শিরোনাম
অং সান অশূচি
প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর ২০১৬, ১৭:০২
অং সান অশূচি
প্রিন্ট অ-অ+

মানুষ যে কীভাবে বদলে যায়!


দূর অতীতে কোনো এক ভারতীয় হিন্দি বা পাকিস্তানী উর্দু সিনেমায় গীত হয়েছিল একটি মর্মস্পর্শী গান : চাঁদ নেই বদলা, সুরুজ নেই বদলা, কেবলি বদল গিয়া ইনসান। চাঁদ-সূর্য কিছুই বদলায়নি, মানুষই শুধু বদলে গেছে।


এটাই বুঝি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সে সপ্রাণ, তাই নিয়ত পরিবর্তনই তার জৈবিক ধর্ম। এতে অবাক হওয়ার বা আপত্তি করার কিছু নেই। আবার আছেও।


পরিবর্তন যদি নেতিবাচক হয়, পরিবর্তিত মানুষটি বা মানুষগুলো যদি ভুতের মতো পেছন দিকে হাঁটতে থাকে, তাতে তো আপত্তি থাকবেই। থাকবে ক্ষোভও। সচেতন মানুষেরা সেই ক্ষোভ প্রকাশও করবেন। যেমন তারা করছেন অং সান সূ চী'র বেলায়।


শ্রীমতি সূ চী আমাদের পড়শী দেশ মিয়ানমারের অঘোষিত শাসক। সরকারে তার কোনো স্বীকৃত আনুষ্ঠানিক পদ না-থাকলেও তিনিই দেশটির সর্বময়ী কর্ত্রী। এই কর্তৃত্বের আসনে বসতে তাকে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি।


সকলেই জানেন, মিয়ানমার (তখন বার্মা) নামের দেশটিতে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে দিকে বন্দুকতন্ত্র চেপে বসে। তারপর কত মাস, বছর পেরিয়ে গেলো - গণতন্ত্র আর ফিরে পায় না দেশটি। এর মধ্যে বিদায়ী শতাব্দীর শেষ দিকে এসে কী ভীমরতি হলো শাসকদের, দিলো নির্বাচন। অসুস্থ মা-কে দেখতে ওই সময় নিরাপদ প্রবাস থেকে স্বল্পকালীন সফরে দেশে এসেছিলেন সূ চী। নির্বাচনের ঘোষণা আর জনপ্রিয় প্রয়াত নেতা অং সানের কণ্যার উপস্থিতি - দুয়ে মিলে তখনই তৃতীয় বিশ্বের সহজ রাজনৈতিক সমীকরণটি কষে ফেললেন বিরোধী নেতারা। তারা সূ চীকে ধরেবেঁধে এনে দলের চূড়ায় আসীন করলেন। স্বৈরাচারপিষ্ট মিয়ানমারবাসীও এর মধ্যে ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের আলোকরেখা দেখতে পেলো বুঝি। তারা বিপুল ভোটে জয়ী করলো সূ চী'র দল এনএলডি-কে।


তারপরের ইতিহাস সবার জানা। সামরিক জান্তা নির্বাচনের ফল বাতিল করলো, সূ চী-কে করলো গৃহবন্দী। এদিকে নোবেল কমিটি সূ চী-কে নোবেল শান্তি পুরস্কার দিয়ে বসলো। এভাবে তিনি হয়ে উঠলেন বন্দী গণতন্ত্র ও মুক্ত বিবেকের প্রতীক। বিশ্বব্যাপী শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় উচ্চারিত হতে থাকলো অং সান সূ চী'র নাম।


প্রতিবেশী এবং স্বৈরাচারকবলিত দেশ হিসেবে আমাদের দেশে সূ চী তখন আরো বেশি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত, অভিষিক্ত। আমাদের সেই আবেগের প্রাবল্য দেখে অন্তর্যামী বুঝি অলক্ষ্যে হেসেছিলেন। নইলে গণতন্ত্রের প্রবক্তা নেত্রী ক্ষমতা পেয়ে এমন হবেন কেন?


অং সান সূ চী আজ তার দেশে অবিসংবাদিত নেত্রী। অথচ তার দেশেই কেবল বাংলাভাষী ও মুসলমান হওয়ার 'অপরাধে' লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানকে কচুকাটা করা হচ্ছে, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে ভিটেছাড়া করা হচ্ছে, ঠেলে দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশের দিকে। এতো রক্তপাত, এতো আগুন, এতো নির্যাতন-নিপীড়ন, সর্বহারা মানুষের এতো আর্তনাদ - কিন্তু শ্রীমতি একেবারে চুপ। তার কেবলই ভয়, রোহিঙ্গাদের পক্ষে কিছু বললেই ছিটকে পড়তে হবে ক্ষমতার নরম মখমল গদি থেকে। আহা, ক্ষমতার কী মধু!


ভাবতে অবাক লাগে, এ কি সেই সূ চী! এটুকু মাথানিচু তখন করলে তো তাকে এতোদিন গৃহবন্দী থাকতে হতো না, বরং ক্ষমতার মদ-মধু ভাগাভাগি করে দিব্যি সুখে-শান্তিতে কালাতিপাত করতে পারতেন। তাতে হয়তো নোবেল পুরস্কারটি জুটতো না। তাতে কী, বন্দুকতন্ত্রীদের হরিলুটের ছিটেফোঁটা ভাগ তো পেতেন!


আজ বিশ্বব্যাপী দাবি উঠছে সূ চী'র নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারের। তা হয়তো হবে না। কিন্তু নোবেল বিজয়ের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর মনে যে শ্রদ্ধা-ভালোবাসার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন সূ চী, নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারের দাবির মধ্য দিয়ে এটাই নিশ্চিত হলো, সেই আসনটি হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। আজ তার আসন অশ্রদ্ধা, ঘৃণা ও তিক্ততার কাদায়। এসব নোংরা গায়ে মেখে অশূচি হয়ে গেছেন সূ চী। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পানি দিয়ে ধুয়েও আর সূ চী'র ভাবমূর্তিকে শূচি বা অমলিন করা যাবে না।


মানবজাতিকে কত ট্র্যাজিক ঘটনাই না দেখতে হয়!

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com