শিরোনাম
মা তোর বদনখানি মলিন হলে...
প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০১৬, ২১:৩৭
মা তোর বদনখানি মলিন হলে...
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

গত বছর অক্টোবরের মাঝামাঝি। সরকারি কাজে ব্রুনেই গিয়েছি। সফরের দ্বিতীয় দিনে সেখানকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলকে লাঞ্চে নিমন্ত্রণ করেছেন। ওই সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন ব্রুনেইয়ের সুলতানের আপন ভাই। সুলতানের মত তাঁর ভাইয়েরও একটা ঝলমলে প্রাসাদ আছে। সেই প্রাসাদেই লাঞ্চ। ঝলমলে প্রাসাদে টলমলে খাবার। খাবার টেবিলে বসে কূটনীতিকরা আলাপ শুরু করে কুইজিন (cuisine) নিয়ে। খাবারের মেনু কার্ডে চোখ বুলায়– আর যেন রসুই ঘর থেকে চলে আসে কথার রসদ। শুরু হয় ছোট ছোট আলাপ। খাবার মানে তো শুধু খাবার নয়। খাবারে মিশে থাকে সংস্কৃতি। পরিবেশনের ধরণে থাকে শিল্পবোধ। টেবিলের পরিবেশে ফুটে ওঠে গৃহস্বামীর আতিথেয়তা। পুরো বিষয়টাকে কূটনীতিকরা বলেন- পেটের ভেতর দিয়ে হৃদয়ে প্রবেশ। আর সোজা বাংলায়– খাওয়াইয়া মন ভুলান।


এসব ক্ষেত্রে খেতে বসলে আমি আমন্ত্রণকারীকে মন ভুলানোর যথেষ্টই সুযোগ দেই। যতটুকু পারি খাই আর খাবার সাথে আহা, উহু করতে থাকি। যেন এর চেয়ে ভালো খাবার আমি জীবনেও খাইনি- আর ভবিষ্যতেও খাব কিনা সন্দেহ আছে। তো সেদিন আমার টেবিলে বসেছেন ব্রুনেইয়ের ডেপুটি চিফ অফ প্রটোকল (DCP)। ভীষণ রসিক মানুষ। আমি এক একটা খাবারের কথা জিজ্ঞেস করি, আর তিনি আগ্রহ নিয়ে সেটার ধারাভাষ্য দেন। বুঝা যাচ্ছিলো- তিনি বেশ এনজয় করছেন। চোখে মুখে বেশ একটা গর্ব গর্ব ভাব। আমিও মুগ্ধ হবার ভান করেই যাচ্ছি। মুগ্ধতার সবচেয়ে ভালো বিষয় হলো- মুগ্ধ হতে পয়সা লাগে না। বরং বেশি বেশি মুগ্ধ হলে, লাভ হবার সম্ভাবনাই থাকে। মুগ্ধ হতে যদি পয়সা লাগত– আমি নিশ্চিত, আমি সেদিন দেউলিয়া হয়ে যেতাম। খাবারের মেনুতে দেখি মালয়, থাই, চাইনিজ এমনকি আমাদের চিকেন তন্দুরিও আছে। আমি গদগদে হয়ে বললাম, ‘ওয়াও, ইটস ডাইভারস টেস্ট– একেবারে পাঁচমিশালী স্বাদ’।


ডিসিপি সাহেব মোটামুটি চেঁচিয়ে ওঠলো– ‘ইয়েস, ইয়েস, আনিকা! আনিকা রাসা’! আমি অবাক। বললাম, আনিকা? আনিকা তোমার কে হয়?
-কে হয় মানে?
- বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক ক্লাসমেট ছিলো, নাম আনিকা। আর তিনি এখন আমার তখনের রুমমেটের স্ত্রী।
-ও! না না, আনিকা কারো নাম নয়। আমাদের ভাষায় আনিকা মানে ডাইভারস (বৈচিত্রপূর্ণ), আনিকা রাসা– ডাইভারস টেস্ট।
- ‘হুম, তাই বলো! তোমাদের পাঁচমিশালী স্বাদের কথা বলতে তুমি আনিকারে ডাক দিয়েছো। কিন্তু ডাক দিয়ে তো লাভ নেই। আমাদের আনিকা এখন স্বামীর সাথে কানাডায়। তোমার ডাক শুনতে পাবে না’। সবাই হো হো করে হেসে ওঠলো। বেশ জমে উঠলো আলাপ। চায়ের কাপ তখনো আসেনি, তাই চামচ আর ছুরিতেই ঝড় উঠলো।
ওদিকে লাঞ্চের সাথে অতিথিদের জন্য গানের ব্যবস্থাও ছিলো। হল ঘরের এক পাশে শিল্পীরা গাইছিলো ধীর লয়ের সুন্দর মালয় সঙ্গীত। কিছু কিছু গানের সুর একেবারে আমাদের মত। আমরা গান নিয়ে আলাপ শুরু করলাম। এক সময় জিজ্ঞেস করলাম, ব্রুনেইয়ের জাতীয় সঙ্গীত কী?


ডিসিপি সাহেব নিরব। কিছু বলছেন না। একটু আগে তাঁর মুখে যে অহংকারের ভাবটা ছিলো, সেটা যেন হঠাৎ উধাও। ঘটনা কি? কোনো অন্যায় করে ফেললাম নাকি? আমি তো একটা নিষ্পাপ প্রশ্ন করেছি মাত্র! আবার জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের জাতীয় সঙ্গীত কি? উনি আমতা আমতা করে মৃদু স্বরে বললেন, ‘অ্যা...... ইট ইজ লাইক দ্য ব্রিটিশ ওয়ান’।


মনে পড়লো, ব্রিটেনের জাতীয় সঙ্গীত– ‘God Save the Queen’- স্রষ্টা যেন রাণীকে রক্ষা করেন। পরে জেনেছি- ইংরেজিতে ব্রুনেইয়ের জাতীয় সঙ্গীতের শুরুটা হলো– ‘O God, bless His Majesty with a long life’- স্রষ্টা যেন সুলতানকে দীর্ঘ জীবন দান করেন। দেখলাম, যেসব দেশে রাজা-রাণী আছে, জাতীয় সঙ্গীতে সেসব দেশের অবস্থা এরকমই। রাজা-রাণীদের মাহাত্ম্য। আর অন্য বেশির ভাগ দেশের জাতীয় সঙ্গীতে সেই দেশ যে শ্রেষ্ঠ- ওই রকম কথাবার্তায় ভরা। একটা স্পষ্ট অহংকারী টোন। অন্য দেশ ছোট– আমাদের দেশ বড় এইরকম।


সেদিন ব্রুনেইয়ে বসে আমি উপলব্ধি করলাম- অনেক দেশের জাতীয় সঙ্গীত এমন যে অন্য দেশের মানুষের সামনে সেটি বলতে সংকোচ হতে পারে। ব্রুনেইয়ের রসিক অফিসারটিকে জাতীয় সঙ্গীতের প্রসঙ্গে চুপ করে যেতে হলো। তিনি আমার সামনে তাঁদের জাতীয় সঙ্গীত বললেনই না। শুধু ‘ব্রিটেনের মত’ বলেই তাঁকে থেমে যেতে হলো। আমি বুঝলাম– এই জায়গায় একজন বাংলাদেশি কূটনীতিক হিসেবে আমি অনেক ভাগ্যবান। সেদিনই প্রথম উপলব্ধি করলাম- আমাদের জাতীয় সঙ্গীতটি কত চমৎকার। কত আধুনিক। অন্য কোনো দেশের কূটনীতিক জিজ্ঞেস করলে মাথা উঁচু করে বলতে পারি – My Bengal of gold, I love you.


আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে বাংলাদেশ আমাদের মা। আমরা সেই মাকে ভালোবাসি। বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস, শোভা-ছায়া, স্নেহ-মায়া আমরা ভালোবাসি। বাংলাদেশ একটা আঁচল বিছায়ে রেখেছে আমাদের জন্য। সেই মায়ের মুখ মলিন হলে, আমাদের চোখ জলে ভরে ওঠে। ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে, আমি নয়ন, জলে ভাসি।’


রবীন্দ্রনাথের প্রতিটা সৃষ্টিই একটা সুন্দর পরশের মতো। জাপটে ধরে না। আলতো করে মনের উপর বুলিয়ে যায়। আমাদের জাতীয় সংগীতও তেমনি। কেমন একটা ভিজে ভিজে পরশ এর সুরে। একটা তুলতুলে ভালোবাসা এর প্রতিটি লাইনে।


শুধু দেশপ্রেম আর দেশের প্রকৃতি দিয়ে এমন চমৎকার জাতীয় সঙ্গীত পৃথিবীতে বিরল। অন্যকে ছোট করে নয়; নিজেকে বড় করে নয়; স্রষ্টার কাছে রাজা-রানীর জন্য প্রার্থনা করে নয়; ভালোবেসে শুধুই দেশকে ভালোবেসে আমরা সবার সামনে বলে উঠি-
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’


সুজন দেবনাথের ফেসবুক থেকে


বিবার্তা/রয়েল

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com