
প্রাচীন বাংলায় সংস্কৃত ‘অমৃত’ শব্দটিকে ‘আমৃত’ ‘অমিঅ’, ‘অমিআ’, আমিআঁ বলা হত (তোহোর বধন আমিআঁ পীও- শ্রীকৃষ্ণকীর্তন)। বহুব্রীহি সমাসের নিয়মে ‘যাতে মৃত্যু নাই, তা-ই অমৃত’। আভিধানিক অর্থে ‘যা পান করলে মৃত্যু হয় না, তা অমৃত’। পীযুষ বা সুধা অর্থে অমৃত শব্দটি প্রচলিত।
অমৃত পানে দেবতারা মৃত্যুঞ্জয় হয়েছিলেন বলে এটার নাম হয়েছে অমৃত। আবার সমুদ্রমন্থন কালে অমৃতভাণ্ড হতে উত্থান হেতু এটার নাম ধন্বন্তরী। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ১২টি দ্রব্যকে অমৃত নামে ডাকা হয়। যেমন ক্ষীর, দুগ্ধ (দেহের পক্ষে উপকারী ও প্রাণদায়ী বলে), ঘৃত (আয়ুপ্রদ হেতু), নবনীত বা মাখন, তক্র বা ঘোল, জল (প্রাণধারণের উৎস হেতু), অন্ন (জীবন ধারণের মূল হিসেবে), ওষুধ (রোগ নিবারণকারী ও প্রাণদ হেতু), পারদ (ওষুধ হিসেবে রসায়ন যোগে পান করলে আয়ু বাড়ার কারণে), স্বর্ণ (আগুনে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না এবং কালসহ বলে), বারাহীকন্দ, বনযুগ এবং বিষ।
যোগমার্গ ও ভক্তিমাগে অমৃতের আলাদা তাৎপর্য রয়েছে। জ্যোতিষশাস্ত্রে অমৃত হচ্ছে নক্ষত্রামৃত যোগ ও তিথ্যমৃতযোগ, যেমন রবিবারে উত্তর ফাল্গুনী, উত্তরাষাঢ়া, উত্তরভাদ্রপদ, রোহিনী, পুষ্ণা, হস্তা, মূলা, রেবতী; সোমবারে শ্রবণা, ধনিষ্টা, রোহিনী, মৃগশিরা, পূর্বফাল্গুনী , উত্তর ফাল্গুনী, পূর্বভাদ্রপদ, উত্তরভাদ্রপদ, হস্তা, অশ্বিনী; মঙ্গলবারে পুষ্যা, অশ্লেষা, কৃত্তিকা, স্বাতী, উত্তরভাদ্রপদ, রেবতী; বুধবারে কৃত্তিকা, রোহিনী, শতভিক্ষা, অনুরাধা; বৃহস্থপ্পতিবারে স্বাতী, পুনর্বসু, পুষ্যা, পূর্বভাদ্রপদ, উত্তরভাদ্রপদ, অশ্বিনী, শ্রবণা, অনুরাধা এবং শনিবারে স্বাতী ও রোহিনী নক্ষত্র হলে নক্ষত্রামৃতযোগ হয়।
অন্যদিকে রবি ও সোমবারে পূর্ণাতিথী, মঙ্গলবারে ভদ্রা, বুধ ও শনিবারে নন্দা, বৃহস্পতিবারে জয়া এবং শুক্রবারে রিক্তা হলে তিথ্যমৃতযোগ হয়। এছাড়া অভিধানে অমৃতের আরও অর্থ রয়েছে।
ব্যাকরণ মতে, ন = অ-মৃত (মৃত্যু অর্থাৎ ‘যা পান বা সেবন করলে মৃত্যু হয় না’। দধি, দুগ্ধ, ঘৃত, মধু ও চিনি এ পাঁচটি দ্রব্য পঞ্চামৃত বলে কথিত। গর্ভবতীর গর্ভশোধনার্থে ইহা পঞ্চম মাসে সেব্য।
ইসলামী বিশ্বাস মতে, অমৃতের সমতুল শব্দ হতে পারে অ’বে হায়া’ত। অর্থাৎ যে পানি পান করে হযরত খিজির (আ.) অমরত্ব লাভ করেন (তুমি অমৃতের পুত্র অজেয়, নিজে ভগবান কহে- মায়ামুকুর, কাজী নজরুল ইসলাম)।
অমৃত মানে পীযুষ (গুরুদেব জানতেন কবি অমৃতের দূত, তাই তার নাট্যে সঙ্কট সময়ে হঠাৎ অদ্ভুত, বহুরূপী ঠাকুর্দাকে দেখি, কিম্বা কবিকে- সুধীন্দ্রনাথ দত্ত; ক্লান্ত আমি তার লাগি অন্তর তৃষিত, কত দূরে আছে সেই খেলা-ভরা মুক্তির অমৃত- শেষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; ডাবের শাঁসে অমৃতের স্বাদ গ্রহণ করে- ড. মুহম্মদ এনামুল হক; তরি উপান্তে বৈষ্ণবলীলা লভিল প্রথম অমৃত ছিটা- সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত; অন্তরে পেয়ে অমৃত অল্প মাগিতেছে হলাহল- কাজী নজরুল ইসলাম; খান সে অন্ন তব অমৃত সমুদ্ভব- সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত; সরসী বিকচ পদ্ম, পদ্ম সে মধুপ অলঙ্কার, মধুপ গুঞ্জনরত, গুঞ্জন অমৃত পারাবার- শ্যামাপদ চক্রবর্তী), সুধা, লালা (অধরামৃত)। অমর, দেবতা, স্বর্গ, ধন্বন্তরির মরণ নেই বলেই এগুলোও অমৃত।
সুবলচন্দ্র মিত্র তাঁর সরল বাঙ্গালা অভিধানে লিখেছেন, ‘অমৃত বলিলে এক অত্যাশ্চর্য মোহনাভাব মনোমধ্যে উদিত হয়, যেন অমৃত শব্দ সর্বসুখদ বিষয়ের পরাকাষ্ঠাবোধক। প্রকৃতপক্ষে যাহা সর্বাপেক্ষা সুদৃশ্য, যাহা সর্বাধিক শ্রুতিসুখপ্রদ, যাহার তুল্য উৎকৃষ্ট স্বাদু আর নাই, যাহার সৌরভে সর্বসদ গন্ধ অপেক্ষা সর্বাধিক আনন্দ লাভ হয়, যাহা স্পর্শ করিলে অন্যবিধ যাবতীয় সুখস্পর্শ দ্রব্য বিস্মৃত হইতে হয়, এবং যাহা চিন্তা করিলে অপার আনন্দনীরে নিমগ্ন হইতে হয়, এতাদৃশ পদার্থই অমৃত, সুধা ও পীযুষ বলিয়া অভিহিত। এ কারণেই অমৃতং শিশিরে বহিক্রর মৃতং পণ্ডিতঃ সুতঃ অর্থাৎ শীতকালে অগ্নি অমৃত এবং পণ্ডিত পুত্র অমৃত ইত্যাদি বাক্য নির্দিষ্ট হইয়াছে।
যোগমার্গাবলম্বীরা বলেন, ‘সহস্রার হইতে অতি সুখদ, সর্বসন্তাপনাশক এবং ক্ষুধা-তৃষ্ণাদি-নিবারক এক প্রকার অপূর্ব তরল পদার্থ নির্গত হয়, উহাই অমৃত।’
মুমুক্ষুরা বলেন, ভগবাচ্চিন্তনকালে এক প্রকার অনির্বচনীয় পদার্থ সর্বশরীরে সঞ্চারিত হইয়া সাধককে অসাধ্য সাধনে সমর্থ করে, উহাই অমৃত।
পুরাণে বর্ণিত আছে, দেবতারা যে অমৃত সেবন করিয়া মৃত্যুর গ্রাস হইতে উদ্ধার পাইয়াছেন, বলবীর্য সম্পন্ন হইয়াছেন এবং নানাবিধ সুদুর্লভ শক্তি লাভ করিয়াছেন, উহা নিুলিখিত রূপে উৎপন্ন হইয়াছিল: পৃথুরাজার উপদেশ অনুসারে ধরিত্রীকে গাভীরূপ ও ইন্দ্রকে বশ করিয়া দেবতাদিগের দ্বারা হিরম্ময় পাত্রে পয়ঃ দোহন করা হইলে তাহা হইতে যে অমৃত উৎপন্ন হইয়াছিল, তাহা দুর্বাসার শাপে সমুদ্রগর্ভে পতিত হয়। পরে ইন্দ্র দুর্বাসা কর্তৃক অভিশপ্ত হইয়া বিষ্ণুর নিকট গমন করেন। তাহাতে বিষ্ণু কূর্মরূপ ধারণ করেন এবং মন্দার পর্বতকে মন্দনদণ্ড করেন এবং বাসুকিকে মন্থনরজ্জু করিয়া সমুদ্র মন্থন করা হইলে তাহা হইতে অমৃত, ঐরাবত হস্তী, উচ্চেঃশ্রবা অশ্ব প্রভৃতি উত্থিত হইয়াছিল’।
ফারসিতে অমৃতের সমতুল শব্দ আবেহয়াত।
লৌকিক এক সংস্কৃত শ্লোকে বলা হয়েছে:
‘কেচিদ বদন্তি অমৃতস্তোসি সুরালয়ে কেচিদ বদন্তি অমৃতস্তোসি প্রিয়াস্য অধরে। ময়া পঠিতানি নানা শাস্ত্রাণি অমৃতস্তোসি জম্বুর নীর পুটিত ভর্জিত মৎস্য খণ্ডে।’ অর্থ্যাৎ কেউ কেউ বলেন, অমৃত আছে সুরালয়ে (এখানে, ‘সুরালয়ে’ শব্দটার দুটো মানে আছে। সন্ধির খেলা আর কি! প্রথমটা পড়তে হবে সুর+আলয়= দেবতার মন্দির। দ্বিতীয়টা- সুরা+আলয়= ভাঁটিখানা)। আবার কেউ কেউ বলেন, অমৃত আছে, প্রিয়ার অধরে মানে চুম্বনে। অনেক শাস্ত্র পড়েছি। কিন্তু অমৃত আছে লেবুর রস দেওয়া ভাজা মাছের মধ্যে।’
মধ্যযুগের বাংলায় আম ফল অর্থেও অমৃত শব্দটি ব্যবহৃত হতো (বৃক্ষেতে অমৃত ঝোলে মৎস্য চরে জলে- আবদুল হাকিমের লালমোতি সয়ফুল মুলুক; কোথাত অমৃত ফল কপির আহার- মুহম্মদ খানের সত্যকলির বিবাদ-বিসম্বাদ)।
জিয়াউদ্দিন সাইমুমের ব্লগ থেকে
বিবার্তা/জিয়া
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]