শিরোনাম
শব্দের ফ্রেমে হরিৎ হরিণ
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০১৭, ০৭:৫৫
শব্দের ফ্রেমে হরিৎ হরিণ
জিয়াউদ্দিন সাইমুম
প্রিন্ট অ-অ+

হরিণের মূল অর্থ ‘যে হরণ করে।’ তবে প্রচলিত অর্থে হরিণ এক জাতীয় তৃণভোজী পশুকেই নির্দেশ করে (হরিণ বদলে পাইনু পুরান খোসলা- কবিকঙ্কণ চণ্ডী; বাহিলক দেশের ব্যবসায়ীদের কাছে কাদলী হরিণের নরম আর চকচকে চামড়া দেখেছি; কখনো আমরা গবয় শিকার করতাম কখনো হরিণ- রাহুল সংস্কৃত্যায়ন, অনুবাদ ভগীরথ; হরিণ মাংসের মত কোন কোন বাঙ্গালা খবরের কাগজ বাসী না হলে গ্রাহকরা পান না- হুতোম প্যাঁচার নকশা, কালীপ্রসন্ন সিংহ; হামেশা শিকার করে হরিণ জানোয়ার- সৈয়দ হামজা; যেখানে নব্য শূকর বা সম্বর হরিণের দল যাতায়াতের সুঁড়ি পথ তৈরি করিয়াছে- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়; পথের গায়ে ইক্ষুছায়ে হরিণ বসে থাকে, যাচ্ছে যার গ্রাম্যবধূ পূর্ণ কুম্ভ ফাঁকে, ঘুমন্ত শিশু- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; স্বাধীন দেশের তোরণদ্বার পার হইয়া মুক্তি-বাঁশীর অগ্নিসুর হরিণের মত তাহাকে মুগ্ধ মাতাল করিয়া ডাক দিতেছিল; চখা হরিণীর মতো ভীত- কাজী নজরুল ইসলাম; হরিণ বরাহ নির্মূল করি মানুষ মৃগরা শেষে- সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত; পদ্মাবতী একাকিনী বৃক্ষমূলে বসিয়া যূথভ্রষ্টা হরিণীর ন্যায় বিষণ্ন বদনে রোদন করিতেছেন- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর; তৃখণ্ডা আতুর হরিণীর চোখে কি হবে হানিয়া মরীচিমায়া- মোহিতলাল মজুমদার; হরিণীর মত ভীত ত্রস্ত চাউনি দিয়ে চারিদিকে চেয়ে আচমকা আর্ত ব্যাকুল স্বর সে কেঁদে উঠল- কাজী নজরুল ইসলাম; তড়িত বরণী হরিণ-নয়নী দেখিনু আঙিনা মাঝে- চণ্ডীদাস; সাঁওতালী মেয়েরা বনের পথে নেচে বলে যেন যেন হরিণছানা- অজিত দত্ত; তোমরা যেমন করে বনের হরিণী নিয়ে যাও বুকে তার তীক্ষ্ম তীর বিঁধে- সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)।


বাংলা একাডেমির অভিধানে হরিণের অর্থে বলা হয়েছে ‘বড় চোখবিশিষ্ট সরল বা শাখাপ্রশাখাযুক্ত শিংওয়ালা এক প্রকার গাঢ় বর্ণের সুদৃশ্য প্রাণী, যা খুব দ্রুত দৌড়ায়।’ অভিধানটিতে আরো বলা হয়েছে, হরিণের অন্য দুটি প্রজাতি মৃগ ও কুরঙ্ক।


মধ্যযুগের বাংলায় শব্দটিকে লেখা হতো এণ (এণারিপু বাহিনী ও একান্তরে যাও- ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর। ‘এনাক্ষী’ মানে মৃগনয়না।


চর্যাপদে রয়েছে ‘অপণা মাঁসে হরিণা বৈরী’ অর্থ্যাৎ হরিণের মাংসের লোভেই লোক প্রাণিটিকে হত্যা করে। এ কারণে হরিণ নিজের মাংসের জন্য নিজের শত্রু।


চর্যাপদের ভাবধারায় পরবর্তীকালে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ‘আপনার মাঁসে হরিণী জগতের বৈরী’ বা ‘যেন বনের হরিণী ল নিজ মাঁসে জগতের বৈরী’; কবিকঙ্কণে ‘হরিণ জগতবৈরী আপনার মাঁসে’ আর ভবানন্দের হরিবংশে ‘বনের হরিণী আমি কার ধার ধারি’। আপনার মাংসে হইনু জগতের বৈরী’ লেখা হয়েছে।


ইংরেজি deer শব্দটির আসল অর্থ খুব বড়, কিন্তু এই অর্থ এখন আর ব্যবহৃত হয়‍ না। মধ্যযুগের ইংরেজিতে der শব্দের অর্থ হচ্ছে বন্য পশু। ১৫০০ সালে এই শব্দটির উপর ভিত্তি করে হরিণের ইংরেজি deer করা হয়। deer শব্দের সাথে এখনও কিছু কিছু দেশের ভাষায় পশুর অর্থের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন জার্মানের tier, ডাচদের dier এবং স্ক্যানডিনেভিয়ান djur, dyr, d’y ইত্যাদি। deer শব্দটির একবচন ও বহুবচন একই।


হুমায়ুন আজাদ তাঁর ‘তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘অর্থসংকোচনের চমৎকার উদাহরণ deer ও মৃগ শব্দ দুটি। ইংরেজি deer এখন বিশেষ এক প্রজাতির পশু অর্থাৎ হরিণ বোঝায়। এখনো deer -এর জর্মন সমশব্দ tier [টীর] হরিণ বোঝায় না, পশু বোঝায়। পুরনো ইংরেজিতে শব্দটি ছিল deor। এটি হরিণ বোঝাতো না, যে-কোনো পশু বোঝাতো; এমনকি শেক্সপিয়রেও পশু অর্থে পাওয়া যায় deer শব্দটি: ‘mice and rats, and such small deer’। গথিকে শব্দটি ছিলো dius, যার অর্থ ‘বন্যপ্রাণী’, এবং প্রাচীন উচ্চ জর্মনে tior, ওলন্দাজ dier, প্রাচীন স্যাক্সন dior, প্রাচীন ফ্রিজীয় diar, প্রাচীন আইসল্যান্ডীয় dy’r ও সুয়েডীয় djur বোঝাতো ‘বন্যপ্রাণী’। কিন্তু ক্রমশ বন্যপ্রাণীসূচক deer শব্দটি শুধুই হরিণ বোঝাতে থাকে; কারণ শিকারীদের কাছে হরিণই ছিলো অনন্য বন্যপ্রাণী। একই রকম ঘটনা ঘটে ভারতীয় আর্যভাষায়। মৃগ যে বন্যপ্রাণী বোঝাতো, তা বোঝা যায় ‘মৃগয়া’, ‘মৃগরূপ’, ‘মৃগরাজ’ প্রভৃতি শব্দ থেকে। শিকারীরা মৃগয়ায় যেতো পশুপাখি শিকারের জন্যে; আর ওই বনে বিভিন্ন পশুর মধ্যে থাকতো আপন মাংসের জন্য বৈরী হরিণ। হরিণ রেখে তো রাজারা শুয়োর শিকার করতো না; তাই ‘মৃগয়া’ হয়ে ওঠে ‘হরিণশিকার’, আর মৃগ হয়ে ওঠে অনন্য বন্যপ্রাণী হরিণ।’


এদিকে যে বর্ণ হিন্দি ও বাংলায় নীল, গুজরাটিতে তা-ই সবুজ। হরিদ্রা বা হলুদের সঙ্গে ধ্বনি-সাযুজ্যের কারণে কারো কারো মনে হতে পারে হরিৎ মানে হলুদ। আসলে হলুদ বা হরিদ্রার সাথে হরিৎ এর কোনোই সম্পর্ক নেই।


হরিৎ অর্থ সবুজ বা শ্যামল (তনুর লাবণি মনে দেখিয়াছি মনে পড়ে, হরিৎ ধান্য-ব্যাকুল গ্রামের সীমা, কাননকণ্ঠলগ্না নদীর মনোহর ভঙ্গিমা- প্রেমেন্দ্র মিত্র; হুতাশিয়া ফেরে পূরবীর বায়ু হরিৎ-হুরীর দেশে, জর্দাপরীর কনক-কেশর কদম্ববন শেষে!- সত্যকবি, কাজী নজরুল ইসলাম; দশ সহস্র নরকণ্ঠের কল কল রব, মধুর বায়ুসন্তাড়িত বৃক্ষপত্ররাশির মর্মর, সৈকতবাহিনী তরঙ্গিণীর মৃদু মৃদু তর তর রব, নীল আকাশে চন্দ্র, তারা শ্বেত মেঘরাশি, শ্যামল ধরণীতলে হরিৎ কানন, স্বচ্ছ নদী, শ্বেত সৈকত, ফুলকুসুমদাম- আনন্দমঠ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; দেখিতে দেখিতে হরিৎ প্রান্তর প্রসূনিত- অব্যক্ত, জগদীশচন্দ্র বসু; বরং চার দিককার সেই হরিৎ ক্ষেত্রের উপর খেজুরকুঞ্জের মধ্যে প্রভাতটি আমার অতি চমৎকার লেগেছিল- য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।


লেখাটি লেখকের ব্লগ থেকে নেয়া


বিবার্তা/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com