শিরোনাম
গৃহিণী : কথাটা সম্মানের না অপমানের?
প্রকাশ : ১৪ নভেম্বর ২০১৭, ১৬:৩৪
গৃহিণী : কথাটা সম্মানের না অপমানের?
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

জার্মানিতে ‘হাউসওয়াইফ' বা ‘হাউসফ্রাউ' চিরকালই একটি ‘ফুলটাইম জব', যদিও পারিশ্রমিক ছাড়াই। আজও জার্মানিতে ফুলটাইম গৃহিণীর কোনো অভাব নেই, তবে সেটা অর্থনৈতিক চাপে, সামাজিক চাপে নয়।


আমার জার্মান বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে প্রথমেই যে দু'জন ‘হাউসফ্রাউ' বা গৃহিণীর নাম করতে হয়, তাঁদের একজন ছিলেন স্থাপত্যবিদ্যায় ডক্টরেট, অন্যজন নিজেই ডাক্তার। এই দু'জনের মধ্যে প্রথমজনের স্বামী ছিলেন আইনের অধ্যাপক, দ্বিতীয়জনের স্বামী বনবিভাগের কর্মকর্তা। দু'টিই স্বচ্ছল পরিবার। প্রথম মহিলার চার সন্তান, দ্বিতীয়জনের তিন। দুই মহিলাই স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে বাড়িতে থেকে ‘ছেলে মানুষ করার' সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এটা ছিল তাঁদের ও তাঁদের স্বামীদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। সমাজের চাপ এখানে কোনো ভূমিকা পালন করেনি।


ইউরোপের ইতিহাস ঘাঁটলেই বোঝা যায় যে, সব দেশের সমাজই বস্তুত আধুনিকতার দিকে এগোচ্ছে; একমাত্র প্রশ্ন হলো, কোন হারে ও কোন পথে? ধরতে গেলে, সব দেশের সমাজ যেন রেলের গাড়ি; দুনিয়াজুড়ে এই রেলগুলো চলেছে মেন লাইন, কর্ড লাইন, লুপ লাইন, নানা লাইন ধরে, নানা গতিতে, নানা ইস্টিশানে থেমে কিংবা না থেমে। কিন্তু শেষমেষ সব সমাজই যেখানে গিয়ে পৌঁছাবে, সেই টার্মিনাসটির নাম হবে নারীমুক্তি, নারী-পুরুষের সমতা। জার্মানির মতো শিল্পোন্নত দেশও এখনও পর্যন্ত সেই টার্মিনাসে পৌঁছায়নি। তাই ‘হাউসফ্রাউ' কথাটাও তামাদি হয়ে যায়নি।


সমাজ ও প্রযুক্তিতে পরিবর্তন আনে যুদ্ধ। বলা যায়, যত বড় সংঘাত, তত বড় পরিবর্তন। দুই বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কায় ইউরোপে নারীমুক্তি আন্দোলন যেখানে পৌঁছেছে, যুদ্ধ ছাড়া তা সম্ভব হতো কি? জার্মানিতেই তো মহিলাদের সম্পর্কে বলা হতো, তারা ‘কিন্ডার, ক্যুশে, কির্শে' নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন, অর্থাৎ ‘'ছেলেপিলে, রান্নাঘর আর গির্জা'' হবে তাঁদের জীবনের পরিধি।


কিন্তু যুদ্ধ এসে পড়লে দেখা গেল, অস্ত্রউৎপাদন তো বটেই, অন্যান্য শিল্পেও শ্রমিক কম পড়ছে। কেননা পুরুষরা সকলে যুদ্ধে গেছেন। কাজেই মহিলাদের কারখানায় কাজ করা শুরু হলো। যুদ্ধের পর পশ্চিম জার্মানিতে ওই মহিলারাই আবার নামলেন পুনর্নির্মাণের কাজে। যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরে ফুটপাথ থেকে ভাঙা ইট-কাঠ-পাথর সরিয়ে নতুন করে দেশ গড়ার কাজ শুরু করলেন।


ওদিকে পুবে তখন কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানি। কমিউনিজমে নারী-পুরুষ সকলেই কমরেড, সকলেই কর্মী – অন্তত তত্ত্বগতভাবে। কাজেই ট্র্যাক্টর কে চালাচ্ছেন বা রেলের গার্ড কে হচ্ছেন, তিনি পুরুষ না মহিলা, এ হিসেব-নিকেশটা পূর্ব জার্মানিতে কম ছিল। মহিলাদের বিভিন্ন ‘পুরুষালি' পেশায় কাজ করাতে গেলে, তাঁদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য ক্রেশ থেকে শুরু করে কিন্ডারগার্টেন, সারাদিনের স্কুল, স্কুলে দুপুরের খাওয়া ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হবে। করাও হয়। যে কারণে আজও জার্মানির পূর্বাঞ্চলে, অর্থাৎ সাবেক পূর্ব জার্মানির রাজ্যগুলোতে কিন্ডারগার্টেনে সিটের কোনো অভাব নেই। যে পূর্ব জার্মানিতে জন্মের হার কমছে, তার উপর আবার লোক পালাচ্ছে পশ্চিমে, সেখানে মহিলাদের ‘হাউসফ্রাউ' করে বসিয়ে রাখাটা একটা বিলাস। পূর্ব জার্মানি সে পথ মাড়ায়নি।


পশ্চিমে যতদিন সমৃদ্ধি শুধু বাড়তে থেকেছে, যতদিন একজনের উপার্জনে ভালোমতো সংসার চলে গেছে, ততদিন মহিলারা বাড়িতে থেকে শুধুমাত্র গৃহিণীর ভূমিকা পালন করতে পেরেছেন। আজ দেখা যাচ্ছে, একার রোজগারে ভালোভাবে সংসার চালানোর ক্ষমতা খুব কম মানুষেরই আছে। কাজেই স্বামী-স্ত্রী দু'জনকেই কাজ করতে হবে, রোজগার করতে হবে। আর তাই পশ্চিমেও এখন আরো বেশি ক্রেশ ও কিন্ডারগার্টেন গড়ার ধুম উঠেছে; কথা চলছে, অধিকাংশ স্কুল সারাদিন খুলে রেখে, ছাত্রছাত্রীদের দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা করে মায়েদের – পক্ষান্তরে বাবাদের খানিকটা স্বস্তি দিলে কেমন হয়? যে দেশে দীর্ঘমেয়াদি সূত্রে মোট জনসংখ্যা কমতে চলেছে; যে দেশে মানুষজনকে ৭০ বছর বয়স অবধি কাজ করানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে, সে দেশে গৃহিণীর ধারণাটাই উঠে যাওয়ার কথা, নয় কি?


না, উঠে যাবে না। কেননা গৃহ থাকবে, গৃহকর্মও থাকবে। কিন্তু আজকের দুনিয়ায় সংসার চালানো বা সন্তান প্রতিপালন স্বামী-স্ত্রীর জয়েন্ট স্টক কোম্পানির কাজ। এ দেশে (জারমানি) পুরুষরাও আজকাল ‘পেটার্নিটি লিভ' নিয়ে থাকেন। জার্মান রাজনীতির অতি পরিমাণে রক্ষণশীল কিছু আনাচে-কানাচে আজও ‘শুধুমাত্র গৃহিণীর' সেই অতীত সুখস্বপ্ন উঁকিঝুঁকি মারলেও, জার্মান জনগণ আজ জানেন ও মেনে নিয়েছেন যে, নারী-পুরুষের সমান শিক্ষা, পেশা অবলম্বনের অধিকার, ক্যারিয়ার করার অধিকার – এটাই স্বাভাবিক।


তার মধ্যে যদি বাভেরিয়ার খ্রিষ্টীয় সামাজিক দলের ভাবুকরা ‘ম্যুটাররেন্টে' বা ‘মায়ের অবসরভাতা' নিয়ে লড়ে যান, তবে সেটা অতীতের সেই সব মায়ের অর্জনকে স্বীকৃতি জানানো ছাড়া আর কিছু নয়। কেননা, গৃহিণী ও গৃহস্থের মধ্যে ফারাকটা যে কখন উধাও হয়ে গেছে, সেটা কেউ খেয়াল করেননি।


অরুণ শঙ্কর চৌধুরীর ব্লগ থেকে


বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com