শিরোনাম
‘হিন্দু’ আর ‘হুজুক’
প্রকাশ : ২৯ আগস্ট ২০১৭, ১১:২২
‘হিন্দু’ আর ‘হুজুক’
জিয়াউদ্দিন সাইমুম
প্রিন্ট অ-অ+

হিন্দু বলতে এক সময় সিন্ধুনদের তীরবর্তী স্থানের লোক বোঝাতো। পরে ভারতবর্ষের লোকজন হিন্দু নামে পরিচিত হয়। সবশেষে শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাই হিন্দু নামে পরিচিত হয় (মরিছে হিন্দু, মরে মুসলিম এ উহার ঘায়ে আজ, বেঁচে আছে যারা মরিতেছে তারা, এ মরণে নাহি লাজ- হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ, কাজী নজরুল ইসলাম; মহাত্মার অহিংস অসহযোগের যুগে এমনি একটা কথা এদেশে বহু নেতায় মিলিয়া তারস্বরে ঘোষণা করিয়াছিলেন যে, হিন্দু-মুসলিম মিলন চাই-ই- বর্তমান হিন্দু-মুসলমান সমস্যা, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; যদি এইখানেই ছেদ দিয়া বলি, বাস্, আর নয়, ভারতবর্ষের ইতিহাসকে আমরা হিন্দু-মুসলমানেরই ইতিহাস করিয়া তুলিব- পূর্ব ও পশ্চিম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; মুসলমানের আমল থেকে যাহাদের জাতির পরিচয়ের নাম হইয়াছে হিন্দু, তাহাদের প্রথায় মড়াকে পোড়াইয়া ছাই করিতে হয়- ভূতের বোঝা, বিজয়চন্দ্র মজুমদার)।


কারো মতে সংস্কৃত সিন্ধু থেকে হিন্দু শব্দটি এসেছে। এটা সঠিক নয়। ফারসি হিন্দ থেকে হিন্দু শব্দটির উৎপত্তি। ফারসিতে হিন্দ শব্দের অর্থ কালো।


সিন্ধু ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটি ঐতিহাসিক নদী। ঋগ্বেদে সিন্ধু নদের স্তুতি করা হয়েছে। পরবর্তীকালের আরবি সাহিত্যেও ‘আল-হিন্দ’ শব্দটির মাধ্যমে সিন্ধু নদ অববাহিকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়েছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ভারতের নামের সমার্থক শব্দ হিসেবে হিন্দুস্তান বা হিন্দুস্থান শব্দটির উৎপত্তি হয়। এই শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘হিন্দুদের দেশ’।


বাংলা ভাষার প্রথমদিকে হিন্দু শব্দটি ধর্মনির্বিশেষে ভারতীয় উপমহাদেশের সকল অধিবাসীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। কেবলমাত্র ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ ও ‘চৈতন্যভাগবত’সহ ষোড়শ-অষ্টাদশ শতাব্দীর কয়েকটি বাংলা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মগ্রন্থে যবন বা ম্লেচ্ছদের থেকে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের পৃথক করার জন্য শব্দটি বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইউরোপীয় বণিক ও ঔপনিবেশিক শাসকেরা ভারতীয় ধর্মবিশ্বাসগুলির অনুগামীদের একত্রে হিন্দু নামে অভিহিত করে। ধীরে ধীরে এই শব্দটি আব্রাহামীয় ধর্মসমূহ অথবা অবৈদিক ধর্মবিশ্বাসগুলির (যেমন জৈনধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও শিখধর্ম) অনুগামী নন এবং সনাতন ধর্ম নামক ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এমন সকল ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়ে পড়ে। আর ইংরেজি ভাষাতে ভারতের স্থানীয় ধর্মীয়, দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলি বোঝাতে হিন্দুইজম বা হিন্দুধর্ম কথাটি চালু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে।


হিন্দুধর্ম আজ একাধিক শাখায় বিভক্ত। অতীতে এই ধর্ম ছয়টি দর্শনে বিভক্ত ছিল। বর্তমানে এগুলির মধ্যে কেবল বেদান্ত ও যোগেরই অস্তিত্ব আছে। আধুনিক হিন্দুধর্মের প্রধান বিভাগগুলি হলো বৈষ্ণবধর্ম, শৈবধর্ম, স্মার্তবাদ ও শাক্তধর্ম।


বেদে শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। রামায়ণ, মহাভারত, গীতা এমনকি মনুসংহিতায়ও শব্দটির সন্ধান পাওয়া যায় না।


ড. দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁর ‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘সিন্ধুনদ থেকেই ‘হিন্দ’, ‘হিন্দু’ ও ‘হিন্দুস্থান’ প্রভৃতি শব্দ এসেছে।’


ফারসিতে সিন্ধুর উচ্চারণ ‘হিন্দু’। বিশেষ করে ফারসি সাহিত্য ও ইতিহাসে সিন্ধু নদের অববাহিকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে হিন্দু বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।এখানেই শেষ নয়, ইংরেজিতে সিন্ধুনদের নাম ‘Indus’। এই Indus-ই পরবর্তীকালে ‘‘India’ শব্দে রূপান্তরিত হয়। তবে হালের ফারসি সাহিত্য ও ইতিহাসে হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলের অধিবাসীদের ‘হিন্দুস্তানি’ বলা হয়।


হিন্দু শব্দটি বাস্তবতায় ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও সভ্যতাভিত্তিক একটি ধারণা। নীরদ সি চৌধুরী তাঁর ‘হিন্দুইজম: এ রিলিজিয়ন টু লিভ বাই’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘হিন্দুরাও এক সময় পরিচয় দিতে গিয়ে ‘হিন্দু’ শব্দটি ব্যবহার করত না। শব্দটি প্রথম ব্যবহার করে মুসলিম শাসকরা (Even the word Hindu was not used by them to designate themselves except when, under Muslim Rule, they employed this Muslim term for this purpose).


অন্নদাশঙ্কর রায়ও তাঁর ‘সংস্কৃতির বিবর্তন’ প্রবন্ধে লিখেছেন ‘হিন্দী’ শব্দটি হিন্দুর মতই বাইরে থেকে আমদানি। হিন্দু শব্দের মূল সিন্ধ তথা সিন্ধু।’ জহরলাল নেহেরু তাঁর ‘ভারত সন্ধানে’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘প্রাচীন সাহিত্যে ‘হিন্দু’ শব্দটি একেবারেই অনুপস্থিত।’ ভারতীয় পুস্তকের মধ্যে অষ্টম শতাব্দীর একখানি তান্ত্রিক গ্রন্থে এই শব্দের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় বলে তিনি শুনেছেন। সেখানে হিন্দু শব্দটি জাতির নাম, ধর্মবাচক শব্দ হিসেবে বিবেচিত হয়নি।


বলা যায়, ‘হিন্দু’ শব্দটি তুলনামূলকভাবে আধুনিক। প্রাথমিকভাবে শব্দটি দিয়ে কোনো বিশেষ ধর্মের লোক বোঝাত না। কিন্তু ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে ‘হিন্দু’, ‘হিন্দুধর্ম’ ও ‘হিন্দুসভ্যতা’ সমার্থক হয়ে উঠেছে।


এদিকে হুজুক মানে সাময়িক আন্দোলনের উৎসাহ, আবেগবশ্যতা (নিজের বিরুদ্ধে হুজুক করা চলে না- প্রমথ চৌধুরী), কোলাহল, গুজব (লড়াইয়ের হুজুগে পল্টন গঠিত হইয়াছিল- মাহবুব-উল-আলম), জনরব, জল্পনা, রটনা, ঝোঁক (পরোয়া করি না, বাঁচি না বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে- কাজী নজরুল ইসলাম)।


এক সময় ‘হুজ্জুক’ শব্দটি চালু থাকলেও এখন হুজুগ শব্দটি চলছে। হুজুক শব্দের মূলে রয়েছে তুর্কি ‘তজুক’। আর ‘তজুক’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘হুজুম’ থেকে। তুর্কি তজুক মানে জাঁকজমক আর আরবি হুজুম মানে ভিড় বা কোলাহল।


বাংলা একাডেমির অভিধান মতে, বাংলা হুজুক বা হুজুগ শব্দের মূল বিদেশি। আরবি হজো আর ফারসি গূঈ মিলে বাংলায় হুজুক বা হুজুগ হয়েছে।এই ব্যাখ্যা মানা বেশ কঠিন।


লেখাটি লেখকের ব্লগ থেকে নেয়া


বিবার্তা/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com