বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের আমন্ত্রণে ৭ এপ্রিল চার দিনের সফরে নয়াদিল্লী গিয়েছেন। এই সফরে তিনি বিভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষর করবেন। তবে সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা সমঝোতা।
গত ১৮ বছর ধরে তিস্তা চুক্তি করার জন্য এতো চেষ্টা, তাকে ছাপিয়ে প্রতিরক্ষা সমঝোতা প্রধান আলোচ্য বিষয় হয় কি করে !
বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদের ভূ-রাজনীতির ওপর দৃষ্টি রাখতে হবে। ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশ এমন জায়গায় অবস্থিত, যা বিশ্বের সুপার পাওয়ার আমেরিকা, চীন, রাশিয়া ও ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি চীনের কাছ থেকে আধুনিক সাবমেরিনসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-সরঞ্জাম কিনেছে। দেশটি বাংলাদেশকে ২৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাবসহ ২৭ টি চুক্তি করেছে। শুধু তাই নয়, দেশের প্রতিটি উন্নয়নে না ডাকতেই পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে।
বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কে কার কী লাভ হচ্ছে ? সংক্ষিপ্ত আকারে প্রথমে চীনের স্বার্থ, তারপর ভারতের স্বার্থ এবং সর্বশেষ বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি দেখবো।
দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মালাক্কা প্রণালী হয়ে ভারত মহাসাগর পার হয়ে রাশিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্রপথ, এ পথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চীন। প্রতিবছর চীন যে তেল আমদানি করে তার সিংহভাগই মালাক্কা প্রণালী হয়ে চীনে প্রবেশ করে। এ কারণে চীনের জন্য ভারত মহাসাগর বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
পাকিস্তানের গাওদার বন্দরের নিয়ন্ত্রণ অনেকটা চীনের হাতে। চীন ইতিমধ্যে এক বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলার এই বন্দরের পিছনে খরচ করেছে। পাকিস্তান ও ইরানের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে চীন গাওদার সমুদ্রবন্দরে তাদের শক্তি বাড়াচ্ছে।
চীন শ্রীলংকার হামবানটোটায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। শ্রীলংকা সরকারের সাথে তামিল টাইগারদের সঙ্গে যুদ্ধে চীন প্রকাশ্যে সরকারকে সাহায্য করেছে।
মিয়ানমারের সিটওয়ে বন্দরসহ বিশাল এলাকাজুড়ে চীনা নৌবাহিনী স্থাপন করেছে একটি রাডার স্টেশন।
চীন এখন চাইছে বাংলাদেশের সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনে সাহায্য করতে। এটি করতে পারলে ভারতকে কাবু করা চীনের জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এভাবে ভারতের প্রতিবেশী পাকিস্তান, মিয়ানমার, শ্রীলংকা , বাংলাদেশ - সব দেশে চীন আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হতে চলেছে অথবা করতে চায়। ধর্মভিত্তিক কূটনীতির খেলায় নেপালকে কাছে টেনে নিয়েছে চীন। যা ভারতকে এই অঞ্চলে একঘরে করার পথে একটি বিরাট পদক্ষেপ । এমনকি চীন তার দেশের জনগণকে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে যেকোন সময় "ওয়ার ফর ওয়াটার" যুদ্ধের প্রস্তুতি রাখতে বলেছে ।
এদিকে ভারতও চীনের সাথে ১৯৬২ সালের মত যুদ্ধে আর হারতে চায় না । অরুণাচল প্রদেশ ও তিব্বত সমস্যা নিয়ে দু-দেশের মধ্যে রয়েছে টানটান উত্তেজনা । স্বাভাবিকভাবে ভারত লক্ষ্য করছে, এ অঞ্চলে চীনের নৌবাহিনীর প্রভাব বৃদ্ধি হচ্ছে। আর সে কারণে বাংলাদেশকে চীনের বলয় থেকে মুক্ত করার লক্ষে ভারত অনেকটা আকস্মিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এ অঞ্চলে চীনের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী জোট গড়ে তুলতে ভারত শুরু করেছে তৎপরতা। ভারত দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর দিকে মনোযোগ দেয়নি। এই সুযোগে এসব দেশে চীনের প্রবেশ প্রভাব বিস্তার অনেকাংশে সহজ হয়ে যায়।
এই অবস্থায় বাংলাদেশের সঙ্গে একটা প্রতিরক্ষা চুক্তি বা সমঝোতা করতে পারলে বাংলাদেশের সাথে যৌথ সামরিক অভিযান, মহড়া, প্রশিক্ষণ, তথ্যবিনিময় ইত্যাদির মাধ্যমে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আরো ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
অনেকেই এই সমঝোতার বিরোধিতা করছে এই বলে যে, এতে নাকি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব খর্ব হবে । কিন্তু প্রতিরক্ষা চুক্তি বিশ্বের অনেক দেশের সাথে অনেক দেশের আছে। যেমন ভারত-আমেরিকা, চীন-পাকিস্তান, রাশিয়া-ইরান। এমনকি যারা বিরোধিতা করছেন, তাঁদের একজন খালেদা জিয়া স্বয়ং বাংলাদেশ-চীন প্রতিরক্ষা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন ।
তাহলে ভারতের সাথে চুক্তিতে এতো কথা উঠছে কেন ? বাংলাদেশের জন্ম থেকেই রয়েছে ভারতের সাথে রয়েছে গভীর সম্পর্ক। ১৯৭১ সালে ভারতের প্রায় ৪০০০ সৈন্য শহীদ হন। তবে বিরোধিতা কেন হচ্ছে ? আসলে একটি ভারতবিরোধী চক্রই এ অপপ্রচার চালাচ্ছে।
এদিকে এতো দিন পর ভারতও বাংলাদেশের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে। তাই একদিন যে মোদী সাহেবের বিজেপি দলের জন্য সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি, তারাই এদেশে সফরে এসে বাংলাদেশকে ঢেলে দেবার প্রবণতা দেখাচ্ছে । প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার জন্য বাংলাদেশকে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের লাইন অফ ক্রেডিট দিতে চাচ্ছে ভারত, যা রীতিমত অকল্পনীয়। তাছাড়া ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির সুযোগ, ভারতের ওপর দিয়ে নেপাল-ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানীর সুযোগ , বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নামে দিল্লীর রাস্তা নামকরণ করা হচ্ছে । শুধু তাই নয়, যে সীমান্ত হত্যা নিয়ে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, তা নিরসনে ভারত সরকার নারী সীমান্ত সেনা নিয়োগ শুরু করেছে, বাংলাদেশের সীমান্তে বাংলাভাষী সৈন্য দেয়ারও তোড়জোড় চলেছে।
আর আজ (৭ এপ্রিল) তো প্রটোকল ভেঙে স্বয়ং ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এয়ারপোর্টে স্বাগত জানাতে এলেন।
ভারত চাচ্ছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই সফরেই ২৫ বছরের প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করতে। কারণ, চীনের সাথে ভারতের অরুণাচল ও তিব্বত নিয়ে যে সঙ্কট চলছে, তাতে ভারত-চীন যুদ্ধ হলে চীন যদি নেপালকে সাথে নিয়ে শিলিগুড়ি করিডোরে আক্রমণ চালায়, তাহলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের সঙ্গে নয়াদিল্লীর যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তখন একমাত্র পথ থাকবে বাংলাদেশের ভুমি ব্যবহার করে যোগাযোগ করা। তাই ভারতের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে একটা প্রতিরক্ষা চুক্তি বা সমঝতা খুব জরুরী ।
কিন্তু চীন থেকে বাংলাদেশের দূরত্ব ১৩০ কিলোমিটারের মত । চীন-ভারত যুদ্ধ হলে তা হবে বাংলাদেশের ভূমিতে, অনেকটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বাফার ষ্টেট বেলজিয়ামের মত - যুদ্ধ করবে দুই দেশ, বোমা খাবে আরেক দেশ।
তারপরেও প্রতিরক্ষা চুক্তি হতে পারে কিন্তু তাতে কোনোভাবেই বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহারের শর্ত থাকা চলবে না । তাছাড়া আন্তঃবাহিনীর যৌথ মহড়া, প্রশিক্ষণ, খেলাধুলাসহ যাবতীয় বিনিময় চুক্তি বন্ধু রাষ্ট্র হিসাবে হতে পারে।
বঙ্গবন্ধু জানতেন, এক দেশের সেনাবাহিনী অন্য স্বাধীন দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ । তাই ১৯৭২ সালে তিনি ভারতকে তার বাহিনী ফেরত নিতে বলেন। তাই আজ বঙ্গবন্ধুর সেই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে, বাংলাদেশের পরাষ্ট্রনীতির ''কারো সাথে শত্রুতা নয়, সবার সাথে বন্ধুত্ব'' নীতির আলোকে দেশের জন্য যা মঙ্গলজনক, তা-ই করবে আমাদের সরকার - দেশের সকল নাগরিকের এটাই প্রত্যাশা ।
লেখক : গবেষক। সমাজকল্যাণ সম্পাদক, ঢাকা ইউনিভার্সিটি রিসার্চ সোসাইটি
বিবার্তা/হুমায়ুন/পলাশ
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]