শিরোনাম
রক্ত ঘাম ও অশ্রু
প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০১৭, ২০:৪৬
রক্ত ঘাম ও অশ্রু
তারিক এ আল-মায়েনা
প্রিন্ট অ-অ+

সুদীর্ঘকাল ধরে সউদি আরবে বসবাস করে আসছেন এবং সউদি সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন ও রাখছেন, এমন প্রবাসীদের সউদি আরবের নাগরিকত্ব দেয়ার আমি একজন ঘোর সমর্থক তথা প্রবক্তা। আমি মনে করি, তাদের নাগরিকত্ব দিলে শুধু তাদের অবদানের স্বীকৃতিই দেয়া হয় না, বরং এর মাধ্যমে তাদের এদেশে ধরে রাখার ব্যবস্থাও হয়। আর তাদের অব্যাহত উপস্থিতি দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সহায়ক।


অবশ্য আমার এসব কথার সঙ্গে সউদিরা সবাই যে একমত, তা কিন্তু নয়। এরকম একজন হলেন সামির। এই ব্যবসায়ী মানুষটি আমার এসব কথা মানতে মোটেই রাজি নন। তার সাফ কথা, আমরা যদি অভিবাসীদের জন্য দরজা খুলে দিই তবে এমনসব মানুষ এসে দেশটি ভরে যাবে, যাদের দিয়ে এদেশের একফোঁটা অর্থনৈতিক উন্নয়নও হবে না। উল্টো তারা আমাদের সম্পদের ওপর চাপ তৈরি করবে।


সামির তার সমর্থনে যুক্তি দেখাতেও ভোলেন না। বলেন, শোনেন তারিক, আমার কথা সত্য না মিথ্যা বোঝার জন্য আপনাকে বেশিদূর যেতে হবে না। ওই দেখুন রাস্তার কোণায় কোণায় ভিক্ষা করছে কারা? বিদেশিরা। ওরা এমন সময় আমাদের দেশে, যখন আমাদের ছেলেরা একটা চাকরি পাচ্ছে না। আচ্ছা বলুন তো, এই বিদেশিরা যখন সারাদিন হাত পেতেও তিন বেলা খাবার জোটাতে পারবে না তখন কী করবে? ওরা তখন নিজেদের আশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধেই নানারকম অপরাধ সংঘটনে নেমে পড়বে।


সামিরের এসব কথার এক পর্যায়ে আমি আর হস্তক্ষেপ না করে পারি না। তাকে বলি, আমি কিন্তু যারা নাগরিকত্ব লাভের যোগ্য তাদেরই নাগরিকত্ব দেয়ার পক্ষে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে যারা অন্যের সাহায্যের আশায় হাত বাড়িয়ে রাখে, তাদের তো নাগরিকত্ব দিতে আমি বলি না!



সামিরের মতোই আরেকজন হচ্ছেন মোনা। তিনি একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। তার রয়েছে মাল্টি মিলিয়ন রিয়ালের একটি গ্রুপ অব কম্পানিজ। অভিবাসন আইন শিথিল করে বিপুল সংখ্যায় বিদেশিকে সউদি আরবে ঢুকতে দেয়ার প্রশ্নে সামিরের মতো এই নারীও যারপরনাই উদ্বিগ্ন। তার বিশ্বাস, এভাবে ঢলের মতো বিদেশিদের অনুপ্রবেশ আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর একটা বিরূপ প্রভাব ফেলবে।


মোনা'র এ কথায় আমার বিরক্ত লাগে। বলি, কী সব বাজে বকছো, মোনা! বলো তো, কী এমন বিশেষ বৈশিষ্ট আমরা সউদিরা ধারণ করি? পৃথিবীর অন্য কোনো জাতির চাইতে আমরা আলাদা কিছু নই এবং আজকের বিশ্বের যে চ্যালেঞ্জ তা-ই আমাদেরও চ্যালেঞ্জ। ''আমরা অন্যদের চাইতে আলাদা'' - এই ধারণা বরং আমাদের সমাজকে সম্ভবত দুর্বল করে দিচ্ছে এবং দেশ হিসেবে আমাদের এগিয়ে যাওয়ায় বাধা সৃষ্টি করছে।



আমি মোনাকে আরো বলি, দেখো, একের পর এক পরিসংখ্যান কিন্তু বলছে, সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা ও জনকল্যাণে আমরা অনেক উন্নত দেশের চাইতে পিছিয়ে আছি। শিক্ষা বলো, সামাজিক সুরক্ষা বলো কিংবা এরকম অন্য আরো অনেক কিছু - কোনো কিছুতেই কি আমরা যে অনন্য একটি সমাজ, তার কোনো ব্র্যান্ড তৈরি করতে পেরেছি? অথচ আমার মনে হয়, আমরা পরতাম। এরকম সম্ভাবনা আমাদের ভেতরে সুপ্ত ছিল।


ডাক্তার জামালের কথাই ধরা যাক। তার নিজের একটি ক্লিনিক আছে। এই ডাক্তার সাহেব মনে করেন, বিদ্যমান নাগরিকত্ব আইনটিই যথেষ্ট। আইনটি নিয়ে আর নড়াচড়া করা ঠিক হবে না। তা করতে গেলে স্থানীয় ও প্রবাসীদের সংখ্যায় যে ভঙ্গুর ভারসাম্য, তা বিপন্ন হতে পারে। জামাল আমাকে বলেন, আমরা কি দুবাইর মতো হতে চাই, যেখানে অফিস-আদালতে কাজ করছে, এমন একজন স্থানীয় লোক খুঁজে পাওয়াই দুস্কর!


আমি জামালকে বাধা দিয়ে বলি, আরে বাবা, আমি তো আমাদের আইন নিয়ে কিছু বলছি না। আমি যেটা বলতে চাইছি তা হলো কোয়ালিফাইড লোকজন আজকাল যেসব বাধার মুখে পড়ছেন তা তুলে নিয়ে তাদের নাগরিকত্ব লাভের পথ সুগম করার কথা।


আমি আরো একটু পরিষ্কার করে বলি। একজন সউদি নারী। তার স্বামী ছিলেন একজন বিদেশি। তিনি মারা গেছেন। এখন সন্তানদের নিয়ে ওই মহিলা ভাসছেন অকুল পাথারে। কেননা তিনি নিজে সউদি হলেও স্বামী বিদেশি হওয়ায় তাদের সন্তানরা কেউ অটোমেটিক্যালি সউদি নাগরিকত্ব পাচ্ছে না। এদেশীয় আমলাতন্ত্রের কাজের ধারার সঙ্গে যারা পরিচিত তারা জানেন, এদেশে নাগরিকত্ব লাভের পন্থাটি দীর্ঘ ও যন্ত্রণাদায়ক। পত্রপত্রিকায়ও আমরা প্রায়ই এরকম খবর দেখতে পাই এবং লোকমুখেও শুনতে পাই যে, এ রকম পরিস্থিতির শিকার সন্তানদের একজনকে হয়তো নাগরিকত্ব দেয়া হলো আর অপরজনকে দেয়া হলো না। এটা কি আপনার সন্তানদের বড় করে তোলার কোনো উপযুক্ত পরিবেশ হলো? ওদের তরুণ মনে এর কী বিরূপ প্রভাব পড়বে, তা কি কি কেউ ভেবে দেখে?


আমি এবার বলি, আরেকটা ঘটনা। আমি এক ইন্ডিয়ানকে চিনি, যিনি ৩০ বছর ধরে আমাদের দেশে বসবাস ও কাজ করছেন। তিনি এদেশেই এক ইন্ডিয়ান নারীকে বিয়ে করেছেন এবং তাদের তিন সন্তানের সবাই এদেশেই জন্মগ্রহণ করেছে। পরিবারের জন্য বছরের পর বছর তিনি কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন। কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না তিনি। সবচাইতে বড় কথা, বহু সউদিকে তিনি ট্রেইনিং দিয়েছেন, যাদের কেউ-কেউ এখন তার কম্পানিতে এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করছেন।


তিনি আমাকে বলছিলেন যে এটাই তার দেশ। এমনকি তিনি যখন ইন্ডিয়াতে আত্মীয়স্বজনদের কাছে বেড়াতে যান, সবকিছুই তার কাছে অনাত্মীয় মনে হয়। এতো দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার পর নিজের দেশকেও কেমন যেন আপন মনে হয় না। এখন তার দুই সন্তান বড় হচ্ছে, ক'দিন পরেই ওদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে। তখন ওদের তিনি কোথায় পাঠাবেন, তাও তার জানা নেই। ভাবছেন, আমেরিকা বা কানাডা পাঠাবেন। কিন্তু এতো দূরে এবং এতো ভিন্ন সংস্কৃতির একটা দেশে ছেলেরা কী করে থাকবে, ভাবতেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। তাই তিনি এদেশের নাগরিক হতে চান। কিন্তু এদেশের নাগরিকত্ব আইনের যেসব শর্ত, সবগুলো তো তিনি পূরণ করতে পারছেন না!


আমার প্রশ্ন হলো, তার সউদি নাগরিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা কেন পূর্ণ হবে না? আমাদের সাংস্কৃতিক বহুমাত্রিকতাকে বন্দী করে রাখার চাইতে একে উন্নত করে আমাদের ক্ষতির চাইতে অনেক বেশি লাভ হয়েছে। অভিবাসীদের ছোঁয়ায় আমাদের রুচি ও চাহিদার অনেক রদবদল ঘটেছে, যদিও আমরা এখনো সেই আদ্যিকালের ''ইউনিক অ্যান্ড স্পেশ্যাল সোসাইটি''র ধারণা আঁকড়ে ধরে বসে আছি।


যারা আমাদের দেশকে অনেক কিছু দিয়েছেন এবং যারা দিতে ইচ্ছুক, আসুন, এবার আমরা তাদেরকে আমাদের পতাকার নিচে সমবেত করি। নিজেদের রক্ত, ঘাম ও অশ্রু দিয়ে তারা এ অধিকার অর্জন করেছেন।


সউদি গেজেট থেকে অনুবাদ : হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী


বিবার্তা/হুমায়ুন/কাফী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com