শিরোনাম
অটিজম: বেদনা বলতে না পারার নীল কষ্ট
প্রকাশ : ০২ এপ্রিল ২০১৭, ১০:৫২
অটিজম: বেদনা বলতে না পারার নীল কষ্ট
মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ
প্রিন্ট অ-অ+

স্রষ্টার সৃষ্টি, জগৎশ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষ। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তার জ্ঞান, বিবেক ও বুদ্ধির জন্য। স্রষ্টার মহাশক্তির রহস্য উদ্ঘাটনে মানব সাফল্য অতি নগণ্য। জীববিজ্ঞানে মানব সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত। জীবন রহস্যের উপর নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্ব মানবের নেই। বরং একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক মহান স্রষ্টা। সকলের প্রত্যাশা ফুটফুটে, সুন্দর ও স্বাভাবিক শিশু। যারা সাধারণ মানবীয় বৈশিষ্ট ও গুণাবলীর অধীকারী। বিকাশজনিত ক্রটির শিকার মানবশিশু স্বাভাবিক শিশু নয়। তাদের আচরণে অস্বাভাবিকতা লক্ষণীয়। যারা একটি পরিবারের দুঃখ, বেদনা, হতাশা ও যন্ত্রণায় সঙ্গী। আমরা অনেকে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল বা সমব্যথী। অনেকে তাদের প্রতি প্রদর্শন করি কুৎসা, অবজ্ঞা, অবহেলা বা বঞ্চনা।


আমি একজন পেশাদার সমাজকর্মী। রাষ্ট্রের চিহ্নিত অন্যতম সামাজিক সমস্যা এবং মানবিক সমস্যা মোকাবেলা আমার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়লধীন কর্মরত সকল পেশাদার সমাজকর্মী সামাজিক সমস্যা মোকাবেলায় একযোগে কাজ করছে। এটি জাতি গঠনমূলক অন্যতম সরকারি দফতর। এ বিভাগের আওতায় প্রতিবন্ধী সমস্যা, প্রবীণ সমস্যা, দারিদ্র্য নিরসন, শিশু সুরক্ষা, বিধবা, এতিম, রোগীকল্যাণসহ বিবিধ কল্যাণধর্মী কাজই আমাদের কর্মযজ্ঞ।


আজ ২ এপ্রিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। আবেগহীন, অনুভূতিহীন ও অসহায় মানুষের প্রতি সহমর্মিতা বা ভালবাসা প্রদর্শনের দিন। জাতিসংঘ বিশ্ব বিবেক জাগরণকারী সর্ববৃহৎ সংস্থা। ২০০৮ সাল হতে এ সংঘের উদ্যেগে এ দিবসটি প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্রে পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রতিবছর যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালিত হয়। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য ‘স্বকীয়তা ও আত্মপ্রত্যয়ের পথে’।


সমাজকর্মের ধারণামতে প্রত্যেক ব্যক্তি হলো স্বতন্ত্র সত্তার অধিকারী। সমাজকর্মের মূল বিষয় Client বা ব্যক্তি’। Client বলতে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিকে বুঝায়। যে আত্মসমস্যা মোকাবেলায় ব্যর্থ। প্রয়োজন অপরের সহযোগিতা। সমাজকর্মী বা সমাজের সক্ষম ব্যক্তি হিসেবে সমস্যাগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করা আমাদের কর্তব্য। অটিজম শিশুকে সক্ষম এবং আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ হিসেবে গড়তে হবে। এটাই দিবসের মূল আবেদন।


‘অটিজম’ শব্দটি গ্রীক শব্দ Autos থেকে এসেছে। যার ইংরেজী হলো Self এবং বাংলা অর্থ ‘স্বয়ং বা স্বীয়’। ইংরেজি Autism এর বাংলা অর্থ আত্মসংবৃতি বা মানসিক রোগ বিশেষ। এ রোগে আক্রান্ত শিশুরা অস্বাভাবিকভাবে নিজেদেরকে গুটিয়ে রাখে নিজের মধ্যে। তারা বহুলাংশে নিঃসঙ্গ মানুষ। তারা অন্যের সাথে সামাজিক বা আবেগিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে না। এরা অন্য মানুষের চিন্তা, অনুভূতি ও চাহিদাকে বুঝতে পারে না। ব্যক্তির এরূপ আচরণ পর্যবেক্ষণ করে সর্বপ্রথম পল ইউজেন ব্লু-লা নামের একজন চিকিৎসক। তিনি ১৯১২ সালে এ সমস্যার নামকরণ করেন ‘অটিজম’ যার বাংলা অর্থ ‘আত্মমগ্ন’ ব্যক্তি। পরবর্তীতে ১৯৪৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের John Hopkins Hospital এর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. লিও ক্যানার এ সমস্যায় আক্রান্ত ১১টি শিশুর দলকে নিয়ে অধ্যয়ন করেন। তিনি প্রথম এর নামকরণ করেন ÔEarly Infantile AutismÕ। দ্য আমেরিকান হেরিটেজ ডিকশনারী অব দ্যা ইংলিশ ল্যাগুয়েজ এর সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘অটিজম হলো, শিশুর ব্যাপক বিকাশজনিত অসমর্থতা, যার বৈশিষ্ট্য হলো সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রবল ঘাটতি এবং ক্রিয়াকলাপ ও মনোযোগের চরম সীমাবদ্ধতা এবং পুনরাবৃত্তি নির্দিষ্ট কিছু আচরণ’। মূলত অটিজম হচ্ছে শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশের ক্ষেত্রে এক প্রকার প্রতিবন্ধকতা। সাম্প্রতিকালে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশজনিত অসুবিধাকে সমন্বিতভাবে Autism Spectrum Disorder বা ASD বলা হচ্ছে।


অটিজম শিশুর লক্ষণসমূহ একেক শিশুর ক্ষেত্রে একেক রকম হয়। যথা ক. স্বাভাবিক শিশু ৬ মাসে হাসে কিন্তু অটিজম শিশু ৬ মাসেও হাঁসে না। খ. সাধারণত শিশু ১ বছরের মধ্যে কিছু না কিছু শব্দ উচ্চারণ করে কিন্তু অটিস্টিক শিশুর মুখে ১ বছরেও কোন শব্দ শুনা যায় না। গ. মৌখিক বা অমৌখিক যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা। ঘ. একই ধরনের বা সীমাবদ্ধ কিছু কাজ বা আচরণের পুনরাবৃত্তি।ঙ. শ্রবণ, দর্শন, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ, ব্যথা, ভারসাম্য ও চলনে অন্যদের তুলনায় বেশি বা কম সংবেদনশীলতা। চ. এক বা একাধিক নির্দিষ্ট বিষয়ে অসাধারণ দক্ষতা। ছ. চোখে চোখ রাখা বা কম রাখা। জ. অতিরিক্ত চঞ্চলতা ও অস্বাভাবিক শারীরিক অঙ্গভঙ্গি। ঝ. একই রুটিনে চলার প্রচণ্ড প্রবণতা। ঞ. অটিস্টিক শিশু খুব জেদী প্রকৃতির হয়। ট. অটিস্টিক শিশু নিজ বাসা থেকে অন্য বাসায় যাওয়া পছন্দ করে না।


বিশেষজ্ঞদের মতে, অটিজমের সুস্পষ্ট কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে অটিজম একটি স্নায়ুবিক বিকাশজনিত সমস্যা। সমাজবিজ্ঞানে মানব বিকাশের মোট ১০টি স্তরের উল্লেখ আছে। ১ম স্তর: (Pre-natal Period) মানব ভ্রুণ সৃষ্টি হতে জন্ম লাভ পর্যন্ত। ২য় স্তর: নবজাতক (Infancy) জন্ম হতে জন্ম পরবর্তী ২য় সপ্তাহ পর্যন্ত। শিশুর সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক বিকাশ ধরার জন্য এ দু’ স্তরে প্রয়োজন মানুষের বংশগত ও পরিবেশগত উপাদানের সক্রিয় কার্যকারিতা। অন্যথায় সৃষ্ট হয় জন্ম জটিলতা। জন্ম জটিলতার বেশীর ভাগ সূত্রপাত ঘটে ভ্রুণ সৃষ্টিকালে। অর্থাৎ গর্ভধারণ কালে। জীবন প্রণালীর সর্বক্ষেত্রে নৈতিক ও ধর্মীয় জীবন অনুশীল করতে হবে। এটা বিকাশধারার স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণে বহুলাংশে সহায়ক।


শিশুর বিকাশজনিত জটিলতার ক্ষেত্রে শুধু জীনগত ত্রুটি দায়ী নয়। কিছু জৈবিক ও পরিবেশগত উপাদানও দায়ী। এগুলো হলো মায়ের অপুষ্টি ও ভিটামিন স্বল্পতা, বাবা-মায়ের বয়স ও গর্ভধারণ সংখ্যা, মায়ের শারীরিক ও আবেগীয় স্বাস্থ্য, মায়ের অসুস্থতা ও ঔষুধের প্রতিক্রিয়া, গর্ভকালীন অক্সিজেনের অপর্যাপ্ততা, গর্ভকালীন রঞ্জনরশ্মি ও রেডিয়ামের প্রভাব, গর্ভকালীন ভাইরাসজনিত রোগ, তেজস্ক্রিয়া, সামাজিক বঞ্চনা, মাদকদ্রব্য ও ধূমপান ইত্যাদি। গর্ভপূর্ব ও গর্ভকালীন সময়ে মায়ের প্রতি অতি সংবেদনশীল হতে হবে। সচেতনতার সাথে তার মানসিক চাহিদা ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে হবে।


মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, অটিস্টিক শিশুর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী ফলপ্রসূ চিকিৎসা পদ্ধতি। এ চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পূর্ণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন। একজন রোগীকে নিয়মিত বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত চিকিৎসা নিতে হয়। ধীরে ধীরে শিশুটি সম্পূর্ণ বাস্তব জগতে ফিরে আসে। পরিবার, স্কুল ও কমিউনিটির মধ্যে তাকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে। না হয় অটিস্টিক শিশুটিকে আজীবন একাকীত্ব বরণ করতে হবে। চিকিৎসাহীন অটিস্টিক শিশুরা পরনির্ভরশীল জীবনযাপন করে। তাদের জীবন অতি ভয়াবহ। এরা স্বাভাবিক শিশুর মত নিজে থেকে বেশী কিছু শিখতে পারে না। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে না। অভিভাবকরা অনেক সময় ব্যর্থ হয়ে শিশুটিকে Gifted Child বা Special Child হিসেবে ধরে নিয়ে সান্ত্বনা খোঁজে।


‘অটিজম’ একটি সামাজিক সমস্যা এবং মানবিক সংকট। বাংলাদেশে অটিজমের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিরূপ প্রভাব লক্ষণীয়। ক. অটিস্টিক শিশুদের পরিবার ও সমাজ বিরাট বোঝা মনে করে। তারা সামাজিকভাবে চরম উপেক্ষিত। খ. অটিস্টিক শিশুর পরিবারকে সমাজের লোকেরা এড়িয়ে চলে, পরিবারটি হীনমন্যতায় ভুগে। গ. অটিস্টিক পরিবারে ছেলে মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না, পরিবারটি একঘরে হয়। ঘ. পরিবারের সদস্যরা লোকলজ্জার ভয়ে এবং বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে অটিস্টিক শিশুকে বাইরে নিতে চায় না। ঙ. অটিস্টিক শিশুর চিকিৎসার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। চ. অটিজম শিশুকে সমাজ থেকে লুকিয়ে রাখা এবং গৃহবন্ধী করে রাখা হয়। ছ. অটিস্টিক শিশুর মায়ের অবস্থা করুণ। কন্যা শিশু জন্মদানসহ সকল অস্বাভাবিক শিশু জন্মদানের জন্য মাকে দায়ী করা হয়। জ. অনেক দরিদ্র পরিবার অটিস্টিক শিশু নিয়ে ভিক্ষা করে নতুবা ভিক্ষা ব্যবসায়ীরা অটিস্টিক শিশুকে লুফে নেয়।


অটিজম পরিবার সামাজিকভাবে নিগৃহীত। অর্থনৈতিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অটিস্টিক পরিবারের দুশ্চিন্তা, হতাশা ও যন্ত্রণা অত্যন্ত পীড়াদায়ক।


বাংলাদেশের সংবিধান মানবাধিকারের এক অনন্য দলিল। সংবিধানে দেশের সকল ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অধিকার সংরক্ষণে বিশেষ নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদে উল্লেখ ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতাহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারী সাহায্য লাভের অধিকার।’


বর্তমান সরকার সমাজকল্যাণবান্ধব সরকার। অসহায়, বিপন্ন ও নিগৃহীত মানুষের কল্যাণে সরকার বহু ধাপ এগিয়ে। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর কল্যাণে সরকার প্রণয়ন করেছে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩’। এই আইনে Autism বা Autism Spectrum disordersসহ ১২ ধরনের প্রতিবন্ধীর ধরন উল্লেখ আছে। এই আইনে সকল ধরনের প্রতিবন্ধীর পূর্ণমাত্রায় বেঁচে থাকা, আইনি স্বীকৃতি, শিক্ষা, চিকিৎসা, উত্তরাধিকার প্রাপ্তিসহ সকল প্রকার নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। তাছাড়া অটিজম, ডাউন সিনড্রোম, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা ও সেরিব্রাল পালসি হলো নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধিতা। যারা জন্মগত ক্রটি বা স্নায়ুবিক বিকাশজনিত সমস্যার শিকার। তাদের বিশেষ সুরক্ষায় সরকার প্রণয়ন করেছে‘নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন-২০১৩’। সরকার ২১ কোটি টাকা দিয়ে প্রারম্ভিক ট্রাস্ট্র ফান্ড গঠন করেছে। অটিজমসহ সকল নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বার্থে এ অর্থ ব্যয় হচ্ছে।


যেকোন সামাজিক সম্যাসা একান্ত অনভিপ্রেত। একান্ত মানবিক ইস্যু, সামাজিক সমস্যা মোকাবেলায় প্রয়োজন সামাজিক গবেষণা। প্রয়োজন সামাজিক জরিপ। প্রতিবন্ধিতাকে অন্যতম সামাজিক সম্যসা হিসেবে চিহ্নিত করেছে সরকার। এ পরিপ্রেক্ষিতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধিতা সনাক্তকরণ জরিপ ২০১৩ সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। এ জরিপের আওতায় Disability Information Sytem (DIS) নামে একটি শক্তিশালী Software চালু করা হয়। এখানে সকল ধরনের প্রতিবন্ধীদের Data সন্নিবেশ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে জরিপকৃত এবং সনাক্তকৃত প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ১৫ লাখ ৮০ হাজার। তন্মধ্যে অটিজম ব্যক্তির সংখ্যা ৪০ হাজার ৭৯৭ জন। সমগ্র দেশে ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। প্রতিটি সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে একটি ‘অটিজম ও এনডিডি’ কর্ণার চালু আছে। জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন প্রাঙ্গণে ২০০১ সালে চালু হয় ‘অটিজম রিসোর্স’ সেন্টার। উদ্দেশ্য অটিজম আক্রান্ত শিশুদের বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদান এবং অটিজম বিষয়ক গবেষণা করা।


অটিজম শিশুর শিক্ষার জন্য ২০১১ সালে মিরপুর প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন প্রাঙ্গণে চালু করা হয় ‘স্পেশাল স্কুল ফর চিলড্রেন উইথ অটিজম’ নামে সম্পূর্ণ অবৈতনিক স্কুল। বর্তমানে সমগ্র দেশে ১১টি অটিজম স্কুল আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অটিজম নিয়ে বিশেষ উদ্যোগী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা হয়েছে Cente for Neurodevelopmet & Autism in Children। তাছাড়া অটিজমসহ নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী শিশুদের বিকাশের জন্য দেশের ১৫টি মেডিকেল কলেজ ১৫টি ‘শিশুবিকাশ কেন্দ্র’ চালু করেছে।


বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব অটিজম নিয়ে বেশ সচেতন। চলতি দশকে এই উপমহাদেশে অটিজম ২টি আর্ন্তজাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ‘ঢাকা ঘোষণা ২০১১’ এবং ‘দিল্লি ঘোষণা ২০১৩’ এর মাধ্যমে অটিজম বিষয়ে গৃহীত আর্ন্তজাতিক উদ্যোগ অত্যন্ত ফলপ্রসূ। এক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন আর্ন্তজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিশু মনোবিজ্ঞানী সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল। তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কন্যা। অটিজমবিষয়ক জাতীয় উপদেষ্ট কমিটির সভাপতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিবন্ধিত অটিজম এক্সপার্ট। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে বিশেষ করে অটিজম ও স্নায়ু বিকাশজনিত সমস্যা নিরসনে অসামান্য অবদান রাখার জন্য জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপার্সন সায়মা ওয়াজেদ হোসেনকে WHO Exccellence Award পদকে ভূষিত করা হয়। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অবস্থিত ব্যারি ইউনির্ভাসিটি কর্তৃক Distinguished Alumni Award প্রদান করা হয়।


অটিস্টিক ব্যক্তির জগৎ আমাদের জগতের চেয়ে ভিন্ন। এ জগতে কেউ প্রবেশ করতে পারে না। তাই এ জগৎকে আমরা বলতে পারি ‘নীল জগৎ’। তারা কি করে, কীভাবে দেখে তার অতি সামান্যই আবিষ্কার করা সম্ভব। কারণ তাদের অধিকাংশই এর বিবরণ দিতে অক্ষম। কোনভাবেই পারে না তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করতে। প্রতিটি অটিস্টিক শিশু বা ব্যক্তি একে অপরের চেয়ে ভিন্ন। কারো সাথে কারোর তুলনা বা সাধারণীকরণ যায় না। তারা নীল জগতে আত্মবন্ধী। এ জগৎ ছিন্ন করে সামাজিক পরিবেশে আগমন কঠিন। প্রয়োজন পারিবারিক ও সামাজিক সহযোগিতা।


এক্ষেত্রে অনন্য উদাহরণ ‘পাপাই’ নামে সমাজসেবা পরিবারের এক অটিস্টিক শিশু। আমাদের নিকট অতি আদরের। তার বাবা সমাজকল্যাণ বিভাগের একজন পদস্থ কর্মকর্তা। একজন পেশাদার সমাজকর্মী এবং যোগ্য অভিভাবক। বিশেষ শিশুর বিকাশ ও সামাজীকরণে তার প্রচেষ্টা প্রসংশনীয়। নিসংকোচে প্রিয় শিশুকে নিয়ে সর্বত্র অংশগ্রহণ সমাজের জন্য দৃষ্টান্ত। অটিস্টিক পরিবারের জন্য অনুপ্রেরণা।


সৃষ্টি জগৎ রহস্যময়। কোন সৃষ্টি উদ্দেশ্যহীন নয়। প্রত্যেক সৃষ্টিতে আছে সৃষ্টার নিদর্শন। আছে অনন্য দৃষ্টান্ত। ক্ষণস্থায়ী জগৎ, পারলৌকিক জগতের পরীক্ষাগার। অসহায়, অক্ষম ও নিগৃহীত মানুষের প্রতি ক্ষীণ সহানুভূতি ও ভালবাসা প্রদর্শন করতে হবে। এখানেই মানব শ্রেষ্ঠত্ব। যা শুধুমাত্র সুস্থ, সবল ও সক্ষম মানুষের পক্ষে প্রমাণ করা সম্ভব। আজকের সাহায্য প্রার্থী দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ যারা, তারাই হবে মহাকালের পরম বন্ধু। অনন্তকালের অনন্য স্বাক্ষী।


লেখক: উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা, লামা


বিবার্তা/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com