শিরোনাম
হেঁশেল হোঁতকা আর এক ব্যাগ হোতা
প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০১৭, ০৯:০০
হেঁশেল হোঁতকা আর এক ব্যাগ হোতা
জিয়াউদ্দিন সাইমুম
প্রিন্ট অ-অ+

হেঁশেল মূলে হাঁড়িশাল হলেও রান্নাঘর অর্থেই শব্দটি ব্যবহৃত হয় (ভিন্ন হেঁশেল হতে পারে- রাজশেখর বসু; তোর হেঁশেলের কাজ পরে হবে, এখন একবার তামাকটা সেজে দে তো- পোষ্টমাষ্টার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; তা আমি বলি কি, ওকে হেঁসেল-টেসেল ঠাকুরঘরদোরে ঢুকতে দিয়ে কাজ নেই, জানিস ত এদেশের সমাজ!- অরক্ষণীয়া, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)। হেঁসেল বানানভেদ।


আর হোঁতকা মানে মোটা, স্থূল। হোঁৎকা বানানভেদ (রাঙা চোখওলা হোঁৎকা লোকটার প্রতি অনুরক্ত- সৈয়দ মুজতবা আলী)। অভিধানে হোঁতকা শব্দের অর্থে বোকা, স্থূলবুদ্ধি, মোটা বুদ্ধি, গোঁয়ার নির্দেশিত হয়েছে। অধিকাংশ অভিধানে হোঁতকা শব্দের মূল হিসেবে হিসেবে সংস্কৃত ‘হল্লা’ শব্দকে দেখানো হয়েছে। তবে ড. মুহাম্মদ এনামুল হক তাঁর মনীষা-মঞ্জুষা গ্রন্থে’ হোঁত্কা শব্দের ব্যুৎপত্তি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেছেন। অভিধানসমূহে শব্দটি নিয়ে এতো দীর্ঘ বিবরণ নেই। তিনি শব্দটি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এ-যাবৎ ‘হোত্কা’ বা ‘হোঁৎকা’ শব্দটির উৎপত্তি নির্ণয় করা সম্ভবপর হয় নাই। সমস্ত প্রচলিত বাংলা অভিধানে শব্দটিকে ‘দেশী’ বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে অর্থাৎ শব্দটি অনার্য-ভাষার বলিয়া নির্দেশিত হইয়াছে। এই নির্দেশ সত্য নহে। সম্প্রতি আমাদের পুনরানুসন্ধানে শব্দটির প্রকৃত রূপ ধরা পড়িয়াছে এবং দেখা যাইতেছে, শব্দটি খাঁটি ‘তদ্ভব’। তবে, উহার বিবর্তনধারা কিঞ্চিৎ জটিল। নিম্নে উন্মোচিত হইল। সংস্কৃত অর্থাৎ আর্যভাষার ‘ষ-’ বা ‘ষাঁড়ের’ অর্থে ‘হন্তু’ নামে একটি শব্দ আছে। এই ‘হন্তু’ শব্দ হইতেই বাংলা ‘হোঁতকা’ বা ‘হোৎকা’ শব্দটি বিবর্তিত হইয়াছে; বিবর্তনধারা এই রূপ- সং, হন্তু= হনতু > হঁউত< হঁউৎ (‘ন’-এর সংকোচনে চন্দ্রবিন্দু “ ঁ”-এর রূপ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে ‘ত’-আশ্রিত ‘উ’ স্বরের পূর্বনিপাত ঘটিয়া শব্দটি রূপ গ্রহণ করিল ‘হঁউৎ’-এর) হোঁৎ’+ বাংলা সদশার্থে ‘কা’= হোঁৎকা অর্থাৎ ষাঁড়ের মতো পেটমোটা (উজ্জ্বল আলোয় নিজের হোঁৎকা শরীরের প্রতিবিম্বের দিকে আয়নায় চেয়ে থাকেন রণেন- যাও পাখি, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়; নেতা তখন হোৎকা পোর্টফোলিও ব্যাগ হইতে নতুন বোতল খুলিয়া ক্রমাগত ঢালিতেছেন- কবর, মুনীর চৌধুরী; রমজান আলি আর হোঁতকা মিলে এক বস্তা আলু তুলে ফেলল- কুমড়ো দানব, অনীশ দাশ অপু; হোঁতকা মরদকে সবুজ পিঠ থেকে নামিয়ে দিয়েছে ব্যাঙযুবতী- হাততালি, মলয় রায়চৌধুরী; হোঁৎকা-গোঁয়ার, ওর কি! হয়ত বলে বসবে, হোকগে লোকসান আমাদের, দে তোরা বাঁধ কেটে- রমা, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)। আরবিতে হোতকার সমতুল শব্দ যখাম, যখীম।


অন্যদিকে হোতা শব্দের অর্থ যজ্ঞের পুরোহিত, হোমকর্তা, যিনি দেবতাকে আহ্বান করেন। আধুনিককালে হোতা সাধারণত বেআইনী কাজের মূল ব্যক্তিকে বোঝায় (কোথা পাপী? তাপী কোথা? ওগো ধ্যানী তুমি পতিতপাবন-যজ্ঞে সাজিলে হোতা!- বিবেকানন্দ, জীবনানন্দ দাশ)।


বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘দেবতত্ত্ব ও হিন্দুধর্ম্ম’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘হোতৃগণ ঋকমন্ত্র পাঠ করিয়া দেবতাদিগকে আহ্বান করেন, অগ্নি হবিরাদি বহন করিয়া দেবতাদিগকে আহ্বান করেন, এই জন্য হোতা। ‘ঋত্বিজং হোতারং’- সায়নাচার্য্য ইহার এই অর্থ করেন যে, অগ্নি ঋত্বিকের মধ্যে হোতা।’


হোতা শব্দের গঠন হচ্ছে সংস্কৃত হু + তৃ (তৃচ)।


সেকালে পুরোহিতই ছিল যজ্ঞকর্মের মূল রূপকার। পুরোহিতের আদেশ-নির্দেশ ও ইচ্ছা-অনিচ্ছায় যজ্ঞকর্ম পরিচালিত হতো। বাঙালিরা সে যজ্ঞকর্মের পুরোহিতকে অপকর্মের পুরোহিত হিসেবে বাংলায় নিয়ে এসেছে। এখন বাংলায় সব অপর্কমের নায়ককে হোতা বলে প্রকাশ না-করলে যেন বাক্যের মজাই থাকে না।


লেখাটি লেখকের ব্লগ থেকে নেয়া


বিবার্তা/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com