শিরোনাম
সউদি মায়ের সন্তানেরা
প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০১৭, ২০:২৪
সউদি মায়ের সন্তানেরা
মারাম মক্কাভি
প্রিন্ট অ-অ+

বিদেশির সঙ্গে বিয়ে হয়েছে এমন সউদি নারীদের সন্তানদের সউদি আরবের নাগরিকত্ব প্রদানের ইস্যুটি অনেক পুরনো। সউদি সরকার বিষয়টি নিষ্পত্তি করে সংশ্লিষ্ট অসংখ্য পরিবারের দুর্দশা লাঘব না করা পর্যন্ত ইস্যুটি বার বার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই থাকবে। আমি বলতে চাই, বাবা-মায়ের একজন নন-সউদি বলে সন্তানকে সউদি নাগরিকত্ব দেয়া হচ্ছে না, ব্যাপার কিন্তু তেমন নয়, বরং সউদি মায়ের সন্তানেরাই নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।


আমরা জানি, কোনো সউদি পুরুষ বিদেশিনী বিয়ে করলে তাদের সন্তানেরা সউদি নাগরিকই হয়, কিন্তু বিদেশি পুরুষের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে এমন সউদি নারীদের প্রবাসী সন্তানদের সউদি আরবের নাগরিকত্ব দেয়া হয় না। এর ফলে ভিনদেশে সউদি দূতাবাসের সামনে সন্তানের নাগরিকত্বপ্রত্যাশী সউদি নারীদের সারি ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।


অথচ দেখুন, সউদি পুরুষের বিদেশিনী স্ত্রীর সন্তানরা, এমনকি যদি তারা কখনো সউদি আরবে নাও এসে থাকে এবং আরবী ভাষাও না জানে অথবা তাদের মা যদি অমুসলিমও হয়ে থাকেন, তবু সউদি আরবের আইন ও প্রথা অনুযায়ী তারা সউদি নাগরিকত্বের দাবিদার। তাহলে কেন একজন সউদি নারীর সন্তান তার দেশের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হবে, যখন ওই নারীর স্বামী একজন মুসলিম, নন-সউদি হলেও অনারব নন এবং ওই সন্তানেরা সউদি আরবেই ভূমিষ্ঠ ও লালিতপালিত হয়েছে ?


আমাদের সমাজের এসব আইন ও বিধির বেশিরভাগই প্রণয়ন করেছেন আইনপ্রণেতারা। আমাদের পুরুষশাসিত সমাজ নারী ও পুরুষকে সমান মনে করে না, বরং মনে করে পুরুষরাই হলো কর্তা আর নারীরা তাদের অধীনস্ত। তারা পুরুষদের মা, বোন, স্ত্রী বা কন্যা হয়েই থাকবে। তাদের কোনো স্বতন্ত্র সত্তা কিংবা স্বাধীন ইচ্ছা থাকবে না।


এ-ই যখন অবস্থা, তখন নারীদের ব্যাপারে বৈষম্যমূলক আইন হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সউদি নারীর গর্ভজাত বিদেশি স্বামীর সন্তানরা সউদি নাগরিকত্ব পাবে না, ব্যতিক্রম ছাড়া তারা সরকারি হাউজিং স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে না কিংবা সরকারি ঋণও পাবে না।


এদেশে নারীদের মনে করা হয় পরিবার ও গোত্রের অধীনস্তরুপে। কোনো মেয়ের স্বামী কে হবে, তাও গোত্রই ঠিক করে দেয়। কোনো মেয়ে যদি নিজের স্বামী নিজেই পছন্দ করে এবং তার পরিবারও তাকে মেনে নেয়, তাও সমাজ মেনে নেবে না, যদি না গোত্রের শর্ত পূরণ হয়। কিছু কিছু পরিবার ও গোত্র একে বড় অপরাধ মনে করে থাকে।


যখন কোনো সউদি নারী নন-সউদি কাউকে বিয়ে করার মতো "সামাজিক অপরাধ'' করে ফেলে, তখন তাকে অবধারিতভাবেই এর পরিণাম ভোগের প্রস্তুতিও নিতে হয়। তাকে পরোক্ষভাবে একঘরে হয়ে যেতে হয়, পরিবারে মুখোমুখী হতে হয় নানাবিধ জটিলতার। সউদি সমাজ মনে করে, একজন বিদেশি পুরুষকে বিয়ে করে ওই মেয়ে সউদি পুরুষসমাজকেই চ্যালেঞ্জ করলো। একথা তারা গোপনে এবং কখনো-কখনো প্রকাশ্যেও বলে থাকে। তারা এও বলে, বিদেশির ঘরে রানির মতো থাকার চাইতে কোনো সউদি পুরুষের চার নাম্বার বিবি হওয়াও ভালো।


এরকম ভাবনা ও কথা চলতে পারছে কারণ আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের বিবেচনা করা হয় লঘুচিত্তের মানুষরূপে, যাদের চিন্তাশক্তি কম এবং যারা কিনা কোনটা ভালো কোনটা মন্দ তফাত করতে পারে না। এ ধরনের ঘটনা পৃথিবীর অন্য যে কোনো স্থানেও ঘটে থাকতে পারে, তবে সউদি আরবে যেটা হচ্ছে তা হলো, বিদেশিকে স্বামীরূপে গ্রহণ করায় অনেক সউদি নারীকে নানারকম কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে।


একজন মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দই যে সবসময় ঠিক হবে, বিশেষ করে বিয়ের বেলায়, তা কিন্তু নয়। কিন্তু ন্যায়বিচারের স্বার্থে কিছু বিষয় তো মানতেই হয়। যেমন, কোনো সউদি পুরুষের বিদেশিনী বিয়ে করার ব্যাপারটি। সউদি পুরুষের বিদেশিনী স্ত্রী ও তাদের সন্তানদের নাগরিকত্বে আমার কোনো আপত্তি নেই।


আমাদের সমাজে পুরুষই একজন নারীকে পছন্দ করে এবং তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু নারীদের বেলায় বিষয়টি উল্টো। তাকে অপেক্ষা করতে হয় কখন তার ভাবী বরটি আসবে এবং তাকে গ্রহণ করবে। শারিরীক ও অর্থনৈতিকভাবে সমর্থ একজন পুরুষ এখানে যোগ্য পাত্র বলে বিবেচিত হন, এমনকী তার বয়স যদি ৪০ বছরও হয়। অথচ দেখুন, একটা মেয়ের বয়স ৩০ হলেই তাকে আইবুড়ো বিবেচনা করা হয়।


একজন সউদি পুরুষের তার ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গিনী সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট কিছু ধারণা থাকে - সে দেখতে কেমন, তার জাতীয়তা কী ইত্যাদি। আর ওই মেয়েকে বিয়ে করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে সে যে কোনো দেশে যেতে পারে। কিন্তু কোনো সউদি নারীর জন্য ব্যাপারটা অতো সহজ নয় এবং আমরা কখনো শুনিওনি যে, কোনো সউদি নারী বিয়ে করতে বিদেশ গেছে। যদি যায়ও, তাকে তখন নিতে হবে অভিভাবকের অনুমতি (বিয়ের নয়, ভ্রমণের), পরিবারের বাকি সদস্যদের অনুমতি এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি।


আচ্ছা, সউদি নারীরা কেন বিদেশিকে বিয়ে করতে চাচ্ছে? এর অনেক কারণ আছে। যেমন অনেক পরিবার আছে যারা আরব প্রথা অনুসরণ করে মেয়েকে পাত্রস্থ করতে করতে চায় আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে - জ্ঞাতি ভাই কিংবা অন্য কোনো ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের সঙ্গে। আবার ধরা যাক, মেয়ে একটু বয়সী ও উচ্চশিক্ষিত, কিন্তু সউদি কোনো সুপাত্র তার জুটছে না। সেক্ষেত্রে বিদেশি পাত্রে আপত্তি কিসের?


আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে যে, মেয়েটি হয়তো তালাকপ্রাপ্তা এবং তার ক'টি সন্তানও আছে। আমাদের সমাজের বাস্তবতা হলো, বিয়ের বাজারে এরকম মেয়েদের দাম নেই বললেই চলে। বিদেশিকে বিয়ের আরেকটি কারণ হচ্ছে প্রেম। কর্মস্থলে অথবা কলেজে পড়াকালে প্রেম হতে পারে। মহান আল্লাহই নারী ও পুরুষের মধ্যে প্রেম সৃষ্টি করে দেন।



যেভাবেই হোক, একজন নারীই দেশ ও জাতির সঙ্গে বেশি সংশ্লিষ্ট। মাতৃদুগ্ধের মধ্য দিয়ে সন্তানের মাঝে সঞ্চারিত হয় সদাচার, প্রথা, মূল্যবোধ ও দেশপ্রেম। মায়ের প্রহরাই অন্য যে কোনো কিছুর চাইতে সামাজিক মূল্যবোধের নিকটবর্তী। নাগরিকত্ব দেশের জনমিতি বদলে দেবে বলে যারা শঙ্কিত, এখানেই তার জবাব আছে। আমরা নাজি জার্মানির আর্যদের কথা বলছি না, বলছি মুসলিম ও আরবদের কথা।


বিরুদ্ধবাদীরা আরেকটি যুক্তি দেখান যে, এ ধরনের বিয়ে সউদিদের ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের তীব্রতা আরো বাড়িয়ে দেবে। যারা এসব কথা বলে, তারা ভুলে যায় যে, নাগরিকত্ব একটি মৌলিক অধিকার। হ্যাঁ, নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে ধর্ম, ভাষা অথবা বসবাসের সময় ইত্যাদি কিছু শর্ত থাকতেই পারে। কিন্তু বাজার পরিস্থিতি বদলে যাবে কিংবা অর্থনৈতিক সমস্যা হবে ইত্যাদি অজুহাত কোনোভাবেই কাম্য নয়।


নারীদের গাড়ি চালানোর অধিকার দিয়ে সউদি সরকার একটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছে। আমি নিশ্চিত, বিদেশি বাবা ও সউদি মায়ের সন্তানদের নাগরিকত্ব দিয়ে সরকার অসংখ্য সউদি নারীর দুঃখ-দুর্দশারও অবসান ঘটাবেন। আশা করি, এ ক্ষেত্রে সন্তানের বাবা কোন দেশের নাগরিক, সেটা বিবেচ্য হবে না। নাগরিকত্ব দেয়া হোক সবাইকে ; নারী-পুরুষ বৈষম্য না করেই।


সউদি গেজেট থেকে ভাষান্তর : হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী


বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com