শিরোনাম
সুন্দরী প্রতিযোগিতার নামে অসুন্দরের চর্চা
প্রকাশ : ২৩ অক্টোবর ২০১৭, ১৮:৪৮
সুন্দরী প্রতিযোগিতার নামে অসুন্দরের চর্চা
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

বেশ কিছুদিন পুরো বাংলাদেশ ভুগেছে ‘লাভেলো মিস বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড’ নামক প্রতিযোগিতার জ্বরে। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে এখন তো সবকিছুই মানুষকে আগের চাইতে বেশি ভাবায়। জান্নাতুল নাঈম এভ্রিল বিতর্কের কারণে তাই বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার নিয়ম-কানুন থেকে শুরু করে খুঁটিনাটি বিষয় পর্যন্ত মানুষের আগ্রহের বস্তুতে পরিণত হয়েছে বলা যায়।


‘লাভেলো মিস বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড' আয়োজনটি মান বিচারে কতটুকু সফল বা ব্যর্থ সেই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, তারা তাদের আয়োজনটির প্রচার করতে অন্তত শতভাগ সফল হয়েছে। এভ্রিল বিতর্কটি না হলে বাংলাদেশে যে একটা সুন্দরী প্রতিযোগিতা হচ্ছে, তা আমার মতো যারা বিনোদন জগত সম্পর্কে খুব একটা খোঁজখবর রাখেন না, তাদের নজরেই হয়তো পড়তো না।


এ ধরনের প্রতিযোগিতা সম্পর্কে সদ্যজন্মানো আগ্রহ থেকে একটু ঘাঁটাঘাটি করে চমকপ্রদ সব তথ্য পেলাম। জানলাম, তথ্য গোপন করার ক্ষেত্রে আমাদের জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলই প্রথম নয়, বিতর্ক আর মুকুট হারানোর কাহিনী সুন্দরী প্রতিযোগিতাগুলোর একদম শুরু থেকেই হয়ে আসছে। ষোড়শ শতকে প্রাচীন গ্রীসে অনুষ্ঠিত প্রথম সুন্দরী প্রতিযোগিতাই হয়েছিল প্রশ্নবিদ্ধ। নতুন শহর ব্যাসিলেসের উদ্বোধন উপলক্ষে করিন্থের শাসক কিপসেলাস ওই সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন, যে প্রতিযোগিতায় তিনি বিজয়ী করেছিলেন নিজের স্ত্রীকেই। প্রথম যে অ্যামেরিকান নারী বিশ্বসুন্দরী হয়েছিলেন, সেই মারজেরি ওয়ালেসও খেতাব হারিয়েছিলেন। কারণ, খেতাব জেতার পর দেখা গেল তিনি পিটার রেভসনের স্ত্রী এবং গায়ক টম জোনসের গার্লফ্রেন্ড। অভিনেত্রী লিওনা গেজ বিশ্বসুন্দরী হবার পরে জানা গিয়েছিল, তিনি দুই সন্তানের মা। তিনিও মুকুট হারিয়েছিলেন।


এই প্রতিযোগিতায় বিবাহিত নারী অংশ নিতে পারেন না। কিন্তু কেন? বিবাহিত নারী সুন্দরী নন? নাকি এটি ‘মিস'দের, অর্থাৎ অবিবাহিতদের প্রতিযোগিতা বলে? ডিভোর্স নিয়ে নেয়া মেয়েটি তো আর বিবাহিত নয়, সেও তো ‘মিস' লেখে। সে কেন পারবে না? আসল সমস্যা কি তবে বিয়েতে, নাকি কুমারীত্ব চলে যাওয়ায়?


নারীদের প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মনোভাব সেই শুরু থেকে আজ অবধি যে একচুলও পরিবর্তন হয়নি, ‘বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতা'র এই কুমারিত্বের নিয়ম তারই বহিঃপ্রকাশ। আসল কথা হচ্ছে, বিয়ে হয়ে গেলে কর্পোরেট দুনিয়ায় সেই মেয়ের মূল্য কমে যায়। না-বলা কথাতেও বুঝিয়ে দেয়া হয়, মেয়ে তুমি ''ব্যবহৃত'', তোমার সৌন্দর্য্যের দাম এখন আর আমাদের কাছে নেই।


প্রাচীন গ্রিসে যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করার জন্য, তাদের মনোরঞ্জনের জন্য আয়োজন করা হতো সুন্দরী প্রতিযোগিতার, রাজরাজড়াদের মনোরঞ্জনের জন্য তাদের হারেমে ধরে নিয়ে আসা হতো কুমারী নারীদের। সবচাইতে সুন্দরী নারীটির সঙ্গে সময় কাটাতেন রাজা। এই সভ্য যুগে এসেও কি সেই মানসিকতার খুব-একটা পরিবর্তন আমরা দেখতে পাই? রাজা-বাদশাদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ব্যবসায়ীরা। কর্পোরেট মুনাফা লাভের আশায় চলছে তথাকথিত 'সৌন্দর্য্য' বাণিজ্য।


একটা ব্যাপারে আমি একমত যে, আজকের অবস্থানে এসে একবাক্যে ‘‘বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতা মানেই প্রকৃতিপ্রদত্ত শরীর প্রদর্শন করা'' বলে তাকে 'অগ্রাহ্য' করার সুযোগ নেই। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ‘বিউটি উইথ পারপাস' ট্যাগলাইন। ওপরাহ উইনফ্রে, সুস্মিতা সেন, ঐশ্বরিয়া রাইদের মতো উদাহরণ আমাদের কাছে আছে, যাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের নিজেদের কর্মক্ষেত্রে উজ্জ্বল একেকটি নাম। সৌন্দর্য্য প্রতিযোগিতাগুলোই তাঁদেরকে সেই প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিয়েছে।


আজকের যুগের বিশ্বসুন্দরীরা প্রত্যেকেই অনেক সাধনা, পরিশ্রম ও মেধার সমন্বয়। দুনিয়াতে সবাই একদিকে পারদর্শী হয় না। পৃথিবীটা যদি শুধুই জ্ঞান-বিজ্ঞান আর রাজনীতি দিয়ে চলতো, তাহলে তো বিনোদনজগতের প্রয়োজনই পড়তো না। একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী হতে গেলে যেমন পরিশ্রম ও মেধার প্রয়োজন, একজন সফল ফ্যাশন মডেল হবার জন্যও সেই অনুযায়ী যোগ্যতার প্রয়োজন হয়।


আমার আপত্তির জায়গা হচ্ছে, সৌন্দর্য্য পরিমাপের এই যে কথিত স্ট্যান্ডার্ড, এটি নির্ধারণ করেছে কারা? সুন্দরী হতে গেলে কেন শুধু ‘জিরো ফিগার'ই হতে হবে? এর মূল উদ্দেশ্য কি তবে নারীদেরকে পুরুষের চোখে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করা? যাঁদের ওজন একটু বেশি, তাঁদের নিয়ে আয়োজিত সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম ‘মিস জাম্বো সুন্দরী' কেন হবে? এই প্রতিযোগিতাগুলোর নামেই তো তাহলে 'সৌন্দর্য্যের আসল অপমান করা হচ্ছে। ৩৬-২৪-৩৬ এর ফিতা দিয়ে সুন্দরী বিচারের এই অসুন্দর প্রতিযোগিতার ভয়ংকর কুপ্রভাব পড়ছে সমাজে। নিজেদের শরীরকে একটা নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলার জন্য, তথাকথিত সুন্দরী হবার চেষ্টা করতে গিয়ে ইউরোপেই হাজারো মেয়ে ‘এনিমিয়া' ‘বুলিমিয়া'র মতো রোগে আক্রান্ত হয়েছে, কয়েকজন মডেল তো অতিরিক্ত ডায়েটের কারণে মারাও গেছেন। অনেক মেয়েই নিজেকে অসুন্দর ভাবতে শুরু করেন, আত্মবিশ্বাস কমে যায়। সংসারে, কর্মক্ষেত্রে অসুন্দরের তকমা গায়ে পরে চলতে হয় শুধুমাত্র সুন্দরের প্রতি আমাদের সিলেক্টিভ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। এই অসুন্দর চর্চার দায় কে নেবে?


আমার পরিচিত এক আঙ্কল আছেন, যিনি আমাদের সাথে গল্পের আড্ডায় বসলে প্রায়ই তাঁর সময়কার সুন্দরীদের নিয়ে গল্প করতে ভালোবাসেন। তাঁর গল্পের সব ফর্সা-লম্বা-সুন্দর গঠনের সুন্দরীদের কথা বলতে গিয়ে তাঁর চকচক করে ওঠা চোখ কখনোই আমাদের নজর এড়ায় না। নামিদামি শিক্ষিত ওই মানুষটির কাছেও মেয়েদের সৌন্দর্য্য শুধু ওই চেহারাতেই সীমাবদ্ধ। গুণের কদর তিনি করেন না তা নয়, কিন্তু সুন্দর বলতে ফর্সা চেহারা, টানা টানা নাক চোখ আর শরীরের নির্দিষ্ট গঠনকেই তিনি বোঝেন।


তাঁর কথা শুনে আর লোভে চকচক করা চোখ দেখে প্রতিবারই কেমন যেন একটা ঘেন্না র ভাব জন্মায়, প্রতিবাদ করে কিছু বলার রুচি হয় না। এই লেখাটা লেখার সময় কেন জানি বার বার তাঁর কথাই মনে পড়ছিল। সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অর্ধবসনা সুন্দরীরা অ্যাপ্রোভালের আশায় একের পর এক হেঁটে যাচ্ছে আর লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সেই আঙ্কল, শরীরের মাপে খুঁজে বেড়াচ্ছেন বিকৃত সৌন্দর্য্য।


সেকারণেই বলি - মেয়ে, তুমি যত যোগ্যতা নিয়েই ওই প্ল্যাটফর্মে হাঁটো না কেন, তোমাকে দেখে ওই আঙ্কলদের চকচক করে ওঠা চোখেই হয় পুরুষতন্ত্রের জয়।


অজন্তা দেব রায়ের ব্লগ থেকে


বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com