
এককালে অভিভাবক শব্দের অর্থ ছিল ‘পরাজয়কারী’। এখন অভিভাবক শব্দটি দিয়ে আশ্রয়দাতা ও রক্ষণাবেক্ষণকারী বোঝায়। অভিভব বা অভিভাব শব্দের অর্থ পরাভব বা পরাজয় (সাধিকার একান্ত সাধনায় কালচক্রের অভিভব হইয়া গেল। সাবিত্রী জয়যুক্তা হইলেন- কবি কালীদাস রায়)।
অভিভব বা অভিভাব থেকেই হয়েছে অভিভাবক। এ কারণে মূলানুগ অর্থে অভিভাবক অর্থ ‘যে অভিভব করে বা পরাজয়কারী’। কিন্তু শব্দটি এই অর্থে প্রচলিত নয়। বরং আশ্রয়দাতা বা তত্ত্বাবধায়ক অর্থে ব্যবহৃত হয়।
একইভাবে অভিভূত শব্দের মূল অর্থ ‘যিনি অভিভব প্রাপ্ত হয়েছেন বা যিনি পরাভূত’ হলেও শব্দটি দিয়ে বিহ্বল, বশীভূত, আচ্ছন্ন, অজ্ঞান বোঝায়।
আবার ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে অভিমান মানে ‘আমার সমান নাই’- এই বোধ। গর্ব বা দর্প অর্থেও অভিমান শব্দের প্রয়োগ ছিল (অভিমানে কাঁপে দুর্যোধন কলেবর- মহাভারত)।
শব্দটি দিয়ে শৃঙ্গার রসের অবস্থাভেদও বুঝায়। শব্দটি সংস্কৃতে জ্ঞান, প্রণয়, হিংসা অর্থেও চালু রয়েছে।
অমরকোষের টীকায় বলা হয়েছে, ‘আমার সমান কেহ নাই’- এই মনন। মনোবেদনা বা ক্ষোভ অর্থেও বাংলায় শব্দটির ব্যবহার রয়েছে (অভিমানে বুক ভরে-পারি না কসাতে সেদিনের মত চড় অথবা শাসাতে- মনীশ ঘটক; নলিনী কখনো অভিমান করে নাই, স্বামীর কষ্টের কথা মনে করিয়া সে নীরবে সমস্ত সহ্য করিত- বোঝা, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; যখন ওথেলো ভীষণ রাক্ষসের ন্যায় নিশীথশয্যাশায়িনী সুপ্তা সুন্দরীর সম্মুখে ‘বধ করিব!’ বলিয়া দাঁড়াইলেন, তখনও রাগ নাই, অভিমান নাই, অবিনয় বা অস্নেহ নাই, দেসদিমোনা কেবল বলিলেন, ‘তবে ঈশ্বর আমায় রক্ষা করুন’- শকুন্তলা, মিরন্দা এবং দেসদিমোনা, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)।
ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, ভৌগোলিক কারণেও মাঝে মাঝে শব্দের অর্থে যে পরিবর্তন আসে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে ‘অভিমান’ ও ‘শাক’ শব্দ দুটি। তাদের মতে, বাংলার আবহাওয়ায় অভিমান শব্দে স্নেহমিশ্রিত অনুযোগের আবহ থাকলেও পশ্চিম ভারতীয় হিন্দিতে তা নেই। ওখানে অভিমান মানে অহংকার, অহংবোধ। তেমনি বাংলার আবহাওয়ায় আমিষ আহার যতটা অনুকূল, শাক ততটা নয়। তাই বাংলা মুলুকে শাক বলতে সবজির লতাপাতা বোঝায়। কিন্তু পশ্চিম ভারতে যে কোনো নিরামিষ তরকারিই শাক নামে পরিচিত।
সংস্কৃতে অভিমানী মানে গর্বিত, অহংকারী। বাংলায়ও এ দুটি অর্থ চালু আছে (আমাদের মেয়েটি অভিমানী, যদি নলিনাক্ষের লেশমাত্র বিরক্তিভাবও দেখিতে পায় তবে উহার পক্ষে বড়ো কঠিন হইবে- নৌকাডুবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
তবে ‘যার মনে ক্ষোভ আছে’ অর্থেই অভিমানী শব্দটি বাংলায় বেশি প্রচলিত, যা সংস্কৃতে ব্যবহৃত হয় না (এ মন তখন কেমন যেন বাসত ভালো আর কাহারে, আমিই দূরে ঠেলে দিলাম অভিমানী ঘর-হারারে- অবেলার ডাক, কাজী নজরুল ইসলাম)।
বলা যায়, অভিমানী শব্দটির অর্থের উৎকর্ষ ঘটেছে। এক সময় অভিমানী শব্দটি দিয়ে অহংকারী বোঝাতো।
জিয়াউদ্দিন সাইমুমের ব্লগ থেকে
বিবার্তা/জিয়া
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]