শিরোনাম
বিভিন্ন ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস প্রসঙ্গে
প্রকাশ : ২০ মে ২০১৭, ১৬:৩১
বিভিন্ন ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস প্রসঙ্গে
মো. রকিবুল হাসান
প্রিন্ট অ-অ+

ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে বেকারের ছড়াছড়ি। গত বছর প্রায় সাড়ে আট হাজার সিনিয়র অফিসার ও অফিসার পদে বিভিন্ন ব্যাংকে নিয়োগ সার্কুলার হয়। যাতে করে সারা দেশে বেকারদের মনে আশার সঞ্চার হয়। এই সরকারের আমলে বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষা স্বচ্ছ ছিল। কোটা নিয়ে ক্ষোভ থাকলেও ওভারঅল সিচ্যুয়েশন নিয়ে সবাই সন্তুষ্ট ছিল। এই সরকারের আমলে পিএসসি কারো হাতে খেলনা হয়নি। কোনো রাজনৈতিক তদবির চলেনি পিএসসিতে। কিছুদিন আগে মন্ত্রীসভা কোটা শিথিল করলে বেকারদের মনে আশার সঞ্চার হয়।


যাকগে, গুড় খাওয়া মাছির কথা বলি। প্রথমে গুড় খেয়েছেন আতিউর রহমান স্যার। তিনি ভালো মানুষ নিঃসন্দেহে। কিন্তু পুরস্কারের লোভ আছে। এই যেমন হিজরা ব্যাংকিং চালু করে সমাদৃত হয়েছিলেন। উনিই ভালো করতে গিয়ে সবচেয়ে ক্ষতিটা করেছেন বিনা পয়সায় পরীক্ষার ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশের সকল ডিগ্রি পাস লোকের অধিকার আছে একটা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদে আবেদন করা। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই ধোলাইখাল ডিগ্রি কলেজ থেকে ডিগ্রি করা ছেলেমেয়ে কোনোদিন সেখানে আবেদন করবে না। কারণ, তারা জানে এই চাকরিতে প্রতিযোগিতা করার মত মেধা তার নাই। এই রকম ধোলাইখাল ডিগ্রী কলেজ দেশে অসংখ্য। ছাত্রছাত্রী অগনিত। সর্বোচ্চ দুয়েকজন থাকতে পারে সেখানে প্রতিযোগিতার যোগ্য। এখন এক ক্লিকে আবেদন হয়ে যায়। তাই হাতের স্মার্ট ফোনই যথেষ্ট। কিন্তু তারা পরীক্ষা দেয় না।


শুক্রবার আমি খিলগাঁও সরকারি হাইস্কুলের ২০৫ নাম্বার রুমে পরীক্ষা দেই। সেখানে ৪৫ জনের মাঝে উপস্থিত সাত জন। এর আগেও আমি ব্যাংকের প্রিলিমিনারিতে কখনোই আমার রুমে মোট পরিক্ষার্থীর অর্ধেক লোক হাজির হতে দেখিনি। এর আগে দেখা গেছে, আড়াই লাখের মধ্যে পরীক্ষা দিতে আসছে দেড় লাখ। এখন এত লোকের পরীক্ষা নিতে হলে অবশ্যই ঢাকার এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত পর্যন্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লাগে।


আমি কৃষি ব্যাংকের সিনিয়র অফিসারের পরীক্ষা যেখানে দিয়েছিলাম যাত্রাবাড়ি থেকে আধাঘণ্টার দুর হবে। সেই সেন্টারে কখনও এই ধরনের পরীক্ষা হয়নি। হলের গার্ড জানে না খাতার কোথায় স্বাক্ষর করতে হবে। আইনকানুন কোনো মানামানি নাই। পরীক্ষার্থীদের কাছে মোবাইল। যদি টাকা দিয়ে আবেদন করতে হত তাহলে হয়ত দেড় লাখ আবেদন পড়ত। আর এই দূর দূরান্তের মানহীন সেন্টার নিয়ে এত অব্যবস্থাপনার কবলে পড়তে হত না।


এই পরীক্ষা না দেয়া লোকদের দায় আতিউর রহমানকেই নিতে হবে। ওনাকে বিদেশ থেকে ভাড়া করে পলিসি মেকিং এ আনা হয়নি। উনি দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট জানেন ও বোঝেন। উনি জানেন সমাজের আলকাতরা বিনে পয়সায় খাওয়া লোকদের কথা। উনি জেনেশুনে প্রতি পরীক্ষাতে এক লাখ মানুষকে ফ্রি আলকাতরা খাওয়াতে গেলেন, আর দেড় লাখ বিড়ম্বনায় পড়ল। উনি হিজরা ব্যাংকিং করে যেমন সমাদৃত হয়েছেন তেমন এই ফ্রিতে আলকাতরা খাওয়ানো পরীক্ষা নিয়েও সমাদৃত হয়েছেন। শুধু ক্ষোভ আমাদের, আমরা যারা যোগ্যতার লড়াই করে একটা চাকরি পেতে চায় তাদের।


গুড় খাওয়া দ্বিতীয় মাছি : ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি


আগে বিভিন্ন ব্যাংক নিজেদের পরীক্ষা নিত। সেখানে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। দুর্নীতি ঠেকাতে এই কমিটি করা হয়েছিল পরীক্ষা নেয়ার জন্য। এখন কৃষি ব্যাংকের প্রশ্ন ফাঁসের পরে তাদের কাছে গেলে তারা বলেন, আগে আসোনি কেন? চাকরির পরীক্ষা, বোর্ড পরীক্ষা না, যে এর কোনো সিলেবাস আছে। তো পরীক্ষার্থীর হাতে সব প্রশ্নের উত্তরসহ নকল ধরা পড়ে কিভাবে?


জনতা ব্যাংকের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার পরে বলল প্রমাণ দেখাতে গণমাধ্যমে। দেখালাম। এরপর ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির কাছে গেলে বলে, ‘সিনেমা দেখেছ? আমরা বললাম, জ্বি স্যার। উনি অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গির সাথে বললেন সিনেমায় নায়ক-নায়িকা ১০হাত দূরে থাকে কিন্ত ক্যামেরায় দেখায় তারা খুব কাছাকাছি আছে। এসব কোনো প্রমাণ না। আমি সারাদিন ফেসবুক অন রাখছিলাম, দেখলাম না তো। চাকরি দিতেছি ভালো লাগে না তাই না?’


রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের একজন ব্যক্তির কাছ থেকে এ ধরনের কথা শোনার পরে রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের যখন ভালোবাসা কাজ করে তার জন্য নিজের কাছে লজ্জা হয়। আসল কথা হচ্ছে, আরেকবার পরীক্ষা নিলে যে টাকা খরচ হবে সেটা কারা দেবে? আইন অনুযায়ী যারা টেন্ডার নেয় তারা। কিন্ত তারা অনেক শক্তিশালী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক গডফাদার। ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির তাদের দিয়ে আরেকবার পরীক্ষা নেয়ানোর ক্ষমতা নেই।


গুড় খাওয়া তৃতীয় মাছি : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অনুষদ আর প্রেস


সামাজিক বিজ্ঞান ও বাণিজ্য অনুষদ, যারা কম টাকায় টেন্ডার নেয়, আর প্রশ্ন বেঁচে টাকা আয় করে। এককালে বাণিজ্য অনুষদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও এসেছিল যে, ৩ লাখ টাকা দিলে খাতার কাভার পেজ ঠিক রেখে ভিতরের পেজ চেঞ্জ করে দেয়। ভেতরের পেজে সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর ঢুকিয়ে দেয়া হত। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ জনতা ব্যাংকের পরীক্ষা নেয় শুক্রবার বেলা ৩টায়(গত মাসের ২১তারিখ)। আগের দিন বিকেলে হাতে লেখা প্রশ্ন ফাঁস। সন্ধ্যায় হাতে লেখা উত্তর ফাঁস। পরের দিন প্রেস থেকে ছাপা হওয়া প্রশ্ন ফাঁস। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদকে জানালে তারা বলে আগে জানানো হয়নি কেনো? ভাবখানা এমন যেন পরীক্ষার টেন্ডার পরিক্ষার্থীরা নিয়েছে। তাদের দায়িত্ব প্রশ্ন করে ফাঁস করা, আমাদের দায়িত্ব পরীক্ষার আগে পড়াশুনা বাদ দিয়ে সেটা নিয়ে কোর্টকাছারি থানাপুলিশ করা। এই যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নৈতিকতা হয় জীবনে পড়ালেখা শিখে অনেক ভুল করেছি।


অগ্রণী ব্যাংকে সকালের প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ আগেই গণমাধ্যমে এসেছে। কিন্ত সেই পরীক্ষা বাতিল হবে না। কারণ আরেকবার পরীক্ষা নিতে গেলে যেই খরচ হবে সেটার খরচের ভয়ে। দূর দূরান্ত থেকে আসা ছেলেমেয়েরা এতে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরছে। বিকেলের পরীক্ষা বাতিল হলো। সকালেরটা হলো না। এই লজ্জা কার!


লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি


বিবার্তা/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com