শিরোনাম
চিকিৎসকরা গ্রামে যেতে চান না কেন
প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭, ২১:৩৭
চিকিৎসকরা গ্রামে যেতে চান না কেন
মো. মাকসুদ উল্যাহ্
প্রিন্ট অ-অ+

আজকাল প্রায়ই অভিযোগ শুনি, ডাক্তারেরা গ্রামে থাকেন না, থাকতে চান না। বলা হয়, গ্রামে বা উপজেলায় প্রশাসনিক অফিসাররা থাকতে পারলে, ডাক্তাররা পারবেন না কেন?


বাস্তবতা হচ্ছে, প্রশাসনিক অফিসারদের বিচারিক ক্ষমতা আছে। তাদের কর্মস্থল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে গিয়ে কোনো দুর্বৃত্ত তাদের লাঞ্ছিত করার কথা কল্পনাও করে না। কেননা এমন করার চেষ্টা করা মাত্র তাকে জেলখানায় পাঠানো হবে। কিন্তু কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পর্যন্ত দুর্বৃত্তরা চাইলেই ডাক্তারের ওপর হামলে পড়ে। কেননা ডাক্তারের হাতে বিচারিক তথা গ্রেফতারের ক্ষমতা নেই। ফলে উপজেলা পর্যায়ে ডাক্তারের ওপর হামলার ঘটনা প্রতিদিনের বিষয়ে পরিণত হয়েছে! এমনও ঘটেছে যে, সরকারি দায়িত্ব বাদ দিয়ে রোগী দেখতে বাড়িতে না যাওয়ায় ডাক্তারের তিন দাঁত ফেলে দেয়া হয়েছে। এরকম অসভ্যতার মুখোমুখি হয়ে গ্রামে তারা ডাক্তারি করবেন কিভাবে?


প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা জেলায় বা উপজেলায় চাকরির নির্দিষ্ট মেয়াদ পার করলেই তাদের পদোন্নতি হয়। কিন্তু উচ্চতর ডিগ্রি না করলে ডাক্তারদের পদোন্নতি হয় না। তাহলে তারা গ্রামে থাকবেন কেন?


অন্যান্য খাতের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের মতো ডাক্তারদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা হয়েছে কী? তাহলে?


ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়মিত যেতাম গ্রামের রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য। রোগীরা মাসের প্রথম তিন- চার দিন আসে শুধু সরকারি ওষুধ নেয়ার জন্য। তাদের বলতাম, ‘আপনার সমস্যার কথা বলুন, তারপর দেখেশুনে যাচাই করে যে ওষুধ দরকার সেটার ব্যবস্থা করবো’। তারা বলত, ‘সমস্যা বলার দরকার নেই, আমরা জেনে এসেছি অমুক অমুক ওষুধ আছে, সেগুলো দেন।’ তাদের কথামতো না চললে অনেকে বিরূপ মন্তব্য করত এবং লাঞ্ছিত করতে চেষ্টা করত। ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগীরা ডাক্তারকে শুধু মাসের প্রথম তিন-চার দিন ওষুধ বিতরণকারী পিওন হিসেবে দেখতে চায়। তারা মাসের প্রথম তিন-চার দিন এসে শুধু ওষুধ নিয়ে যেত। স্থানীয় মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে এবং প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয় এবং মাদরাসায় সশরীরে গিয়ে প্রচার করেছিলাম, এ ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আমি সরকারি ডাক্তার এবং নিয়মিত আসছি। আপনারা চিকিৎসার জন্য আসবেন। কিন্তু মাসের বাকি দিনগুলোতে তারা কেউ চিকিৎসার জন্য যেত না।


তাহলে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার গিয়ে খালি বসে থেকে সময় এবং যোগ্যতা নষ্ট করবে কেন? সেখানে দুর্বৃত্তের হাতে লাঞ্ছিতও হয়েছি! একদিন নিকটস্থ সড়ক থেকে এক লোক এসে আমার কাছে টয়লেটের চাবি দাবি করে। আমি তার অনুগত দাসের মতো টয়লেটের চাবির ব্যবস্থা করতে পারিনি বলে সে আমাকে ঝুলানোর হুমকি দিয়ে চলে যায়। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে কেউ কোনোদিন এমন করতে পেরেছে? এমন করলে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা কেউ সেই কর্মস্থলে থাকবে?


ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিষাক্ত সাপে দংশনের রোগী বা হার্ট অ্যাটাক-স্ট্রোক বা অন্য কোনো জটিল রোগী এলে তাদের সঠিক চিকিৎসার জন্য উচ্চতর হাসপাতালে পাঠাতে হয়। কিন্তু দুর্বৃত্তরা সেটা না মেনে ডাক্তারের ওপর হামলা করে। তারা বলে, ‘এ রোগীর চিকিৎসা করতে না পারলে কী কচুর ডাক্তার হইছেন?’ তারা বলে, ‘আপনারা আমাদের ট্যাক্সের টাকায় ডাক্তার হইছেন, চিকিৎসা এখানেই করতে হবে’। এই বলে তারা অনেক সময় পশুর মতো ডাক্তারের ওপর হামলে পড়ে!


যারা ডাক্তারদের গ্রামে থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তারা কি কখনো ডাক্তারদের প্রতি এসব অসভ্য আচরণের বিরোধিতা করেছেন? বিরোধিতা দূরের কথা, কখনো তো উল্লেখই করেন না।


আবার রোগীদের যখন ব্যবস্থাপত্র দেয়া হয় তখন অনেক ফার্মেসি ব্যবসায়ী ব্যবস্থাপত্রের ওষুধ বাদ দিয়ে বরং নিজের মর্জিমোতাবেক তার ফার্মেসিতে যা ওষুধ আছে তা রোগীর হাতে তুলে দেয়। ফলে সময়ের সাথে রোগীর অবস্থা আরো খারাপ হয়। দোষ হয় ডাক্তারের! ফার্মেসি ব্যবসায়ী মনে করে, সেটা তার এলাকা। সে যা ইচ্ছা রোগীকে তাই ওষুধ দেবে। ডাক্তার কোন ছার। সে বরং আরো বড় ডাক্তার।


দেখা যায়, অনেক ফার্মেসি ব্যবসায়ী নিজের নামের আগে ডাক্তার লিখে বিশাল বিশাল সাইনবোর্ড, ব্যানার টানিয়ে রেখেছে। তারা রোগীর থেকে ভিজিট ফি নিচ্ছে পঞ্চাশ-এক শ’ টাকা। তারা রোগীকে টেস্ট করতে দিচ্ছে। কোনো কোনো ফার্মেসি ব্যবসায়ী রোগীর সামনেই অধ্যাপকের ব্যবস্থাপত্র ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে। গ্রামের কলেজের সহকারী অধ্যাপক বাজারে একটি ফার্মেসি খুলে বিশাল সাইনবোর্ড টানিয়ে নিজের পরিচয় লিখে রেখেছেন, ‘অধ্যাপক ডা: অমুক’। মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপকের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে রোগী ফার্মেসি ব্যবসায়ীর কাছে গেলে ফার্মেসিতে সেই ওষুধ নেই বলে ফার্মেসি ব্যবসায়ী অধ্যাপকের ব্যবস্থাপত্র ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলে, ‘কি আবাল ডাক্তার দেখাইছেন? এই নামে তো কোনো ওষুধই নাই দুনিয়াতে!’ ফার্মেসি ব্যবসায়ীর দাপটে রোগী মনে করে, এই ডাক্তার বুঝি আসলেই অযোগ্য।


এভাবেই প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে রোগীরা নিজেদের অজান্তেই ফার্মেসি ব্যবসায়ীর কাছে জিম্মি। অসৎ ফার্মেসি ব্যবসায়ীরা এভাবেই রোগীর চিকিৎসাকে অকার্যকর করে দিয়ে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে দিচ্ছে।


বেকার যুবকেরা অনেকেই জেলাপর্যায়ের স্থানীয় পত্রিকা বের করছে। এক দিকে তারা নিজেদের সাংবাদিক হিসেবে তুলে ধরছে, অন্য দিকে তারাই ফার্মেসি খুলে বিশাল সাইনবোর্ডে নিজেকে হুঙ্কারের ভঙ্গিতে ডাক্তার উল্লেখ করে সেটা আবার সেই পত্রিকায় বড় বড় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। ফলে এ দেশের মানুষ তাদেরই ডাক্তার বলে মনে করছে। ফলে ‘ডাক্তার’ শব্দটার আর আলাদা কোনো তাৎপর্য থাকছে না।


হোমিওপ্যাথি বা আয়ুর্বেদিক মেডিক্যাল কলেজ থেকে বিএইচএমএস বা ডিএইচএমএস লেখাপড়া করে সবাই নিজের সাইনবোর্ডে নিজেকে এমবিবিএস পরিচয় দিয়ে এলোপ্যাথি ডাক্তারি করছে! অথচ তাদের ডিগ্রির নাম বিএইচএমএস বা ডিএইচএমএস এবং তাদের করার কথা হোমিওপ্যাথি বা আয়ুর্বেদিক ডাক্তারি! সবাই নিজেকে এমবিবিএস হিসেবে তুলে ধরার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে! এসব অপকর্ম চলমান রেখে বা না দেখার ভান করে শুধু এমবিবিএস ডাক্তারদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করে গ্রামে চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতি হবে কিভাবে?


গ্রামে ফার্মেসি ব্যবসায়ীদের অনেকে ডাক্তারের দিকে ইঙ্গিত করে রোগীকে বলে, ‘রোগ সারানোর মালিক আল্লাহ। বাইরের লোকদের গিয়ে ২০০ টাকা ভিজিট দেয়ার কী দরকার? আমরাই তো কম ভিজিটে চিকিৎসা দিতেছি।’ তারা রোগীকে বুঝাতে চায় আল্লাহ যদি রোগ সারায়, তাহলে সেটা তার চিকিৎসায়ই সারবে; বাইরের লোকের ( ডাক্তার) কাছে যাওয়ার দরকার নেই।


সব রোগীকে সব সময় গ্যাস্ট্রিক আলসারের ওষুধ বা ভিটামিন বা স্যালাইন দেয়া লাগে না। কিন্তু রোগীরা ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে ফার্মেসিতে গেলে ফার্মেসি ব্যবসায়ীরা রোগীকে বলে, ‘কই, গ্যাসট্রিকের ওষুধ তো দেয় নাই! ভিটামিন তো দেয় নাই।’ এভাবে তারা রোগীকে বুঝায়, ডাক্তারের চিকিৎসা ভুল হয়েছে। নির্বোধ রোগীও ফার্মেসি ব্যবসায়ীকে বড় ডাক্তার মনে করে বিভ্রান্ত হয়। মানুষের মূর্খতার সুযোগ নিয়ে ফার্মেসি ব্যবসায়ীদের অনেকেই গ্রামের রোগীদের সুচিকিৎসার পথ বন্ধ করে রেখেছে।


গ্রামে একজন ডাক্তারের সততার সাথে ডাক্তারি করার পথ অনেকটাই বন্ধ করে রেখেছে ফার্মেসি ব্যবসায়ী আর ক্লিনিক মালিকেরা। রোগীরা কোনো ডাক্তারের কাছে প্রাইভেট চেম্বারে দেখাতে চাইলে তারা সেই ক্লিনিকে পাঠায় এবং দরকার না হলেও রোগীকে অনেকগুলো টেস্ট করায়। যে ডাক্তার দরকার ছাড়া রোগীকে টেস্ট করতে দেয় না, সেই ডাক্তারের কাছে রোগীকে যেতে দেয় না তারা। ফলে সৎভাবে ডাক্তারি করতে চাইলে আর্থিকভাবে শোচনীয় অবস্থা বরণ করতে হয় সেই ডাক্তারকে।


এসব অরাজকতার সুযোগে বেকার শিক্ষিতি যুবকেরা ব্যাঙের ছাতার মতো ফার্মেসি আর ক্লিনিক খুলে বসছে। এক সময় দেশে জনসংখ্যা বাড়ত জ্যামিতিক হারে। এখন গ্রামে ফার্মেসি আর ক্লিনিক বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। আর তার ফলে সৃষ্ট অরাজকতার দায় জ্ঞানপাপীরা ডাক্তারদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে।


গ্রামে চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতির জন্য সবার আগে ফার্মেসি ব্যবসায়ী আর ক্লিনিকমালিকদের দৌরাত্ম্যের লাগাম টেনে ধরতে হবে। ফার্মেসি ব্যবসায়ীকে ‘ডাক্তার’ সম্বোধন করা বন্ধ করতে হবে। গণমাধ্যমে প্রচার করতে হবে, রোগীরা যেন ফার্মেসি ব্যবসায়ীর কথায় ডাক্তারের চিকিৎসা পরিবর্তন না করে। কোনো ফার্মেসি ব্যবসায়ী নামের আগে ‘ডাক্তার’ পরিচয় ব্যবহার করলে বা রোগীর থেকে ভিজিট নিলে বা রোগীকে টেস্ট করতে দিলে বা ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র স্থগিত বা পরিবর্তন করলে সবাই যেন প্রকাশ্যে বা গোপনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেন। ফার্মেসি ও ক্লিনিকগুলোতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের তদারকি বাড়াতে হবে। প্রত্যেক ইউনিয়নে বা উপজেলায় যেন জনসংখ্যার অনুপাতে নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি ফার্মেসি এবং ক্লিনিক না থাকে। ডাক্তারের কর্মস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিরাপত্তা প্রহরীর ব্যবস্থা করতে হবে। গণমাধ্যমে প্রচার করতে হবে, রোগীরা যেন সেখানে গিয়ে ডাক্তারের কাছে সরাসরি ওষুধ দাবি না করে বরং নিজের শারীরিক কষ্টের কথা যেন তুলে ধরে। সুস্থ লোকেরা রোগী সেজে যেন সেখানে গিয়ে ওষুধ দাবি না করে। সাধারণ বিসিএস থেকে সরিয়ে বিচারকদের মতো ডাক্তারদের ভিন্ন পদ্ধতিতে চাকরিতে যোগদান করার ব্যবস্থা করতে হবে। ডাক্তারদের গ্রেড-১ পর্যন্ত পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। অন্য ক্যাডারের মতো ডাক্তারদের জন্যও চাকরির মেয়াদের ভিত্তিতে পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে।অনারারি মেডিক্যাল অফিসার সিস্টেম বাতিল করে তাদের জন্য উপযুক্ত ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন সৃষ্ট মেডিক্যাল কলেজগুলোতে প্রত্যেক বিষয়ের যথেষ্ট সংখ্যক শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করতে হবে।


লেখক : চিকিৎসক, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।


বিবার্তা/হুমায়ুন/কাফী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com