
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের জীবন থেকে আবেগ কিছুটা কেড়ে নিয়েছে একথা সত্যি, কিন্তু আমাদের জীবনকে দিয়েছে অনেক বেশি বেগ বা গতি। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে সেই গতির প্রভাব প্রতিনিয়তই অনুভব করি আমরা। আরো অনুভব করি, গতিই জীবন। এই গতি না থাকলে আমাদের জীবন হয়ে যেত বদ্ধ নদীর মতো দূষিত, মলিন। ছোট একটা প্রযুক্তির স্পর্শে আমাদের জীবন ও পরিপার্শ্বের অনেক কিছু বদলে যায়। অথচ তা গ্রহণ করতেও আমাদের কতোই না অনীহা! মনে পড়ে, পুরো বুক কেটে অর্থাৎ ওপেন হার্ট সার্জারির বিকল্প ব্যবস্থাটি (শুধু একটি ছিদ্র করে অপারেশন) বাংলাদেশে আসার ৩০ বছর আগেই যুক্তরাষ্ট্রে উদ্ভাবিত ও প্রয়োগ হয়ে আসছে। এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশ থেকে কতো মহাজন ব্যক্তি ওই দেশে এলেন-গেলেন, কারো কানে এলো না, চোখে পড়লো না এমন একটি অবশ্যপ্রয়োজনীয় উদ্ভাবন! পড়েনি এ কারণে যে, আমরা বিজ্ঞান-প্রযুক্তিমনস্ক নই। আর, কেউ স্বীকার করুক অথবা না-ই করুক, এটাই যুগ যুগ ধরে আমাদের পিছিয়ে থাকার কারণ।
কাজেই বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হলে আমাদের বিজ্ঞান-প্রযুক্তিমনস্ক হতেই হবে, নজর রাখতে হবে পৃথিবীর কোথায় বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কোন উদ্ভাবনটি সম্পন্ন হলো। সেটি আমাদের কতোটা প্রয়োজন, প্রয়োজন হলে সেটি যথাসম্ভব দ্রুততার সাথে দেশে নিয়ে আসা - মোটা দাগে এটাই বিজ্ঞান-প্রযুক্তিমনস্কতার একটা দিক বলে আমরা মনে করি। খুব কঠিন কিছু কী? মোটেই না। অথচ তা করতেও আমাদের কতোই না আলস্য ও অনীহা!
সুখের কথা, আমাদের এই বিখ্যাত আলস্য ও অনীহা কাটিয়ে ওঠার একটা ক্ষীণ আলোকরেখার দেখা পেলাম ক'দিন আগে। এই আলোকরেখাটি এসেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের হাত ধরে।
সড়ক সংস্কারের ক্ষেত্রে ভোগান্তি আর দীর্ঘসূত্রতার ইতিহাস আমাদের বহু পুরনো। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই ভোগান্তি ও দীর্ঘসূত্রতা কমানো যায় কিনা, দেশের বাইরে কীভাবে রাস্তা সংস্কার করা হয়, এমন চিন্তাভাবনা কেউ কখনো করেছেন বলে জানা যায় না। ফলে সড়ক সংস্কারের ক্ষেত্রে ভোগান্তি আর দীর্ঘসূত্রতার 'সেই ট্র্যাডিশনই চলিয়া আসিতেছিল'।
সেই ট্র্যাডিশনে কুঠারাঘাত হানলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। সড়ক সংস্কারের ক্ষেত্রে ভোগান্তি ও দীর্ঘসূত্রতা অবসানের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া থেকে তিনি আমদানি করেছেন দুটি আধুনিক মেশিন। গত ১৯ নভেম্বর নতুন এই মেশিনের সাহায্যে রাজধানীর পলাশী-নীলক্ষেত মোড়ের জহির রায়হান রোড সংস্কার কাজ উদ্বোধন করেন মেয়র সাঈদ খোকন। প্রচলিত পদ্ধতির বদলে নতুন পদ্ধতিতে সড়ক সংস্কারের নাম দেয়া হয়েছে কোল্ড রিসাইক্লিং।
জানা গেছে, দক্ষিণ কোরিয়ার ডিএমআই কোম্পানির তৈরি কোল্ড রিসাইক্লিং মেশিন দিয়ে দ্রুত সময়ে স্বল্প জনবলের মাধ্যমে ঢাকা শহরের ক্ষতিগ্রস্ত বা উঁচু হয়ে যাওয়া সড়ক কেটে কর্তিত জিনিসগুলো আবার কোল্ড রিসাইক্লিং মেশিনে ব্যবহার করে নতুন মিশ্রণ প্রস্তুত করে সড়কের সংস্কারকাজে ব্যবহার করা হবে। এতে একদিকে ব্যয় কমবে, অন্যদিকে রাস্তার উচ্চতা বাড়বে না। এতে রাস্তার পাশের স্থাপনা রোড লেভেল থেকে আর নিচু হয়ে যাবে না।
আরো জানা গেছে, কোল্ড মেশিন দিয়ে ১২ দশমিক ৮ ইঞ্চি গভীরতা পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৫০ হাজার বর্গফুট রাস্তা কাটা যাবে। একই সঙ্গে প্রতি ঘণ্টায় ১২০ টন মিক্সড ম্যাটেরিয়ালস প্রস্তুত করা যাবে। এ ক্ষেত্রে রাস্তা থেকে কেটে তোলা পুরনো উপাদান ৪০ শতাংশ ও নতুন উপাদান ৬০ শতাংশ ব্যবহার করা হবে। এ পদ্ধতিতে ১২ ফুট প্রশস্ত ও এক কিলোমিটার দীর্ঘ একটি রাস্তা দুই ইঞ্চি পুরুত্বে কেটে আবার কার্পেটিং করতে মাত্র সাত-আট ঘণ্টা সময় লাগবে।
সময় ও অর্থের কী অপূর্ব সাশ্রয়! এই পদ্ধতিতে রাস্তা সংস্কারে পূর্বের চেয়ে ৪০ শতাংশ অর্থ সাশ্রয় হবে জানিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, রাজধানীর রাস্তাগুলো প্রতি বছর মেরামতের ফলে ৩-৪ ইঞ্চি উঁচু হয়ে যায়। ফলে বৃষ্টির দিনে রাস্তার দুই পাশে পানি প্রবাহিত হয়ে আশপাশের বাসায় প্রবেশ করে। কিন্তু এই পদ্ধতির মাধ্যমে ১২ ইঞ্চি গভীর পর্যন্ত রাস্তা কেটে ওই ওই উপাদান আবার সংস্কারকাজে ব্যবহার করতে পারা যাবে বলে উঁচু হওয়ার সমস্যাটি আর তেমনভাবে থাকবে না। তাছাড়া এই প্ল্যান্টটি পরিবেশবান্ধব। প্ল্যান্টটি চলাকালে কার্বন নিঃসরণ, ধূলাবালি ও ধোঁয়া নির্গত হবে না।
প্রতিটি বিষয়ই ইতিবাচক এবং আমাদের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। অর্থ সাশ্রয়, সময় সাশ্রয়, পরিবেশবান্ধব - সবই আমাদের চাই। তাছাড়া বসতবাড়ি, দোকানপাট, অফিস-আদালতের চাইতে রাস্তা উঁচু হয়ে যাওয়া একটি বড় সমস্যা। রাজধানীর বহু এলাকায় এই সমস্যাটি প্রকটভাবে দৃশ্যমান। অতীতে কোনো নগরকর্তা বিষয়টিকে তেমনভাবে দেখেননি। তরুণ মেয়র সাঈদ খোকন সাধারণ একটি প্রযুক্তি এনে যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটি গুরুতর সমস্যা সমাধানের পথ খুলে দিলেন। দেশ ও সমাজকে এগিয়ে নিতে এমন প্রযুক্তিমনস্কতাই তো চাই!
আমরা নিশ্চিত, দক্ষিণ কোরিয়া এই পদ্ধতি অনেক আগেই উদ্ভাবন ও ব্যবহার করে আসছে। অথচ বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকানা আমরা সেদিকে 'দেখি নাই ফিরে'। যাহোক, আমাদের তারুণ্যদীপ্ত মেয়র কোনো ঢাকঢোল না পিটিয়ে নীরবে নিঃশব্দে বিদেশ থেকে আধুনিক প্রযুক্তিটি এনে আমাদের দেখিয়ে দিলেন, প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিমনস্কতার মেলবন্ধন ঘটাতে পারলে সব সমস্যারই সমাধান সম্ভব।
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]