সাক্ষাতকার
ছয় দফা দাবিতে এখনো যুদ্ধ করছি: মোস্তফা মোহসীন মন্টু
প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৩, ০৯:৩৭
ছয় দফা দাবিতে এখনো যুদ্ধ করছি: মোস্তফা মোহসীন মন্টু
কিরণ শেখ
প্রিন্ট অ-অ+

মোস্তফা মোহসীন মন্টু। ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শিক্ষাজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে যুবলীগের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।


পরে ১৯৯২ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বাদ পড়েন মন্টু এবং ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামে যোগ দেন। ২০০৯ সালে তিনি গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।


সর্বশেষ ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ঢাকা-২ ও ৩ আসন থেকে গণফোরামের প্রার্থী হিসেবে উদীয়মান সূর্য প্রতীকে এবং ঢাকা-৭ আসন থেকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করেন। বর্তমানে তিনি গণফোরাম একাংশের সভাপতি হিসেবে সক্রিয়।


মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, ৭ মার্চের ভাষণ এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণসহ নানা বিষয়ে বিবার্তা২৪ডটনেটের সঙ্গে কথা হয় মোস্তফা মোহসীন মন্টুর। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বিবার্তা প্রতিবেদক কিরণ শেখ।


বিবার্তা: মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার প্রেক্ষাপট কেমন ছিল?


মোস্তফা মোহসীন মন্টু: আমি আমার বাংলা ভাষায় কথা বলা অধিকার হারিয়ে ফেলব, উর্দু আমার রাষ্ট্র ভাষা হবে! তখন একটা উপলব্ধি তরুণ ও যুব সমাজের মধ্যে চলে এসেছে যে, এদেশে কি বসবাস করা সম্ভব? আর যখন তারা (পাকিস্তান) সত্তরের নির্বাচন (গণরায়) মানল না, তখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসল। বলা হলো, এদেশে আর বসবাস করা সম্ভব না। সুতরাং আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। তারপরে ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলো। কিছু মানুষ সত্তরের নির্বাচনের পর থেকে যুদ্ধ উপলব্ধি শুরু করেন আর যারা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের অনুভূতিটা আরো আগে থেকেই। সুতরাং আমরা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম যে, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে হবে।


তিনি বলেন, আমি তখন ঢাকায়। পাকিস্তানের সাময়িক আদালত আমাকে ৩০-৪০ বছর সাজা দিয়েছিল। ফাঁসি-টাসিও দিয়েছিল। পরে ১ মার্চ আমরা জেল ভেঙে বের হই। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ শুরু হলো। আমি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। এরআগে যুদ্ধের ট্রেনিং নেই। আর সেই যুদ্ধে আমরা জয়লাভ করলাম। 


বিবার্তা: ৭ মার্চের ভাষণ কি আপনি সরাসরি শুনেছিলেন?


মোস্তফা মোহসীন মন্টু: বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আমি সরাসরি শুনেছি। আমি পল্টনের অনুষ্ঠানেও যোগ দিয়েছি। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলাভবনে প্রথম যে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়- সেখানেও আমরা ছিলাম। আর ওই সময় প্রত্যেকটা মিছিল-মিটিংয়ে আমরা ছিলাম।


বিবার্তা: ২৫ মার্চ কোথায় ছিলেন?


মোস্তফা মোহসীন মন্টু: ২৫ মার্চ ঢাকাতেই ছিলাম। দেড়টা সময় কামরাঙ্গীরচর পার হই। আর ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার দিকে আমরা কেরাণীগঞ্জে গিয়ে পৌঁছাই, সাড়ে ৫টার দিকে জিঞ্জিরা এবং সাড়ে ১১টা পর্যন্ত আমরা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতেই ছিলাম।


বিবার্তা: মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য কিভাবে প্রস্তুতি নেন? পরিবার কি রাজি ছিল?


মোস্তফা মোহসীন মন্টু: আমরা ছয় ভাই। আমরা ছয় ভাইয়ের সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। আর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় এক ভাই (সেলিম) গ্রেফতার ছিল। আমাদের সবার বড় ভাই ডাক্তার। উনি মুক্তিযুদ্ধের সময় সবার চিকিৎসা করেছেন। আমারও চিকিৎসা করেছেন। আর আমার মা’ও মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন। কারণ উনি কেরাণীগঞ্জের যেসব জায়গায় থাকতেন- সেই জায়গায় উনি...। আর আমাদের বাড়িটা (এলিফ্যান্ট রোডের ৩০২ বাড়ি) দীর্ঘ দিন যাবৎ রাজনৈতিক সংস্কৃতি জায়গা হিসেবে পরিচিত ছিল। ওই সময় সব ছাত্র নেতারাই আমাদের বাড়িতে আসতেন। সুতরাং মা এসবে অভ্যস্ত ছিলেন। তাই চিন্তা করা তো দূরের কথা- যারাই বাড়িতে আসত তাদেরকে মা বলতেন, এই তোমরা এখনো বসে আছো কেন? ওদের সাথে যাও। গিয়ে দেশটা স্বাধীন কর।


বিবার্তা: ভয়াল ২৫ মার্চ নিয়ে আপনার মতামত কি?


মোস্তফা মোহসীন মন্টু: মানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ভীতি সৃষ্টি করতে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পূর্ব পরিকল্পিত অপারেশন সার্চ লাইটের নীলনকশা অনুযায়ী বাঙালি জাতির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকায় নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের এটা বুমেরাং হয়ে যায়। কারণ তারা এই হত্যাকাণ্ড না চালালে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হত না।



বিবার্তা: মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ কোনো স্মৃতি কি এখনো আপনাকে তাড়া করে বেড়ায়?


মোস্তফা মোহসীন মন্টু: স্মৃতি তো অনেক আছে। কোনটা থেকে কোনটা বলব। এরমধ্যে একটা স্মৃতি আমার খুব মনে পড়ে। ২ মার্চ কেরাণীগঞ্জে একটা হামলা হয়। ওই হামলায় ৩ থেকে ৪ হাজার লোক মারা যায়। এরমধ্যে বেশি ভাগই ছিল বাইরের। তারা সবাই ছিল আশ্রিত। এলাকার লোকজন আমাদেরকে বলল যে, আপনারা চলে যান। আমি,  নূর-ই-আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ আর আ স ম আবদুর রব- আমরা এক সাথে ছিলাম। পরে সেখান থেকে আমরা চলে যাই। এরপর নভেম্বরে আরেকটা যুদ্ধ হয়, সোনাকান্দায়। সেই যুদ্ধে পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন নিহত হয়। আমাদের ওমর নামে একজন নিহত হয়। আর আহত হয় বেশ কয়েকজন। ওই যুদ্ধ হয় দু্ই রাত একদিন। এরপরে পাকিস্তানের যুদ্ধ বিমান এসে গুলি শুরু করল। ওরা যদি আর ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা দেরি করত তাহলে পাকিস্তানের একটাও জীবিত থাকত না।


তিনি বলেন, আমরা বাঙ্কারে ছিলাম। এলাকার কারফিউ জারি করা হয়েছে। মানুষজনকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু একজন বৃদ্ধ মহিলা রয়ে গেছেন। তিনি কয়েকটা মিষ্টি আর পাউরুটি নিয়ে আসছেন। এসব নিয়ে সে আমাকে খুঁজছেন। বলছেন, আমার বাবা কোথায়, আমার বাবা কোথায়? সেখানে কিন্তু বাইরের কেউ নেই। সব জায়গাতেই আমাদের ছেলেরা। আমার কোড নাম ছিল মাওলানা। সবাই আমাকে মাওলানা বাবা বলে ডাকত। সবাই বৃদ্ধ মহিলাকে বলেন, কেনো তাকে খুঁজছেন। তিনি বলেন, আমি ওর জন্য খাবার আনছি। ওইসময় বৃদ্ধাকে একজন আমার কাছে নিয়ে আসেন। এরপর উনি আমাকে যেভাবে আদর করলেন- তা অকল্পনীয়। আর বললেন, বাবা এটা তোমার জন্য আনছি। এটা খাও। আমি বললাম, সব লোককে তো সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আপনি এখানে রইলেন কেন। উনি বলেন, তোমরা এখানে পাক-বাহিনীকে মারছ আর আমি নিরাপদে গিয়ে থাকব- এটা হয়। ছেলেদের বিপদে ফেলে এভাবে কি কেউ যায়।


এই যে আমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি, আমরা মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে এদেশের সাধারণ মানুষের যে কি অবদান ছিল- তা ভাষায় বর্ণনা করার যাবে না। বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে। তাদের কাজ আমাদের কাজের চেয়ে কোন অংশে কম না।


বিবার্তা:  ৫৩তম মহান স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবস ২৬ মার্চ, এই ৫৩ বছরে আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি  কি?


মোস্তফা মোহসীন মন্টু: এই যে আমরা ছয় দফা দাবিতে যুদ্ধে করেছিলাম। এই দফাগুলো নিয়ে এখনো আমরা যুদ্ধ করছি। আমরা এখনও বাক-স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছি, আমরা এখনেও অর্থনীতিকে বাঁচাতে যুদ্ধ করছি, এই অর্থনীতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি- এটার জন্যই তো আমরা সংগ্রাম করছি। এখন বাঙালিরাই তো সব লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা ছয় দফা আন্দোলনের সময় যে অবস্থানে ছিলাম, যে দাবি-দাওয়া নিয়ে ছিলাম- সেই গণতান্ত্রিক অধিকার, বাক-স্বাধীনতা, ভোটাধিকার, আইনের শাসন নিয়ে এখনো সংগ্রাম করছি। 


বিবার্তা/ কিরণ/ রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com