শিরোনাম
হানিমুনে হাবভাব
প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০১৭, ১০:০৩
হানিমুনে হাবভাব
জিয়াউদ্দিন সাইমুম
প্রিন্ট অ-অ+

দুঃখ আর কাকে বলে? জার্মানরাই হানিমুনের উদ্ভাবক। অথচ তাদের ভাষায় হানিমুনের সমার্থক শব্দ নেই। হানিমুন (honeymoon) বোঝাতে তারা ইংলিশ বা অন্য কোনো ভাষার ঘাড়ে চাপে। প্রাচীনকালের জার্মানির সামাজিক রীতি অনুযায়ী বিয়ের পর এক মাস নব দম্পত্তিকে ভিন্ন এক জায়গায় রাখা হতো এবং নবদম্পতিকে ঘটা করে খাওয়ানো হতো গ্যাঁজানো মধুর শরবত। এ রীতি পরে ইউরোপের অন্যান্য জাতির মাঝে ছড়ায়।


এখন হানিমুনে মধুও নেই, মাসও নেই। বিয়ের পরে অথবা পরে কোনো অনুকূল সময়ে হানিমুন পর্ব সারা যায় এবং তা এক মাস হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। কয়েক দিনের হলেই চলে। কারণ হানিমুন এখন দম্পতির আর্থিক সংগতির ওপর নির্ভরশীল।


বাংলায় হানিমুন শব্দের সমার্থক শব্দ হলো মধুচন্দ্রিমা। শব্দটি চমৎকার। কিন্তু তাতে মাস ব্যাপারটি মোটেও নেই। মধু তো নেই-ই। এদিক থেকে বলা যায় বাঙালিরাই হানিমুনের আধুনিক সেন্টিমেন্টের উদ্ভাবক।


বাংলায় হানিমুন বা মধুচন্দ্রিমা বলতে বিয়ের পর বরবধূ যে প্রমোদবিহারে যায়, তাকেই বোঝায়। তবে হানিমুনের বাংলা কবে মধুচন্দ্রিমা হলো, তা এখনও নির্ধারিত হয়নি (আর সুস্থ-হৃদয় নায়িকা কি রকম ড্যাং ড্যাং করে ক্যাডিলিয়াক গাড়ী চড়ে হনিমুন করতে মন্টিকার্লো রওয়ানা হন- মৃত্যু, সৈয়দ মুজতবা আলী)। হনিমুন বানানভেদ (অতদিনে বেরুতে পারলে হনিমুনের খোয়াব থেকে- বুদ্ধদেব বসু)।


এটা ঠিক, বাংলায় হানিমুনের প্রতিশব্দ ‘মধুচন্দ্রিমা’ শব্দটি নিয়েও আপত্তি তোলা হয়েছিল। ইংরেজি honeymoon শব্দটির শাব্দিক অনুবাদের ফসল হচ্ছে মধুচন্দ্রিমা। এই ক্ষেত্রে মধুচন্দ্র অধিকতর যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু ‘মধুচন্দ্রিমা’ গ্রহীত হয়ে যাওয়ায় এখন আর আপত্তি তুলে লাভ নেই। অথচ ইংরেজি honeymoon শব্দটিতে ‘মধু’ যেমন নেই, তেমনি ‘চাঁদ’ও নেই। The Shorter Oxford Dictionary অনুযায়ীhoneymoon এর অর্থ ছিল ‘the first month after marriage’. কিন্তু হানিমুনের হালের অর্থ হচ্ছে holiday spent together by a newly married couple, before settling down to a home.


এদিকে মানুষের মনের ভাব প্রকাশের সূত্রটি সব সময় ব্যাকরণ নির্ভর হয় না। হওয়া উচিতও নয়। ব্যাকরণ ভাঙা শব্দের মাঝে এক ধরনের রহস্য থাকে। এ রহস্যটা ভাষা-সাগরের ব্যাপ্তি বাড়ায়, কখনও ভাষাকে রহস্যের চাদরে ঢেকে দেয়।


বাংলা জোড়া শব্দগুলোকে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাকরণনির্ভর হতে দেখা যায় না, বরং তা ভাবনির্ভর হয়ে উঠে। হাটবাজার, হাঁটাচলা হচ্ছে জোড়া লাগা শব্দ হলেও এদের আলাদা আলাদা অর্থ আছে। কিন্তু ভাব প্রকাশে সমস্যা হয় না। শুধু তাই নয়, জোড়া লাগা শব্দের একটি অর্থযুক্ত আর বাকিটি অর্থহীন হলেও তা ভাব প্রকাশ করতে পারে। ‘কাজটাজ’ আর ‘হাতটাত’ শব্দ দুটির প্রথমাংশের অর্থ থাকলেও শেষাংশের কোনো অর্থ নেই।


তেমনি বাংলা ভাষায় একটি রহস্যময় জোড়া শব্দ হলো ‘হাবভাব’। এখানে দুটি শব্দেরই আলাদা আলাদা অর্থ আছে। হাব শব্দের অর্থ হলো নারীর মনোহর, লাস্য বা বিলাসভঙ্গি আর ভাব শব্দের অর্থ অভিপ্রায়, অবস্থা, চিন্তা, ধরন, প্রণয় ইত্যাদি। শব্দ দুটি জোড়া লেগে যাবার পর তার অর্থ দাঁড়ায় ছলাকলা, আকার-ইঙ্গিত, চালচলন ইত্যাদি (হাবভাব করে এসে বলে আমি এই কারণে সুন্দর- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।


অবশ্য এককালে হাবভাব শব্দটি ছিল নিরেট কামগন্ধী এবং তা কেবল নারীদের বেলায় ব্যবহৃত হতো। শব্দটি শুনলেই তখন পুরুষদের রোমাঞ্চ জাগতো। কিন্তু সময়ের পথ পরিক্রমায় হাবভাব আজ লিঙ্গনিরপেক্ষ শব্দে পরিণত হয়েছে। নারীপুরুষ ছাড়াও তা এখন প্রাণীদের বেলায়ও প্রযোজ্য। এখন আর হাবভাব দিয়ে ছলাকলা বোঝায় না, বোঝায়- চালচলন, রকমসকম (ভয়ে লাফ ঝাঁপ বলে ‘বাপ বাপ’ সবে হাবভাব দেখে- তেজিয়ান, সুকুমার রায়)।


লেখাটি লেখকের ব্লগ থেকে নেয়া


বিবার্তা/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com