শিরোনাম
স্তন আর স্তম্ভিত
প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০১৭, ০৯:০৫
স্তন আর স্তম্ভিত
জিয়াউদ্দিন সাইমুম
প্রিন্ট অ-অ+

স্তন শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ‘যে শব্দ করে’। অর্থাৎ জানিয়ে দেয় যে, যৌবন আসছে দেহে। তবে বাংলায় ‘স্তন’ শব্দের যে কাব্যিক ব্যঞ্জনা রয়েছে, ইংরেজি breast-এ মোটেও নেই। কারণ বুৎপত্তিগতভাবে breast শব্দটি bag বা bell-র আত্মীয়। অবশ্য স্তনের কাব্যিক রূপ ইংরেজিতেও পাওয়া যায়। যেমন bouncers, tremblers, knockers, hemisphere ইত্যাদি।


জানা যায়, কবিতার স্তন শব্দটি ব্যবহার করে জীবনানন্দ দাশ নাকি বেশ বিব্রত পরিস্থিতির মুখে পড়েছিলেন। অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতার নাম ‘স্তন’ হলেও তাকে কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়নি। কারণ কবিতায় তিনি শব্দের মারপ্যাচে বিষয়টাকে শালীন ও অসাধারণ কাব্যিক বানিয়ে ফেলেছিলেন:


‘মরমের কোমলতা তরঙ্গ তরল


উথলি উঠিছে যেন হৃদয়ের তীরে।’


এক সময় বাংলা কবিতায় ‘স্তন’ শব্দটির ব্যবহার সোশাল টাবু হয়ে গিয়েছিল। অথচ মধ্যযুগে বিষয়টা এমন টাবু ছিল না। রাধা যখন যৌবনে পা রাখছিলেন, সেই সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি তা কতই না দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তবে আধুনিক কবিরা স্তন শব্দটিকে তাদের কবিতায় রাখঢাক ছাড়াই এখন ব্যবহার করছেন (এখনো মেটেনি আশা, এখনো তোমার স্তন-অমৃত-পিপাসা, মুখেতে রয়েছে লাগি; রাখিতে পারে না যেন স্নেহপূর্ণস্ফীত স্তনভারে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; হেমন্তের রৌদ্রের মতোন ফসলের স্তন- ধূসর পাণ্ডুলিপি; সে কতো শতাব্দী আগে তাহাদের করুণ-শঙ্খের মতো স্তন- রূপসী বাংলা, জীবনানন্দ দাশ; ওই হার লুটাইছে সুন্দরীর স্তনের উপর, এই যদি মুক্তাচার, আমরা তো শ্রমের কিন্নর- শ্যামাপদ চক্রবর্তী)।


অমরকোষের টীকায় স্তন অর্থে বলা হয়েছে, ‘যা তারুণ্যোদ্যয় বলে’।


Esther Lewin এবং Albert Lewin প্রণীত The Theasurus শব্দকোষে breast এর স্ল্যাং হিসেবে রয়েছে bags, melons, apples, lemons, oranges. অন্যদিকে অভ্র বসু তাঁর বাংলা স্ল্যাং অভিধানে আকার ও প্রকৃতিভেদে স্তনের স্ল্যাং হিসেবে আতা, আনারকলি, আপেল, আমসি, উঁইঢিবি, গয়না, চুঁচি, নিমকি, নিমাই, পিরামিড, ফজলি আম, ফল, বাতাবি, বুটকি, বেগুন, বেগুনপোড়া, মাই, মেশিন, ম্যানা, লুচি, সিঙ্গারা, হেডলাইট শব্দগুলো উল্লেখ করেছেন।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আকর্ষণীয় উপমায় স্তনযুগল অর্থে ‘যুগল স্বর্গ‘ লিখেছেন (বক্ষের নিচোলবাস যায় গড়াগড়ি, ত্যজিয়া যুগল স্বর্গ কঠিন পাষাণে)। আর বিদ্যাপতি স্তন অর্থে ‘যৌবন’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন (বাঢ়িলে যৌবন তোহে দিব দান)।


এদিকে সংস্কৃতে স্তম্ভিত মানে বিস্মিত। কিন্তু মূল অর্থ ‘স্তম্ভপ্রাপ্ত’। বাংলায় স্তম্ভিত মানে হতবাক, হতভম্ভ, মুগ্ধ, আবিষ্ট ইত্যাদি। আর স্তম্ভ মানে ঘরের থাম। ঘরের থাম যেমন নড়ন চড়নহীন থাকে, তেমনি আমরা স্তম্ভিত হলে বিস্ময়ে বা আবেগে স্তম্ভিত বা স্তম্ভের মতো হয়ে যাই।


আসলে মানুষ স্তম্ভিত হলে স্তম্ভ হয় না, হয় স্তম্ভবৎ। এ কারণে বাংলায় স্তম্ভিত শব্দের প্রয়োগ উপমাঘটিত হয়ে থাকে (দাক্ষিণ্যভরে চিত্ত তার নত, স্তম্ভিত মেঘের মত তৃষ্ণাহরা, আষাড়ের আত্মদান প্রত্যাশায় ভরা- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; সে স্তম্ভিত মুখে দুই চক্ষু ডাগর করিয়া প্রথমে সুরেশের, পরে তাহার পিতার প্রতি চাহিয়া থাকিয়া অকস্মাৎ মুখ ফিরাইয়া দ্রুতবেগে উঠিয়া চলিয়া গেল- গৃহদাহ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; শিলাপ্রতিঘাত প্রতিপ্রেরিত নির্ঝরিণীবৎ রাজসেনা বিলোড়িত, স্তম্ভিত, ভীত হইল, সেই সময়ে পঞ্চবিংশতি সহস্র সন্তানসেনা লইয়া সত্যানন্দ ব্রহ্মচারী শিখর হইতে, সমুদ্রপ্রপাতবৎ তাহাদের উপর বিক্ষিপ্ত হইলেন- আনন্দমঠ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)।


লেখাটি লেখকের ব্লগ থেকে নেয়া


বিবার্তা/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com