শিরোনাম
অজাত বিশেষণ, বিশেষ্যও বটে
প্রকাশ : ০৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৫:৩১
অজাত বিশেষণ, বিশেষ্যও বটে
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

অজাত শব্দটি বিশেষণ ও বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিশেষণে ‘অজাত’ মানে জন্মায়নি এমন বা জন্মহীন (যেমন বিলীনভাবে ছিনু, ছিনু ওই বিরাট জঠরে, অজাত ভুবনভ্রুণ মাঝে লক্ষকোটি বর্ষ ধ’রে ওই তব অবিশ্রাম কলতান অন্তরে অন্তরে মুদ্রিত হইয়া গেছে- সমুদ্রের প্রতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। এই অর্থে ‘অজাত’ শব্দটির উচ্চারণ ‘অজাতো’।


বিশেষণ অর্থে অজাত শব্দটি দিয়ে হীন জাতীয়, নীচ জাতীয়, জারজ বোঝায়। জারজ বোঝানোর ক্ষেত্রে অজাত এর উচ্চারণ ‘অজাত্’। অজাত শব্দ থেকে অজাতকুজাত, অজাতশত্রু, অজাতশ্মশ্রু ইত্যাদি তৈরি হয়েছে। তিনটি শব্দই বিশেষ্য পদ।


অজাতকুজাত মানে নীচ জাতি, অনাচরণীয় জাতি বা বংশ। অজাতশত্রু মানে যার শত্রু গজায়নি, শত্রুহীন। আবার অজাতশ্মশ্রু মানে দাড়ি-গোঁফ গজায়নি এমন। অবশ্য আলঙ্কারিক অর্থে অজাতশ্মশ্রু মানে ‘অল্প বয়সী’।


নীচ বংশোদ্ভব বা ইতর অর্থে ব্যবহৃত অজাত শব্দের মূল ‘অজাতি’। উর্দুতে অকুলীন অর্থে ‘পরযাত’ শব্দটি চালু রয়েছে। শাস্ত্রে রয়েছে: ‘অজাত ইত্যেবং কশ্চিদ্ভীরুঃ প্রতিপদ্যতে। রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যং।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংস্কৃত এই শ্লোকটির তরজমা করেছেন এভাবে ‘তুমি অজাত, জন্মরহিত, কোন ভীরু তোমার শরণাপন্ন হইতেছে, হে রুদ্র তোমার যে প্রসন্ন মুখ তাহার দ্বারা আমাকে সর্বদা রক্ষা করো। তিনি রহিয়াছেন ভয় নাই, ভয় নাই! সম্মুখে যদি অজ্ঞান থাকে তবে দূর করো, অন্যায় থাকে তবে আক্রমণ করো। অন্ন সংস্কার বাধাস্বরূপ থাকে তবে তাহা সবলে ভঙ্গ করিয়া ফেলো; কেবল তাঁহার মুখের দিকে চাও এবং তাহার কর্ম করো! তাহাতে যদি কেহ অপবাদ দেয় তবে সে অপবাদ ললাটে তিলক করিয়া লও, যদি দুঃখ ঘটে সে দুঃখ মুকুটরূপে শিরোধার্য করিয়া লও, যদি মৃত্যু আসন্ন।’


আবার ‘অজ্ঞান’ শব্দের সংস্কৃত ও বাংলা অর্থের মাঝে পার্থক্য আছে। সংস্কৃতে বিশেষণ হিসেবে অজ্ঞান মানে জ্ঞানহীন, মূর্খ, অশিক্ষিত, মূর্ছিত, অচেতন, সংজ্ঞাহীন। অন্যদিকে সংস্কৃতে বিশেষ্য হিসেবে অজ্ঞান মানে জ্ঞানের অভাব, অবিদ্যা (সে কি মনে পড়িবে তোমার সহস্র লোকের মাঝখানে যেমনি দেখিতে মোরে কোন্ আকর্ষণডোরে আপনি আসিতে কাছে জ্ঞানে কি অজ্ঞানে- নারীর উক্তি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। মায়া, মোহও সংস্কৃতে অজ্ঞান অর্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু বাংলার বিশেষ্য হিসেবে অজ্ঞানতা মানে মূর্খতা, জ্ঞানহীনতা।


অজ্ঞানতিমিরও বিশেষ্য। বাংলায় এটার অর্থ মূর্খতারূপ অন্ধকার, অজ্ঞানের অন্ধকার, মায়াঘোর। আবার বহুব্রীহি সমাসের নিয়মে ‘যার জ্ঞান নেই’ অর্থে অজ্ঞান মানে জ্ঞানশূন্য বা চেতনাহীন। তবে বর্তমানে শব্দটি প্রধানত সংজ্ঞাহীন অর্থে ব্যবহৃত হয়। মধ্যযুগের বাংলায় শব্দটি নির্বোধ, মূঢ়, বোকা (অজ্ঞান ছাওয়াল আমার কিছু নাহি জ্ঞানে- গুপীচন্দ্রের সন্ন্যাস, শুকুর মাহমুদ), অশিক্ষিত (অজ্ঞানের জ্ঞানহেতু খড়ি হাতে দিল- শাহবারিদ খানের রচনাবলী, আহমদ শরীফ সম্পাদিত) অর্থে ব্যবহৃত হত। তবে হ্যালহেডের বাংলা-ফারসি শব্দকোষে অজ্ঞান শব্দের অর্থে ‘শিশু’ লেখা হয়েছে।


অন্যদিকে আঁচল অর্থে অঞ্চল শব্দটি তৎসম। সংস্কৃতে এটার অর্থ আঁচল (থাক তব বিকি-কিনি ওগো শ্রান্ত পসারিনী, এইখানে বিছাও অঞ্চল; অঞ্চল মাঝে ঢাকিব তোমায় নিশীথ নিবিড় চুলে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; যাঁহার বুদ্ধি বাল্যে পুস্তক মধ্যে, যৌবনে বোতল মধ্যে এবং বার্ধক্যে গৃহিণীর অঞ্চলে তিনিই বাবু- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; সদাই চঞ্চল বসন অঞ্চল সম্বরণ নাহি করে, বসি থাকি থাকি উঠয়ে চমকি ভূষণ খসায়া পড়ে- চণ্ডীদাস; চঞ্চল করিছে তারে অঞ্চল ধরিয়া- ঈশ্বরচণ্ড গুপ্ত)।


কিন্তু বাংলায় অঞ্চল মানে কোন দেশের এলাকা (সেই অবলুপ্ত সমুদ্রেরই শেষ চিহ্ন মরুসাগর জর্দান অঞ্চলে- মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ)। সংস্কৃতে এলাকা অর্থে অঞ্চল শব্দের প্রয়োগ নেই। আবার সংস্কৃত অঞ্চল শব্দের মূল অর্থ ‘শাড়ির পাড়’। কিন্তু সংস্কৃত অঞ্চল থেকে বাংলায় আসা ‘আঁচল’ মানে শাড়ির পাড়। তবে সংস্কৃতে অঞ্চল শব্দটি দিয়ে ‘এলাকা’ও বোঝায়।


প্রান্তভাগ অর্থে মধ্যযুগের বাংলায়ও শব্দটির ব্যবহার ছিল (নয়নক অঞ্চল চঞ্চল ভান- বিদ্যাপতির পদাবলী)। আবার আঁচল অর্থেও মধ্যযুগে শব্দটির সাবলীল ব্যবহার ছিল (আপনা অঞ্চলে মোছ বদন সুন্দর- মধুমালতী, সৈয়দ হামজা)।


জিয়াউদ্দিন সাইমুমের ব্লগ থেকে


বিবার্তা/জিয়া


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com