শিরোনাম
শ্যামল হোক সবার অনুপ্রেরণা
প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০১৭, ১১:৩৫
শ্যামল হোক সবার অনুপ্রেরণা
শ্যামল কান্তি বিশ্বাস
শরিফুল হাসান
প্রিন্ট অ-অ+

পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মানুষটাও এ গল্প শুনে জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পাবেন। আমি চাই বাংলাদেশের সব মানুষ এই গল্প জেনে অনুপ্রাণিত হোক। যে ছেলেটি লেখাপড়ার অর্থ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন, বেকার যে ছেলেটি একটা চাকরির জন্য হা-হুতাশ করছেন, জীবনের লড়াইয়ে যে হেরে যাচ্ছেন তাদের সবার জন্য এ গল্প হতে পারে নতুন শক্তি। এ গল্প হতে পারে নতুন শক্তি। আমি জীবনের এমন গল্প হাজারবার লিখতে চাই। আমার ফেসবুক কিংবা বাস্তব জীবন, বাংলাদশের সব পত্রিকার পাতা ভরে উঠুক এমন গল্পে।

 

আজ সকা‌লের ঘটনা। বাসায় একা‌ধিক প‌ত্রিকা রাখা হয়। কালের কণ্ঠের আজকের ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে বউ যখন বললো, দেখো দেখো তোমার শ্যামলকে নিয়ে ওরা কতো বড় নিউজ করেছে তখন মনটা ভালো হয়ে গেলো। আমার শ্যামল কান্তি বিশ্বাস। ২০১৪ সালের ১০ মে শ্যামল প্রথম অলোয় যোগ দেয়ার পর আমি তাকে নিয়ে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। অবশ্য সেদিন তার নাম-পরিচয় প্রকাশ করিনি। অসংখ্য মানুষের অনুরোধেও করিনি। এরপর ও যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দিলো, সেদিন ওর নাম প্রকাশ করে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। আজ আবার সেটা দিচ্ছি। আমি নিশ্চিত যে, কোনো মানুষ শ্যামলের জীবনের গল্প শুনে ঘুরে দাঁড়ানোর অসীম শক্তি পাবেন।

 

২০০৮ সালের ডিসেম্বর কিংবা ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের দিকের ঘটনা। রাত ৮টার মতো হবে। প্রথম আলো অফিসে আমি। কাজ করতে করতে গ্রাফিকস রুমে গেছি। বিশাল বাংলা পাতার মেকআপ করছে সহকর্মী বাকি বিল্লাহ। একটা সাহায্যের আবেদনে চোখ আটকে গেলো। নিউজে বলা হয়েছে, ২০০৮–০৯ শিক্ষাবর্ষে একটি ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে কিন্তু ভর্তির টাকা নেই। প্রথম আলোর যশোরের অভয়নগর প্রতিনিধি মাসুদ আলম ভাই নিউজটা পাঠিয়েছে। আমি বাকি ভাইকে বললাম, এই নিউজটা ফেলে দেন। এটা পত্রিকায় দেয়া লাগবে না। বাকি ভাই হতাশ কণ্ঠে বললো, কেন? আমি বললাম একটা ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ১০-১৫ হাজার টাকা লাগে। সে জন্য নিউজ করার দরকার নাই। আপনি ফেলেন। সমস্যার সমাধান হবে। আমি ফোন দিলাম মাসুদ আলম ভাইকে।

 

মাসুদ ভাইকে বললাম, এই নিউজ করার মানে কি? মাসুদ ভাই জানে আমি তাকে কেন ফোন দিয়েছি। আর সে কারণেই মাসুদ ভাই আমাকে ছেলেটির গল্প শোনালো। শ্যামলের বাড়ি যশোর। শিশুকালেই বাবা–মাকে হারিয়েছে। যশোরের একটি খ্রিস্টান মিশনারিতে সে বড় হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি তার ভয়ঙ্কর আগ্রহ। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেলো। এরপর এইটে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতোই বাস্তবে একটু আলো পেলেই বই নিয়ে বসে পড়ে। নিজের বই নেই বলে এর ওর কাছ থেকে ধার করে বই পড়ে। ছেলেটির মেধা দেখে স্থানীয় এক হিন্দু শিক্ষক শ্যামল কান্তি বিশ্বাস নাম রেখে ছেলেটির স্কুলে নিবন্ধন করায়। একটি বাড়িতে পালক থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। এসএসসিতে ছেলেটি অসাধারণ রেজাল্ট করলো। এরপর উচ্চমাধ্যমিকেও।

 

ছেলেটির ইচ্ছা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। তার সব বন্ধুরা এখানে ওখানে ভর্তি পরীক্ষা দেয়। কিন্তু ওই পালক বাবা-মা চান শ্যামল যশোরেই থাকবে এবং তার ছেলেমেয়েকে পড়াবে। কিন্তু শ্যামল যে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। এক বন্ধুর সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির ফরম কিনে পরীক্ষা দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার অসাধারণ ফল করলো ছেলেটি। কিন্তু এখন ভর্তির টাকা নেই। তাকে দেখারও কেউ নেই। কী হবে এখন?

 

মাসুদ ভাইয়ের গল্প শুনে আমি অনেকক্ষণ কাঁদলাম। আমরা যারা কিছুটা সুবিধাভোগী মানুষ কতভাবে কত জায়গায় টাকা খরচ করি। কত কারণে হতাশায় ভেঙ্গে পড়ি। আর একটি ছেলে যে জানে- তার বাবা মা নেই, কোনো ভবিষ্যত নেই, সে কী না এত পরিশ্রম করছে। আমি মাসুদ ভাইকে বললাম, আপনি ছেলেটাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইভার আগে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েন।

 

আজেও মনে আছে সেদিনের ঘটনা। ছেলেটি এলো কলাভবনের সামনে। জানালো তার মেধাক্রম একদম শুরুর দিকে। আইন, অর্থনীতিসহ আরো অনেক বিষয়ই সে পাবে। আমি ছেলেটাকে দেখলাম ভালো করে। কালো কুচকুচে। একটা চোখ ফোলা। দেখলেই মনে হয় শত সহস্র বছরের কষ্ট ওর মুখে।

 

আমি তাকে বললাম, শোনো তুমি আইন বা অর্থনীতি পড়ে জীবনে কী করতে পারবে আমি জানি না; এরচেয়ে ভালো তুমি সাংবাদিকতায় পড়ো। আমি তখন সাংবাদিকতায় মাস্টার্স করছি। শিক্ষকরা প্রায় সবাই আমার পরিচিত। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তখন আরেফিন স্যার। তার কাছে যখন তখন যে কোনো বিপদে যেতে পারি। এসব ভেবেই আমি শ্যামলকে সাংবাদিকতায় ভর্তির সিদ্ধান্ত নেই। আর আমার মাথায় ছিল সাংবাদিকতায় ভর্তি হলে কয়েকমাস ক্লাস করলেই তাকে একটা চাকরি দিতে পারব। মাসুদ ভাইয়ের সাথে কথা হলো। মাসুদ ভাইও আমার সঙ্গে একমত হলো।

 

ছেলেটা সেদিন আমাকে স্যার স্যার করছিল। আমি তাকে সম্ভবত ধমক দিয়েছিলাম। বলেছিলাম তুমি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সবসময় মাথা উঁচু করে চলবে। আর আজ থেকে আমি তোমার বড় ভাই। কলাভবন থেকে কাটাবন বা হাতিরপুল গিয়ে শ্যামলকে খুব সস্তায় সম্ভবত ১৫০০ টাকায় একটা মোবাইল কিনে দিয়ে বলেছিলাম, যখন দরকার ফোন দেবে।

 

পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ছেলেটিকে ভর্তি করালাম গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। ভর্তি তো হলো। ছেলেটা থাকবে কোথায়? তার হল জগন্নাথ। নরমাললি হলে সিট পাওয়া কঠিন। কয়েকমাস দেরি হবে। আর আমি তাকে রাজনৈতিকভাবে হলে উঠাতে চাইনি। তাই সেদিনই তাকে নিয়ে গেলাম উপাচার্য আরেফিন স্যারের কাছে। ছেলেটিকে দূরে বসিয়ে স্যারকে সব ঘটনা খুলে বললাম। বললাম স্যার আজ থেকেই ওকে হলে রাখতে চাই। আপনি প্রভোস্টকে বলে দেন। স্যার তখুনি প্রভোস্টকে ফোন করে বললেন, একটি ছেলেকে সিট দিতে হবে। কিন্তু প্রভোস্ট স্যার জানালেন, সিট দিতে একটু সময় লাগবে।

 

আমি জগন্নাথ হলে থাকা আমার বন্ধু সুদীপ কুমারের রুমে পাঠালাম ছেলেটিকে। বললাম সুদীপ তোর রুমে রাখবি। খেয়াল রাখবি কোনো সমস্যা যেন না হয়। সুদীপ সিঙ্গেল রুমে থাকতো। কোনো কথা না বলেই আমার এই বন্ধুটি শ্যামলকে তার রুমে রাখে। সুদীপ নিজের ছোট ভাইয়ের মতোই খেয়াল রেখেছিল শ্যামলের। ছেলেটিকে ভর্তি করানোর পর আমি আমার অফিসের এক কলিগকে বললাম, শ্যামলকে একটা ছোট্ট চাকরি জোগাড় করে দিতে। তিনি শ্যামলের ঢাকা থেকে যশোরে যাওয়া আসার বাস ভাড়া ফ্রি করে দিলেন এবং এক জায়গায় ছেলেটির একটা অস্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি এরপর আস্তে আস্তে যোগযোগ কমিয়ে দিলাম শ্যামলের সাথে। এর একটা বড় কারণ, আমি চেয়েছিলাম ও যেন স্বাবলম্বী হিসেবে বড় হয়ে উঠতে পারে।

 

শ্যামলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ কম রাখলেও নানাভাবে আমি তার খোঁজ রাখতাম। সাংবাদিকতা বিভাগের কয়েকজন ছোট ভাইকে বলতাম, আমাকে ওর খবর দিবি। আমাকে তারা প্রায়ই জানাতো শ্যামল পরীক্ষায় খুব ভালো করছে। এর মধ্যেই প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় বর্ষ পেরোয়। শ্যামল কাজ পায় বিডিনিউজে। আমি যখনই শ্যামলের ভালো কোনো খবর পেতাম শুনে ভালো লাগতো।

 

অনার্স শেষ করে শ্যামল শুরু করে চাকরির পরীক্ষা। ছেলেটা ইংরেজিতে অনেক ভালো। বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক চাকরির পরীক্ষায় টিকতে থাকে। এর মধ্যেই এ বছরের শুরুর দিকে আবার আমার কাছে আসে ছেলেটা। জানায় যেখানে কাজ করছে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। আমি বলি, প্রথম আলোয় চলে আসো। ছেলেটা একটা সিভি পাঠায়। আমি সেদিনই দিয়ে দেই অনলাইনে। কয়েকদিন পর আবেদনকারীদের মধ্যে যারা যোগ্য তাদের পরীক্ষা হয়। আমাকে জানানো হয় তোমার পাঠানো শ্যামলের পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে। আমরা ওকে নেব। আমি আনন্দের হাসি- হাসি।

শ্যামল যোগ দিলো প্রথম আলোয়। সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে দেখা করে আমাকে যেদিন ফোন দিলো খুব ভালো লাগলো। এরমধ্যে সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিতে শুরু করে শ্যামল। চা বোর্ডের একটা চাকরির পরীক্ষায় সে প্রথম হয়। অফিসে মিষ্টি নিয়ে আসে। এরপর প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে তার চাকরি হয়। শরীয়তপুরে যোগ দেয় ম্যানেজার হিসেবে। এরপর এলো সেই কাঙ্খিত খবর। শ্যামলের ফোন। ব্যাপক উত্তেজিত। বলে ভাই আমার চাকরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক। আমার সেদিন আনন্দে কান্না পায়। এরপর শ্যামল চাকরিতে যোগ দিল। ওর পোস্টিং হলো বরিশালে। আমি যখন গতবছর বরিশালে অফিসের কাজে গেলাম শ্যামলের সাথে গল্প হলো। আমি যতই ওকে দেখি, মুগ্ধ হই। শ্যামল আজ দেশে বিদেশে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। খুব ভালো করছে চাকরিতে।

 

কেউ চাইলে শ্যামলকে নিয়ে আজকে কা‌লের ক‌ণ্ঠে প্রকাশিত লেখাটা পড়তে পারেন। আমি বিশ্বাস করি কারো সাহায্য নয় শ্যামল এতদূর এসেছে ওর মনের জোরে। ওর দৃঢ়তায়। যে দেশে শ্যামলের মতো সংগ্রামী ছেলে আছে সেই দেশকে ঠেকিয়ে রাখে কে?  

 

আমি মনে করি শ্যামলের জীবনের গল্প এদেশের হাজারো, লাখো সংগ্রামী মানুষকে নতুন শক্তি দেবে। জীবন নিয়ে নতুন করে আশাবাদী করবে। আতিউর রহমান যেমন তৃণমূল থেকে উঠে এসে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হয়েছিল; আমি চাই আমার শ্যামলও একদিন তেমন হবে। তোমার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা। শুভকামনা এইদেশের হাজারো শ্যামলের জন্য।

 

লেখক : গণমাধ্যম কর্মী

 

বিবার্তা/নিশি

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com