শিরোনাম
‘চেতনাগত অসমতা’-ই নারী অধিকারের অন্তরায়
প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০১৭, ১১:৫৩
‘চেতনাগত অসমতা’-ই নারী অধিকারের অন্তরায়
জিয়াউদ্দিন সাইমুম
প্রিন্ট অ-অ+

নারী কি তার অধিকারের ব্যাপারে সত্যিই সচেতন? অথবা সমাজের সব স্তরের নারীর কাছে কি অধিকারের কথা সমানভাবে পৌঁছে? নারী কি চাইলেই সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক বাধা ডিঙাতে পারে? অথবা বলা যায়, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবার পরও কি নারী তার অধিকারকে সব জায়গায় প্রতিষ্ঠা করতে পারে? দুঃখজনক হলেও সত্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি নারীকে যত না অধিকার–সচেতন করে তোলে, তারচেয়ে বেশি তাকে ‘পণ্য’ বানায়। নারী এই বিষয়টি গভীরভাবে তলিয়ে দেখে না বলেই নারী দিবসে সে অনুষ্ঠান-সর্বস্বতায় মেতে প্রতারিত সান্ত্বনায় মাঝে ডুবে থাকে।


বরাবরের মতো এবারও আন্তর্জাতিক নারী পালিত হচ্ছে। তবে এখন আর ৮ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয় না, মার্চের শুরু থেকেই নারী দিবসের কর্মসূচি লেগে থাকে। বলা যায়, এতে দিবসটিতে যানজটের মতোই ‘কর্মসূচিজট’ লেগে যায়। এসব কর্মসূচিকে হয়তো ইতিবাচক মনে করা যেতে পারে। কিন্তু তাতে নারী আসলে এগোয় না। বরং এটা বলা নিরাপদ, দিনটি আছে বলেই বছরে একবার হলেও যার যার মতো করে বিশ্লেষণ করা হয়- নারী এগোতে পারল কি পারল না।


আমাদের মনে রাখা দরকার, নারীর অধিকারের সাথে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনাটি জড়িত। গরিব, মধ্যবিত্ত ও ধনী নারীর মধ্যে ফারাক এখন কেমন বা তাদের শ্রেণীগত অবস্থানের পার্থক্য অনুযায়ী নারীর অবস্থানের পরিবর্তনের বিষয়টি কেমন, তা বিবেচনায় এনে নারী অধিকারের সার্বজনীন আবেদন খুব একটা শোনা যায় না। তাই দিনটি অনুষ্ঠান আর ঘোষণানির্ভর হয়ে যাচ্ছে।


আমাদের মনে রাখা দরকার, নারীর ক্ষমতায়ন শুধু নারীর জন্য নয় বরং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির সমৃদ্ধির প্রশ্নই নারীর ক্ষমতায়নের উপর নির্ভরশীল। সেদিক দিয়ে নারী দিবসের গুরুত্ব উপলব্ধি করা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া আমাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বও বটে।


জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে ১৯৭৫ সালে। কিন্তু দিবসটির ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ তারিখে নিউইয়র্কে হাজার হাজার নারীশ্রমিক সমবেত হয়েছিল। তাদের অধিকাংশই ছিল গার্মেন্টস শ্রমিক। তাদের কর্মস্থল ছিল অমানবিক, জীবনযাপন ছিল মানবেতর। বেতন ছিল অতি সামান্য, কিন্তু কাজ ছিল ১২ ঘণ্টা। কর্তৃপক্ষের অমানুষিক নির্যাতনের প্রতিবাদে সেদিন তারা রাস্তায় নেমেছিল, মত প্রকাশ করেছিল, মিছিল করেছিল। সেই মিছিলে পুলিশ হামলা করেছিল। অধিকার আদায়ের সকল আন্দোলনেই পুলিশ হামলা করে, কারণ পুলিশ রাষ্ট্রের পাহারাদার এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা থাকে শোষকের পক্ষে। কিন্তু পুলিশী হামলার কারণে সভ্যতার ক্রমবিবতর্নের কাজ বসে থাকে না, প্রগতির চাকা থেমে যায় না। তাই ওই ঘটনার দু‘বছর পর সেখানকার নারী-শ্রমিকেরা পুনরায় সমবেত হয়ে একটি ইউনিয়ন গড়ে তুলেছিল। আজ থেকে দেড়শ বছর আগে পৃথিবীর অপর প্রান্তে সেদিন যে সকল মহিলারা জমায়েত হয়েছিল তাদের প্রত্যেকের পদতলে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।


এখন নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হয় মূলত সমতা অর্জনের এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার। অথচ আমরা যখন ‘নারী’ বলি, সেই নারী কে, তা পরিষ্কার করে উচ্চারণ করি না। শ্রেণীগতভাবে নারীদের মধ্যে অনেক বিভেদ আছে। নারীর ক্ষমতায়ন বললে সব নারীর ক্ষমতায়ন একইভাবে হয় না। আন্তর্জাতিকভাবে নারী অধিকার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নারীর শ্রমের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আগে হয়েছে, নাকি নারীর ব্যক্তি অধিকারের আলোকে হয়েছে, এটি খতিয়ে দেখার বিষয়। নারী আন্দোলনের ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেবে।



তবে ‘নারীবাদী’ হওয়ার সঙ্গে শ্রমিক নারীর অধিকার সবসময় গুরুত্ব পায়নি। শ্রমিক নারীর পক্ষে বলার অর্থ সবসময় নারীবাদিতার চরিত্রের মধ্যেও পড়েনি। তার একটি কারণ হচ্ছে, নারীবাদী আন্দোলন বা ফেমিনিজম নিয়ে যারা কাজ করেছেন, তারা নিজেরা শ্রেণীগতভাবে শ্রমিকের পর্যায়ে পড়েন না। তারা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কিংবা বর্ণের দিক থেকেও শ্রমিক নারী থেকে ভিন্ন।


এ কারণে নারী শ্রমিকের অধিকারের বিষয়টি এখনো মূলস্রোতের নারী আন্দোলনের অংশ নয়। কারখানায় যে নারী কাজ করে সেও নারী বটে, কিন্তু নারীবাদ নারীর বিশেষ বায়োলজিকাল চিহ্ন নিয়ে যতোটা চিন্তিত, নারীর শরীর নিয়ে ততোটা চিন্তিত নয়।


বাংলাদেশে নারীমুক্তির চিন্তাচেতনায় বেগম রোকেয়াও নারীকে পুরোপুরি শ্রমিক হিসেবে দেখেননি; তিনি দেখেছেন তার সার্বিক বঞ্চনা ও স্ত্রীজাতির অবনতির অবস্থা এবং সেখান থেকে মুক্তির জন্য নারীকে প্রস্তুত করবার কর্তব্যের দিক থেকে নারীকে দেখেছেন। নারীমুক্তির জন্য নারীকে কেরানি হোক বা জজ-ব্যারিস্টার, কিছু একটা হওয়ার স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছেন। বর্তমানে নারীরা সেই কাজটি করছেন সফলভাবেই। সার্বিকভাবে নারীকে কর্মক্ষেত্রে আনার বিষয়টি রোকেয়া কখনই ভুলে যাননি। সেদিক থেকে বলব, পশ্চিমা নারীবাদের তুলনায় বেগম রোকেয়ার চিন্তা সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অগ্রসর ছিল।


আন্তর্জাতিক নারী দিবস জাতিসংঘের ঘোষণায় আসার পর থেকে দিবসটি নিয়ে সরকার ও নারী উন্নয়নে নিয়োজিত এনজিওগুলোর মধ্যে আগ্রহ বেশি বেড়েছে। টাকাও আসছে ভূরি ভূরি। এটা দাবিদাওয়া বা সমতার পর্যায়ে আর থাকেনি। প্রতি বছর জাতিসংঘের পক্ষ থেকে একটি প্রতিপাদ্য ঠিক করে দেয়া হয়, তারই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ও নারী সংগঠনগুলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিষয় নির্ধারণ করে। অথচ ১৯৯৬ সাল থেকে যেসব প্রতিপাদ্য জাতিসংঘ ঠিক করে দিয়েছে, তার মধ্যে একটিতেও শ্রমিকের অধিকারের কথা বিন্দুমাত্র উল্লেখ নেই। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। যেমন নারী ও শান্তি (১৯৯৭), নারী ও মানবাধিকার (১৯৯৯), সংঘাত নিরসনে নারী (২০০১), আফগান নারীর বাস্তবতা ও সম্ভাবনা (২০০২), নারীর সমতা ও এমডিজি (২০০৩), নারী ও এইডস (২০০৪), নারী ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ (২০০৬), গ্রামীণ নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নিরসন (২০১২) ইত্যাদি। এ বছরের প্রতিপাদ্য তারা যেভাবে দিয়েছে তা হচ্ছে- ‘নারীপুরুষ সমতায় উন্নয়নের যাত্রা, বদলে যাবে বিশ্বকর্মে নতুন মাত্রা’। দেখাই যাচ্ছে, নারী শ্রমিকের দাবি হারিয়ে গেছে। এতে নারী আন্দোলন সমাজের সব স্তরের নারীদের মধ্যে বৈষম্য দূর করে শক্তিশালী হয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথটাও বন্ধ রয়ে যায়।


পুঁজিতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থায় নারীদের সুযোগ সৃষ্টি হয়, কিন্তু তা এখনো খুব সীমিত। এখনো বিশ্বের ৫০০টি বড় কোম্পানির সিইওর মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ নারী। করপোরেট বোর্ডেও নারীর সংখ্যা খুব কম, নেই বললেই চলে। একবার ভাবুন তো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটন যদি সব মার্কিন নারীর ভোট পেতেন, তাহলে তিনি আমেরিকার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন কিনা! কিন্তু হিলারি নারী হয়েও দেশের সব নারীর ভোট পাননি। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।


বলা হয়ে থাকে পুরুষতান্ত্রিক ও পুঁজিতান্ত্রিক শোষণ যখন এক বা একীভূত হয় তখন তা নারীর জন্য অনেক বেশি নিষ্ঠুর ও নির্মম হয়ে ওঠে। অথচ পুরুষতন্ত্রকে স্রেফ অর্থনৈতিক সম্পর্ক হিসেবে বোঝা যায় না, তার নির্দিষ্ট চরিত্র রয়েছে, যা বিভিন্ন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহণ করে। সমাজ বিপ্লবের ধারণার উদ্দেশ্যের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্কের রূপান্তরই প্রধান প্রতিপাদ্য হিসেবে এখনও বহাল। এর ফলে পুরুষতান্ত্রিক সম্পর্কের রূপান্তর বা বিনাশের প্রশ্ন আজও প্রধান হয়ে উঠতে পারেনি। এর সমাধান নারী কিভাবে দিতে পারে, সে কর্মপন্থা অনির্ধারিত রয়ে গেছে।


নারীবাদের ধ্যান-ধারণার অন্যতম সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, এই কনসেপ্টটিতে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বেশি উচ্চারিত হয়। অথচ নারীকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিলেই যে নারী অধিকার নিয়ে চলমান সব সমস্যার সমাধান হয় না, তা বাংলাদেশসহ অনেক দেশের উদাহরণ দিয়ে বোঝানো কঠিন কিছু নয়। আবার যারা মনে করেন, নারীকে ক্ষমতার আসনে বসিয়ে দিলে তিনি নারীর পক্ষে পুরুষের তুলনায় বেশি সংবেদনশীল হবেন, তারাও ভুল প্রমাণিত হয়েছেন। কারণ ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়ার নীতি ব্যক্তিকেন্দ্রিক হবার কারণে তারাও অজান্তে পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার খপ্পরে পড়ে যান এবং অন্য সব নারীকে পেছনে রেখে নিজে এগিয়ে যান। তাই বিশ্বখ্যাত নারীবাদী সুসান ফালুদিও সংশয় প্রকাশ করেছ বলেছেন, ‘You can’t change the world for women by simply inserting female faces at the top of an unchanged system of social and economic power.’


এখনকার পুঁজিতন্ত্রের রূপ বিশেষভাবে আসছে করপোরেট পুঁজি হিসেবে। তারা আমাদের কৃষিতে ঢুকে পড়ছে, পরিবেশ নষ্ট করে বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ করে সুন্দরবনসহ মানুষের জীবন-জীবিকা ধ্বংস করছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, করপোরেট পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে নারীবাদীরা গা বাঁচিয়ে মন্তব্য দেন। এর কারণটাও স্পষ্ট। যেসব নারী তাদের অধিকার নিয়ে বেশি বাতচিত করেন, তাদের বেশির ভাগই করপোরেট-সেলিব্রিটি অথবা এনজিও নেত্রী।


আসলে নারী যেমন মানুষ, যেমন পুরুষও মানুষ। এই উপলব্ধির জন্য যতটা না সভ্য ও আধুনিক হওয়া প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন মানবিক হওয়া। আসুন আমরা মানবিক হই, নারী পুরুষ মিলে একটা মানবিক পৃথিবী গড়ি। আর যারা নারীকে কেবল গণিমতের মাল ভাবতে অভ্যস্ত, তারা না মানবিক না ধার্মিক। পাশাপাশি পুরুষকেও এটা মানসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বিশ্বাস করতে হবে, নারীর জন্য সমতা নিঃসন্দেহে সমাজকে এগিয়ে নিবে– এটা গণিতের নিয়মের মতোই স্বতঃসিদ্ধ।


লেখক: সাংবাদিক, গবেষক


বিবার্তা/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com