শিরোনাম
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বলছি : ভাতা নয়, সম্মান চাই
প্রকাশ : ০৭ আগস্ট ২০১৭, ১৭:০৩
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বলছি : ভাতা নয়, সম্মান চাই
সুলতানা পারভীন
প্রিন্ট অ-অ+

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,


আপনার সরকার ক্ষমতায় এলেই আমাদের অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধারা এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরা আশার আলো দেখেন। কারণ, তারা জানেন, আপনি তাদের জন্য সত্যিকার অর্থে কিছু করতে চান। যেমন এবারও আপনি অসহায় মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবারের জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। যার মধ্যে একটি হলো ‘মাসিক ভাতা’ প্রদান। আপনার এই পদক্ষেপ আরো প্রশংসার দাবিদার এজন্য যে, পরলোকগত মুক্তিযোদ্ধার যদি কোনো শারীরিক প্রতিবন্ধী সন্তান থাকে, তাহলে তাকেই আপনি এই ভাতা প্রদান করার জন্য অনুমতি দিয়েছেন, অবশ্যই যথাযথ প্রমাণের ভিত্তিতে।


মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এই প্রমাণ দেখাতে গিয়ে একটা কমিটি গঠন করা হয়। এতে কতো যে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন।


আমার বাবা ও মা দুজনেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমার বাবা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। আর মা যুদ্ধ করেছেন গ্রামের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের কাজে নানা ধরণের সহায়তা করে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল আমার নানা ও নানীকে একই সঙ্গে যশোরের নিজ বাড়িতে পাক বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছিল, উনাদের ছেলে এবং মেয়ের জামাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলে।


নানা-নানীর মৃত্যুর পর আমার বাবা ও মামা সবাই যখন বাড়ি ছেড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে, তখন বাড়িতে কেউ না থাকায় কতবার যে আমার নানাবাড়ি ও বাবার বাড়ি লুট হয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। ছোট ছোট ৪ ছেলে-মেয়েকে নিয়ে কি যে কষ্ট করেছেন তা আমার মা-ই জানেন। একবার পালাতে গিয়ে তিনি আমার মেজ বোনকে হারিয়ে ফেলেন। তিন দিন পর আবার তাকে ফিরে পান। তারপরও উনি দমে যাননি, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নিয়মিত পাক সেনাদের খবর দিয়ে, অস্ত্র পৌঁছে দিয়ে এবং আরো বিভিন্নভাবে সাহায্য করে গেছেন।


দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একে একে সবাই ফিরে আসে, কিন্তু আমার বাবার কোনো খবর নাই। আমার মা দিন দিন উন্মাদের মতো পথ চেয়ে বসে থাকতেন বাবার অপেক্ষায়। অবশেষে বাবা ফিরে আসেন ১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর বিকেলে। উনাকে দেখে আমার মা প্রথমে চিনতেই পারছিলেন না। পরে জানতে পারেন, এক সম্মুখযুদ্ধে উনি আহত হয়ে হাসপাতালে ছিলেন।


যা হোক, বাবা তখন সিভিল ডিফেন্সে কর্মরত থাকায় যুদ্ধের পর ঢাকায় পোস্টিং হয়। বাবার সাথে বঙ্গবন্ধুর পূর্বপরিচয় ছিল। বাবা যখন বঙ্গবন্ধুর সাথে মাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন যে উনি (আমার মা) তার মা-বাবাকে একসাথে পাক বাহিনীর গুলিতে হারিয়েছেন, তখন বঙ্গবন্ধু আমার মায়ের মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন ‘আজ থেকে আমি তোর বাবা’। এই একটি কথা মাকে সারা জীবন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে চলার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।


এখানে একটা কথা উল্লেখ করতে চাই, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে বাবা একটা সার্টিফিকেট অর্জন করেন, যাতে স্বাক্ষর করেন সেক্টর কমান্ডার আবদুর রাজ্জাক (প্রাক্তন পানিসম্পদ মন্ত্রী) এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব।


বাবা এরপর বিসিএস দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি নিয়ে নোয়াখালীর সেনবাগে পোস্টিং পান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার পর বাবার ভাগ্যে নেমে আসে দুর্দশা। বাকি চাকরিজীবনে উনি শুধু পদোন্নতিবঞ্চিতই হননি, বেশিরভাগ সময় তার পোস্টিং হয়েছে দুর্গম বা পাহাড়ী এলাকায়। এমনকি চাকরির শেষ পর্যায়েও তাকে খাগড়াছড়ির টিএনও পদে চাকরি করে যেতে হয়। অবশেষে ১৯৯৫ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।


যেজন্য আমার এই দীর্ঘ লেখা, ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন করে তালিকা করা হয় এবং সার্টিফিকেট নিতে বলা হয়। কিন্তু সেটাও এত সহজ ছিল না, যার প্রমাণ আমি নিজে। বাবা আমাদের কথা ভেবে ১৯৯৯ সালে ঢাকায় এসে বহুবার তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলে ধর্না দিয়ে সার্টিফিকেট নেন, যা ছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার স্বাক্ষরিত। বাবা ভেবেছিলেন এটাই শেষ, এরপর আর সার্টিফিকেট নিতে আসতে হবে না।


এরপর যখন ২০০১ সালে আবার বিএনপি সরকার আসে, তখন আগের সার্টিফিকেট বাতিল হয়ে যায় এবং আবারও নতুন করে সার্টিফিকেট নিতে বলা হয়। আমার বাবা তখন আর সার্টিফিকেট নিতে যাননি। বরং আমাদের বলে দিয়েছেন, বাবারা আমি যুদ্ধ করেছি দেশের জন্য, তোমাদের জন্য নয়, তাই আমার আর সার্টিফিকেটের দরকার নাই। যে সার্টিফিকেটে শেখ হাসিনার স্বাক্ষর আছে তার যদি মূল্য না থাকে, আমার আর অন্য কারোর সার্টিফিকেট লাগবে না।


আমার বাবা মারা যান ২০০৮ সালে। উনাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। উনার মৃত্যুর পর আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, তখন আবার আগের মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট কার্যকারিতা পায়। কিন্তু হায়! তখন দেখা যায় গেজেটে আমার বাবার নাম নেই। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আবারো গেজেটে নাম উঠানো হয়।


এবার আসি ২০১৭ সালের কথায়। আমার বড় ভাই দীর্ঘদিন যাবত অসুস্থ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিদের্শনা অনুযায়ী আমরা আমাদের ভাইকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দেয়ার জন্য পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি প্রদান করি। সেখানে দেখা যায় বিভিন্ন রকমের টালবাহানা - সাক্ষী লাগবে, আমার বাবা যে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তা প্রমাণ করতে হবে।


আমার প্রশ্ন, বাবার সাথে যারা যুদ্ধ করেছে্‌ন তাদের কারও সাথে তো আর আমাদের পরিচয় নেই। ওনাদের কেউ কি বেঁচে আছেন বা কোথায় আছেন, তা আমরা কি করে জানব? তাহলে কি বাবা-মায়ের মুক্তিযুদ্ধের সব অবদান মিথ্যা? বাবার সব সার্টফিকেট আর মুক্তিযোদ্ধার সম্মান সব কি মিথ্যে?


জেলা থেকে আমার বাবার মুক্তিযোদ্ধার রিপোর্টে মন্তব্য আসে ‘সন্দেহজনক’। কিভাবে জেলা কর্তৃপক্ষ এমন রায় দিয়ে থাকেন আমাদের বুঝতে কষ্ট হয়। আমার মা আমৃত্যু (১৯৮৬-২০০৪) নোয়াখালী জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ছিলেন, তাঁকে চেনেন না কিংবা তাঁর কার্যক্রম সম্বন্ধে জানেন না এমন লোক নোয়াখালীতে পাবেন না। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনিও চেনেন আমার মা কোহিনূর আক্তার খানমকে।


এই যদি হয় আমাদের মতো একটা মুক্তিযোদ্ধা এবং সংগ্রামী পরিবারের অবস্থা, তাহলে গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের কি অবস্থা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী?


এখানে ভাতার চাইতে সম্মানটাই মুখ্য বিষয়। আপনার সদয় দৃষ্টি কামনা করছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।


বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com