সাক্ষাতকার
শেখ রাসেলের জীবনী থেকে শিশুদের অনেক কিছু শেখার আছে: সেলিনা হোসেন
প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২৩, ১০:০৭
শেখ রাসেলের জীবনী থেকে শিশুদের অনেক কিছু শেখার আছে: সেলিনা হোসেন
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তী। বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলা একাডেমির সভাপতি হিসেবে। বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল এই নক্ষত্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর কনিষ্ঠপুত্র শেখ রাসেলকে নিয়ে লিখেছেন শিশুতোষ গ্রন্থ ‘রাসেলের জন্য অপেক্ষা’।


নন্দিত এই সাহিত্যিক ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন রাজশাহী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব কেটেছে বাবার কর্মস্থল বগুড়ায়। পরে রাজশাহীতেও থেকেছেন দীর্ঘকাল। এখানে হাই স্কুল ও কলেজ জীবন শেষ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে স্নাতক এবং ১৯৬৮ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।


তাঁর লেখালেখি শুরু হয় ষাটের দশকের মধ্যভাগে কলেজে পড়ার সময়। সেই সময়ের লেখা নিয়ে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে উপন্যাস ৪৫টি, গল্পগ্রন্থ ১৬টি, প্রবন্ধগ্রন্থ ১৫টি, শিশু সাহিত্য ৪১টি, সম্পাদিত গ্রন্থ ১১টি এবং ইংরেজি অনুবাদ ১২টি।


সেলিনা হোসেন দীর্ঘদিন বাংলা একাডেমিতে চাকরি করেছেন। একাডেমির পরিচালক পদে থাকা অবস্থায় তিনি অবসর গ্রহণ করেন। পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির। এ ছাড়া তিনি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনেরও সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি বাংলা একাডেমির সভাপতি।


সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য ড. মুহম্মদ এনামুল হক স্বর্ণপদক (১৯৬৯), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮০), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৬ ও ১৯৯৭) ও একুশে পদকসহ (২০০৯) অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন।


বরেণ্য এই সাহিত্যিক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলকে নিয়ে লিখেছেন ‘রাসেলের জন্য অপেক্ষা’ নামক গ্রন্থ। শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষ্যে রাসেলকে নিয়ে তাঁর ভাবনার বিষয়ে তিনি বিবার্তার মুখোমুখি হয়েছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বিবার্তা প্রতিবেদক মহিউদ্দিন রাসেল।


বিবার্তা : শেখ রাসেলের জন্মদিন ১৮ অক্টোবর। তার জন্মদিন নিয়ে বিশেষ কোন স্মৃতির কথা আপনার মনে পড়ে কি?


সেলিনা হোসেন : ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের জন্ম হয়। তাকে নিয়ে যদি আমি স্মৃতির কথা বলি, তাহলে তার দুটি ছবি আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। একটি ছবি ১৯৭১ সালের। তখন তার বয়স মাত্র ৭ বছর। ওই বয়সী একটি শিশু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সেই পতাকায় লাল রঙের যে বৃত্তটা ছিল, সেটার মধ্যে বাংলাদেশের মানচিত্রও ছিল। যে মানচিত্রটা পরে আমরা ব্যবহার করিনি। সেই পতাকা নিয়ে ছোট্ট রাসেল যেন আজও আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।


আরেকটা ছবি দেখেছি, অস্ত্রের সামনে উপুড় হয়ে রাসেল ও তার এক বন্ধু এমন ভঙ্গি দিয়েছে যে, যেন তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। এ দুটি ছবি দেখে আমার মনে হয়েছে রাসেল বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধারণ করে, মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার চিন্তায় মগ্ন ছিল। স্বাধীনতার পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, অস্ত্রের মুখেও অসীম সাহসিকতার সাথে বসে থাকা, এগুলো তার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বহন করে। এ বিষয়টি আমার কাছে মনে হয়েছে।


বিবার্তা : শেখ রাসেল অতি মানবীয় গুণসম্পন্ন শিশু ছিল। দীর্ঘ জীবন তাকে কালজয়ী মহানুভব মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারত কি?


সেলিনা হোসেন : দেখুন, শেখ রাসেল ছোটবেলা থেকে উদার, দয়ালু ও মহানুভব সম্পন্ন শিশু ছিল। কারো দুঃখ দেখলে সে কষ্ট পেত। এজন্য বাদাম বিক্রেতাকেও সে নিজের টিফিন দিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করত না। মোটকথা, সে ছিল মানবীয় নানা গুণে অনন্য। আর এগুলো কালজয়ী মহানুভব মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার কিছু আলামতই বলা যায়।


বিবার্তা : ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে সপরিবার হত্যা করার সময় ঘাতকদের সবচেয়ে অমানবিক আচরণের শিকার শেখ রাসেল- বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?


সেলিনা হোসেন : ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বাঙালির ইতিহাসে কলঙ্কজনক এক অধ্যায়। এই ঘটনায় মানবিক জায়গা থেকে আমরা এতো বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিলাম, এটা আমাদের জন্য চিন্তা করাটাও উচিত না। কী করে এটা সম্ভব হলো? একটি শিশুকে এইভাবে হত্যা করা হলো! শিশুটি বলেছিল, আমি মায়ের কাছে যাবো।


তাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। তার মায়ের লাশ ছিল ওখানে। তারপর ওই ঘরের মধ্যে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। এই রকম জঘন্য হত্যাকাণ্ডের কথা মনে পড়লে আমার গা শিহরে ওঠে।


বিবার্তা : একজন শিশু শেখ রাসেল এক ধরনের অবিশ্বাস আর আকুতি নিয়ে ঘাতকদের হত্যাকাণ্ডের শিকার। এ দৃশ্যপটটি যেসব শিশু জানে বা জানবে সেটি বর্তমান ও অনাগত শিশুদের মনের উপর কেমন প্রভাব ফেলতে পারে?


সেলিনা হোসেন : এটা জানলে শিশুদের মাঝে খুব খারাপ প্রভাব পড়বে। আমাদের ভবিষ্যতের শিশুরা যদি জানে তাহলে তাদের চিন্তায় তো অবশ্যই খারাপ প্রভাব পড়বে। কেনই শিশুটিকে হত্যা করা হলো? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সাধ্য কি আমাদের আছে? যারা হত্যা করেছে তারাও উত্তর দিতে পারবে না!


বিবার্তা : শেখ রাসেলকে নিয়ে আপনি লিখেছেন। বইয়ের নাম ‘রাসেলের জন্য অপেক্ষা’। রাসেলের জন্য অপেক্ষা কেন?


সেলিনা হোসেন : এটা আমি অনেক আগেই লিখেছিলাম। কত সালে প্রকাশ হয়েছিল সেটা আমি মনে করতে পারছি না। এই বই নিয়ে চলচ্চিত্রও নির্মাণ হচ্ছে। বইটিতে রাসেল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে পড়কালীন সময়ের নানাদিক ফুটে উঠেছে। আমার দুই মেয়ে, মোনা এবং লারাও ওইখানে পড়ত। যার কারণে আমি ওখানে যেতাম এবং রাসেল নামের বাচ্চাটাকে দেখতাম। এই ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে আমি আমার গল্পটা বানিয়েছি।


আমি দেখতাম, রাসেল কখনও স্কুলের টিফিনটা খেতো না। কারণ তার থেকে একটু বড় বয়সী একটি ছেলে স্কুলে যেতে পারেনি, বাদাম বিক্রি করছে স্কুলের পাশে। এটা দেখে বিষয়টা তার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয় নাই। সে তখন স্কুলের টিফিনের জন্য যা নিয়ে আসতো, সেটা ওই ছেলেটাকে দিয়ে দিতো। কাঁটাবন বস্তিতে থাকতো বাদাম বিক্রেতা ছেলেটা। এভাবে রাসেলের উদারতায় তাদের মাঝে সখ্যতা গড়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু এবং বেগম মুজিবকে হত্যা করার সময় রাসেলকেও হত্যা করা হয়েছে। ছোট্ট শিশু হওয়ার কারণে বাদাম বিক্রেতা বিষয়টা জানতে পারেনি। ফলে সে স্কুলে এসেছে, রাসেলের সঙ্গে দেখা করার জন্য। তখন স্কুলের একজন টিচার বলেছেন, রাসেল তো স্কুলে আসেনি। তখন ‘ও’ বললো ঠিক আছে, আমি রাসেলের জন্য অপেক্ষা করবো। সে স্কুলে আসলে দেখা হবে। এটাই ‘রাসেলের জন্য অপেক্ষা’- বইয়ের নামকরণের পেছনের কারণ।


বিবার্তা : শেখ রাসেলকে নিয়ে আরো গবেষণাধর্মী গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়া উচিত বলে মনে করেন কি? বাংলা একাডেমির এই বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে কি-না?


সেলিনা হোসেন : হ্যাঁ, হতে পারে। একটি শিশুকে নিয়ে বড় আকারের বই লিখলে আমাদের শিশুরা সেই বইটা পড়ে অনুপ্রাণিত হবে। আর এক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা বলতে পারবেন।


বিবার্তা : শেখ রাসেল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র— তার জন্মদিনে আপনি কেমন বাংলাদেশ প্রত্যাশা করেন?


সেলিনা হোসেন : শেখ রাসেলের জন্মদিনে আমি মনে করি, সে যখন দেশের স্বাধীনতার পতাকা হাতে দাঁড়িয়েছিল, তখন তো রাষ্ট্র স্বাধীন হয়নি। এই জায়গাটি আমার কাছে অনুপ্রেরণার মনে হয়। একটি শিশু কিভাবে দেশের স্বাধীনতার স্বপ্নে অনুপ্রাণিত ছিল, সেটি শেখ রাসেলকে দেখলে বোঝা যায়। নিষ্ঠুর ঘাতকরা সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ডে শিশু রাসেলকে রেহাই তো দেয়ইনি, উল্টো পৈশাচিকভাবে তাকে হত্যা করেছে। আজ শেখ রাসেল আমাদের মাঝে নেই। তবে তার স্বাধীনতার জন্য লালিত স্বপ্ন পতাকা হাতে দাঁড়ানো কিংবা বাদাম বিক্রেতার জন্য তার উদারতার মতো কাহিনীগুলো আমাদের জন্য যুগ থেকে যুগান্তরে অনুপ্রেরণা জোগাবে। আজকের শিশুদেরও ছোট্ট রাসেলের জীবনী থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।


বিবার্তা : বিবার্তা২৪ডটনেটকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।


কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।


বিবার্তা/ রাসেল/ রোমেল/মাসুম

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com