‘জিপিএ সিস্টেমের চেয়ে নম্বরভিত্তিক মূল্যায়ন ভালো বলে মনে করি’
'দেশে শিক্ষার সুযোগ বেড়েছে ঠিকই কিন্তু মান বাড়েনি'
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৩, ১০:৪১
'দেশে শিক্ষার সুযোগ বেড়েছে ঠিকই কিন্তু মান বাড়েনি'
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। একাধারে প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ, গবেষক, সমাজতান্ত্রিক চিন্তক। দীর্ঘসময় ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। বর্তমানে তিনি বিভাগটির ইমেরিটাস অধ্যাপক। ১৯৩৬ সালের ২৩ জুন ঢাকার বিক্রমপুরের বাড়ৈখালিতে জন্মগ্রহণ করেন। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুল, নটর ডেম কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চতর গবেষণা করেছেন যুক্তরাজ্যের লিডস এবং লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন ১৯৫৭ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট কর্তৃক দুবার উপাচার্য হওয়ার জন্য মনোনীত হলেও তা প্রত্যাখ্যান করেন তিনি।



অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম সাহিত্য অঙ্গনেও অবিস্মরণীয় এক নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালে তিনি মাসিক পরিক্রমা (১৯৬০-৬২), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা (১৯৭২), ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্র (১৯৮৪) ইত্যাদি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেন। অবসর গ্রহণের পর থেকে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘নতুন দিগন্ত’ সম্পাদনা করছেন। প্রবন্ধ, অনুবাদ ও কথাসাহিত্য মিলিয়ে তাঁর রচিত বইয়ের সংখ্যা ১১০ এর অধিক। তিনি নানা কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। লেখক সংঘ পুরস্কার, আবদুর রহমান চৌধুরী পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।



বরেণ্য এই শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষ্যে বিবার্তা’র সাথে একান্ত আলাপচারিতায় মুখোমুখি হয়েছেন। আলাপে তিনি বিশ্ব শিক্ষক দিবসসহ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বিবার্তা প্রতিবেদক মহিউদ্দিন রাসেল।


বিবার্তা : ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এই দিবসটি আমাদের কী বার্তা দেয় বলে আপনি মনে করেন?


অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : অনেক দিবস তো উদযাপন করা হয়ে থাকে। তবে আমি মনে করি বিশ্ব শিক্ষক দিবসের গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ, শিক্ষাকে মানসম্মত, উপযোগী ও মঙ্গলজনক করে গড়ে তোলার জন্য এই দিবসের তাৎপর্য অনেক। আমাদের একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে, শিক্ষক ছাড়া শিক্ষা নাই। এক্ষেত্রে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কও খুব জরুরি। প্রকৃত শিক্ষা দেওয়ার জন্য দায়িত্ব, অনুকরণীয় ও যোগ্য শিক্ষক খুঁজতে হবে। আর এটির জন্য শুধু মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়োগ দিলে হবে না বরং তাদের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করতে হবে।



আর শিক্ষার উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। ১৯৯৫ সাল সাল থেকে বিশ্বব্যাপী এই দিবস পালিত হয়ে আসছে। জনসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকতা পেশার অবদান স্মরণ করিয়ে দিতে দিনটি কার্যকর ভূমিকা রাখে।



বিবার্তা : বর্তমানে আমাদের দেশের শিক্ষার মান নিয়ে প্রায়ই সমালোচনা হয়। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?


অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : আমাদের দেশে শিক্ষার সুযোগ বেড়েছে ঠিকই কিন্তু মান বাড়েনি। নানা কারণে এটা হচ্ছে। একদিকে যোগ্য শিক্ষকের অভাব, অন্যদিকে এই সেক্টরে বরাদ্দ কমসহ নানা অসুবিধা তো রয়েছে-ই।


শিক্ষার মান নিয়ে রাষ্ট্র কিংবা ব্যক্তি কেউ ভাবছি না। এদিকে শিক্ষাব্যবস্থাও পরীক্ষানির্ভর হয়ে উঠেছে। শিক্ষার মানের অবনতির জন্য এই পরীক্ষা ব্যবস্থাও অনেকাংশে দায়ি। এখন শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী না পাওয়া গেলেও পরীক্ষার্থী ঠিকই পাওয়া যায়। প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের চেয়ে কিভাবে ভালো ফল অর্জন করা যায় সবার দৃষ্টি থাকে সেই দিকে।


বিবার্তা : এখানকার সমাজে শিক্ষা উপেক্ষিত হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন কি না?


অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : এখনকার সমাজে কর্তৃত্ব হচ্ছে টাকার। শিক্ষার মূল্য কমে গেছে। শিক্ষা দিয়ে জাগতিক সবকিছু মূল্যায়নের কথা থাকলেও কোথাও যেন শিক্ষা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। আগে সমাজে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা অনেক বেশি ছিল। মানুষ শিক্ষকদের দেখলে মন থেকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করতো। কিন্তু এখন সেটা উঠে গেছে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা, গবেষণা, প্রকাশনা ইত্যাদি দিয়ে অন্য শিক্ষকের সাথে প্রতিযোগিতা করতাম। আর এখন এটার ধরণ বদলে গেছে। এখন কে কত আয় করতে পারে, কার গাড়ি কয়টা, বাড়ি কয়টা এসবে অর্থাৎ ভোগেবিলাসে ঝুঁকে যাওয়া হচ্ছে।


বিবার্তা: শিক্ষার মান উন্নয়নে আপনার পরামর্শ কী থাকবে?


অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : শিক্ষাকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ গড়ে তোলার জন্য আমাদের অবশ্যই ২টি কাজ করতে হবে। এরমধ্যে প্রথমটি হলো শিক্ষার মূল্য সামাজিকভাবে দিতে হবে আর দ্বিতীয়টি হলো মেধাবীদের এই পেশায় ধরে রাখতে উপযুক্ত বেতন কাঠামোসহ অন্যান্য সুুযোগ সুবিধা দিতে হবে। মোটকথা, আমাদের শিক্ষকদের মুুখের সম্মান নয়, প্রকৃত সম্মান দিতে হবে।


বিবার্তা : গত ২ অক্টোবর চাকরিতে ক্যাডার বৈষম্য নিরসন ও পদোন্নতিসহ বিভিন্ন দাবিতে সারা দেশে কর্মবিরতি পালন করেছেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। দাবি আদায় না হলে সামনেও তাদের কর্মসূচি পালন করা হবে। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?


অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের চাকরিতে ক্যাডার বৈষম্য ও পদোন্নতি জটিলতা থাকা খুবই দুঃখজনক। এটা একদমই ঠিক না। একই ব্যাচে চাকরিতে প্রবেশ করে কেউ সুযোগ সুবিধা বেশি পাবে আর কেউ বঞ্চিত হবে এটা কোনভাবেই কাম্য নয়। এক্ষেত্রে আমি মনে করি শিক্ষকদের জন্য অবশ্যই সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক উভয় ধরণের স্বীকৃতি ও সুযোগ-সুবিধা অবশ্যই দেওয়া উচিত।


বিবার্তা : ২০২৬ সাল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ সিস্টেম তুলে দিয়ে মার্কসীট ভিত্তিক মূল্যায়নের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?


অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : আজকে আমরা সব ছাত্রছাত্রীকে জিপিএ ৫ পাওয়ার দিকে ধাবিত করছি। এ কাজটা শিক্ষকরা করছে, অভিভাবকরা করছে, সমাজ থেকেও করছে। এমনকি সমাজে একজন শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করা হয়, তুমি জিপিএ কত পেলে? এই জিপিএ দিয়ে তাকে মূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীকে সঠিকভাবে শিখানো হয়েছে কিনা, সে শিখতে পেরেছে কিনা এই বিষয়গুলোর আলোচনা হচ্ছে না। জিপিএ ৫ এর যে প্রতিযোগিতা সেই প্রতিযোগিতা থেকে ছেলেমেয়েদের ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদেরকে বিদ্যা অর্জনের দিকে ধাবিত করতে হবে। তারা কতটুকু শিখলো, সেই বিষয়টির গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার্থী নয় বরং জ্ঞান অন্বেষণকারী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।



পরীক্ষাটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, একটা পরীক্ষা দিয়ে হয়তো আমরা মূল্যায়ন করি। তবে পরীক্ষার মধ্যে শুধু শ্রেণিকক্ষের কারিকুলাম থাকবে এটা নয়, এখানেই শিক্ষার্থীর সাংস্কৃতিক চর্চা, খেলাধুলা, আচার-আচরণ, সৌজন্যবোধসহ সার্বিক বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এই সবগুলো বিষয়ের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করলে ভালো ফলাফল আসবে বলে আশা করা যায়। আমি মনে করি, জিপিএ সিস্টেমের চেয়ে নম্বরভিত্তিক মূল্যায়ন জরুরি। কেননা, এর মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃত অবস্থা জানা যায়।



বিবার্তা : বিবার্তাকে আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।


অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : আপনাকেও ধন্যবাদ।


বিবার্তা/রাসেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com