বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ১৯৯০-এর দশকে যেখানে বছরে বজ্রপাতে হাতেগোনা কয়েকজনের মৃত্যু হলেও এখন এই সংখ্যা প্রায় ৩০০ জনে পৌঁছেছে। অথচ অপেক্ষাকৃত দ্বিগুণ জনসংখ্যার দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই মৃত্যুর হার।
৩১ ডিসেম্বর, রবিবার বাংলাদেশের বজ্রপাত এবং এর প্রভাবে মৃত্যু নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
সংবাদমাধ্যমটি নাসা, বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘের বরাতে জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই নাটকীয়ভাবে বজ্রপাতের মৃত্যু বেড়ে গেছে।
বিবিসি তাদের প্রতিবেদনে বজ্রপাতে স্বজন হারানো কয়েকজনের কথা তুলে ধরেছে। তাদের একজন হলেন মামুন। যিনি ২০২১ সালের আগস্টে নিজের বিয়ের দিন বাবা, দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, চাচাত ভাই-বোনসহ ১৬ সদস্যকে হারিয়েছিলেন।
মামুন বিবিসিকে জানিয়েছেন, তার আত্মীয়রা নৌকায় করে বিয়েতে যাচ্ছিলেন। তখন ঝড় শুরু হলে তারা নদীপাড়ের একটি টিনশেডের নিচে আশ্রয় নেন। সেখানেই আঘাত হানে বজ্র। এতে ঘটনাস্থলেই অনেকের মৃত্যু হয়।
মামুন বলেছেন, আমি প্রচণ্ড জোরে শব্দ শুনতে পাই। দ্রুত পরিবারের সদস্যদের কাছে যাই। সেখানে গিয়ে আমি হতবিহ্বল ও বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখতে পাই। কেউ কেউ মরদেহকে জড়িয়ে ধরছিল, আহতরা ব্যথায় কাঁদছিল, শিশুরা চিৎকার করছিল, আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। আমি বুঝতে পারছিলাম না কার কাছে আগে যাব। যখন আমি বাবার মরদেহ দেখতে পাই। তখন কেঁদে দেই। আমি খুবই বিস্মিত এবং অসুস্থ হয়ে পড়ি।
নতুন কাপড় পড়ে বিয়েতে গেলেও; ওইদিন সন্ধ্যায় তাদের সবাইকে সাদা কাফন পরিয়ে সমাহিত করা হয়। আর বিয়ের খাবারগুলো গরীব-দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া হয়।
মামুন পরবর্তীতে বিয়ে করেন। কিন্তু তিনি তার বিবাহ বার্ষিকী পালন করেন না। কারণ এসময়টা আসলে সেই ভয়াবহ স্মৃতি তার মনে পড়ে যায়।
মামুন বলেছেন, ওই ঘটনার পর আমি এখন সত্যিই বৃষ্টি এবং বজ্রপাতকে ভয় পাই।
বাংলাদেশে এখন বন্যায় যে সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়, এরচেয়ে বেশি মানুষ মারা যান বজ্রপাতে।
এত মানুষের মৃত্যুর ব্যাপারে বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, পরিবেশগত পরিবর্তন, জীবন ব্যবস্থা সবকিছু বজ্রপাতে মৃত্যু বৃদ্ধি করছে।
বজ্রপাতে মৃত্যু এতটাই বেড়েছে যে বাংলাদেশে এখন বন্যা, সাইক্লোন, ভূমিকম্প এবং খরার সঙ্গে বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বজ্রপাতে যারা মৃত্যুবরণ করেন তাদের বেশিরভাগই কৃষক। যারা খোলা মাঠে কৃষি কাজ করার সময় বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে বজ্রপাতজনিত মৃত্যুর এক-চতুর্থাংশই ঘটে বাংলাদেশে। এখানে মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত বজ্রপাতের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি থাকে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বজ্রপাত সবচেয়ে বেশি হয়। বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় গড়ে প্রায় ৪০টি বজ্রপাত হয়ে থাকে।
বিশ্বে মোট বজ্রপাতের ৭৮ শতাংশ ঘটে ক্রান্তীয় অঞ্চলে। দক্ষিণ এশিয়া তথা বাংলাদেশ যেহেতু ক্রান্তীয় অঞ্চলের খুব কাছাকাছি অবস্থিত, তাই মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত বজ্রপাত ও বজ্রঝড় এখানে নৈমিত্তিক ব্যাপার।
বজ্রপাতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আরও কিছু কারণকেও দায়ী করছেন আবহাওয়াবিদরা। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, ধাতব পদার্থের ব্যবহার বৃদ্ধি, জলাভূমি ভরাট ও নদ-নদীর বিলুপ্তি। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত ৭ বছরে দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়েছে।
শহরের তুলনায় গ্রামে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বেশি। গ্রামে বজ্রপাতজনিত প্রাণহানির কারণ হিসেবে ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন, গ্রামীণ জনসংখ্যার আধিক্য ও অসচেতনতা উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া তাল, নারিকেল ও সুপারি ইত্যাদি উঁচু গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, দুর্বল অবকাঠামো নির্মাণ এবং বজ্র নিরোধ ব্যবস্থা না থাকার কারণে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। বজ্রপাত এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা মুহূর্তের মধ্যে ঘটে থাকে, তাই এর পূর্বাভাস দেয়া অসম্ভব।
তবে বজ্রপাত সম্পর্কে সচেতন হলে এ দুর্যোগ থেকে অনেকাংশেই রক্ষা পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে গবেষণা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। বিশেষ করে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জনসাধারণকে সচেতন ও সজাগ করে তোলা প্রয়োজন যাতে বজ্রপাতে হতাহতের ঘটনা এড়ানো যায়।
বিবিসি জানিয়েছে, বাংলাদেশ ছাড়া ভারতেও বজ্রপাত একটি বড় চিন্তার কারণ। ভারতেও গত কয়েক বছরে বজ্রপাতে অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। তবে বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে এ সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমেছে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
জনসচেতনতামূলক বিজ্ঞপ্তি প্রচারের ফলে মানুষ সহজেই বুঝতে পারবে আবহাওয়ার কোন পরিস্থিতিতে বজ্রপাত হতে পারে এবং সে সময় বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেয়ার কোনো প্রযুক্তি যেহেতু আবিষ্কার হয়নি, সেহেতু বজ্রপাত নিয়ে সবার মধ্যে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। তাই বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে, মানুষের প্রাণ বাঁচাতে এবং এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে পাঠ্যবইয়ে বজ্রপাতের কারণ এবং এ থেকে রক্ষা পেতে করণীয় বিষয়ে পাঠদান জরুরি।
বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠে অবস্থান না করা, ধাতব বস্তু থেকে দূরে থাকা, কোনো গাছের নিচে অবস্থান না করা, মোবাইল, কম্পিউটার ও টেলিভিশনসহ বৈদ্যুতিক সামগ্রির পাশে না থাকা এবং নিরাপদ ছাউনির নিচে অবস্থান করা উচিত।
অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, বজ্রপাত থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে লম্বা গাছ লাগাতে হবে। যেন সেগুলোর ওপর বজ্রগুলো আঘাত হানে। বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে বন উজাড় করে ফেলা হয়েছে সেখানে বেশি গাছ লাগাতে হবে। এছাড়া খোলামাঠে আশ্রয় কেন্দ্র তৈরির কথাও বলছেন তারা। যেন বজ্রপাতের সময় কৃষকরা সেখানে আশ্রয় নিতে পারেন।
বিবার্তা/লিমন
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]