। সাধারণ সৈনিকদের ধারণা ছিল জিয়াকে মুক্ত করার পরপরই সিপাহী-বিদ্রোহ শেষ হয়ে যাবে, তারা ব্যারাকে ফিরে যাবে। কিন্তু বাইরের বিপ্লবী সৈনিক ও বিপ্লবী নেতাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে ছিল ভিন্ন, অনেক গভীর। সমস্ত প্লান-প্রোগ্রামই ছিল সাধার্ণ সৈনিকদের এবং বিপ্লবী তাহের গ্রুপের। শত শত সৈনিকদের পদভারে টু-ফিল্ড রেজিমেন্ট তখন প্রকম্পিত। এদের মধ্যে বহু সৈনিক দেখা গেল এলোমেলো খাকি ড্রেসে। পায়ে ছিল বুটের বদলে সাধা্রণ জুতা। অনেকের মাথায় টুপিও নাই। এরাই ছিল জাসদের বিপ্লবী সংস্থার সদস্য। সিপাহী বিদ্রোহের রাতে খাকি উর্দি পরে তারা মিশে গিয়েছিল ক্যান্টনমেন্টের সাধারণ জোয়ানদের সাথে। উপস্থিত শত শত সৈনিকদের মধ্যে কে বিপ্লবী সৈনিক, কে আসল সৈনিক বুঝা মুশকিল হয়ে পড়েছিল। তারাই অফিসারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্লোগান দিচ্ছিল। টু-ফিল্ডে বসেই জিয়া বেতার ভাষণ দিলেন। টু-ফিল্ডের অফিসেই রেডিও রেকর্ডিং ইউনিট এনে জিয়ার একটি ভাষণ রেকর্ড করা হল ভোর বেলা প্রচার করার জন্য। সংক্ষিপ্ত ভাষণে জিয়া ঘোষনা করেন, তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বভার হাতে নিয়েছেন। দেশের এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর অনুরোধে তিনি এই কাজ করেছেন। তিনি সবাইকে এই মুহূর্তে শান্ত থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করার আহবান জানান। তিনি বন্ধ হয়ে যাওয়া অফিস-আদালত, বিমানবন্দর, মিল-কারখানা পুনরায় চালু করার অনুরোধ জানান। তিনি আরও বলেন, আল্লাহ আমাদের সহায়। (তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা: লে: ক: আবদুল হামিদ)
★ “জাসদের উদ্দেশ্য ছিলো রাজনৈতিক শ্রেনীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, যদিও কর্নেল তাহেরের লক্ষ্য ছিলো অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল। তাহের সৈনিকদের ১২ দফা দাবী প্রণয়ন করে। বিপ্লবী সৈনিকদের অন্যতম লক্ষ্য ছিলো বিপ্লবের মাধ্যমে ১২ দফা বাস্তবায়ন। তাহেরের মতে, জিয়ার সাথে আগেই এসব নিয়ে সমঝোতা হয়েছিলো। তাহের ভেবেছিলো সে-ই অধিক বুদ্ধিমান, জিয়াকে ব্যবহার করে সে ক্ষমতায় আরোহন করতে চেয়েছিলো। কিন্তু তার সেই ক্যালকুলেশন ভুল হয়েছিলো।” (তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা: লে: ক: আবদুল হামিদ, পৃষ্ঠা: ১২৬)
★“৭ তারিখ বিকেল আনুমানিক ৪টার দিকে আবার টু-ফিল্ডে গেলাম জিয়ার কাছে। বারান্দায় উঠতেই দেখি একটি কক্ষে বসে আছে কর্নেল তাহের। মুখ তার কালো, গম্ভীর, ভারী। জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার তাহের? তুমি এতো গম্ভীর কেন? বললো, স্যার আপনারা কথা দিয়ে কথা রাখবেন না, মন খারাপ হবে না? আমি তার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলাম না। কর্নেল আমিন মুচকি হেসে আমাকে বারান্দায় টেনে নিয়ে গেল। বললো, বুঝলেন না স্যার! ব্যাপারটা তো সব তাহেরের লোকজন ঘটিয়েছে, এখন জিয়াকে মুঠোয় নিয়ে বারগেন করছে। এখন তো সে জিয়াকে মেরে ফেলতে চায়। এতক্ষণে বুঝলাম ‘ডালমে কুছ কালা হ্যায়।” (তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা: লে: ক: আবদুল হামিদ)
বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]