শিরোনাম
সেনানী সেবা সেলফি সেলামি
প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০১৭, ০৮:৫৮
সেনানী সেবা সেলফি সেলামি
জিয়াউদ্দিন সাইমুম
প্রিন্ট অ-অ+

সংস্কৃতে সেনানী মানে সেনাপতি। কিন্তু বাংলায় সেনানী মানে সৈন্য দল (দেখিতে দেখিতে পুরিয়া উঠিল সেনানী আশি সহস্র, নানা দিকে দিকে নানা পথে পথে মারাঠার যত গিরিদরি হতে বীরগণ যেন শ্রাবণের স্রোতে ছুটিয়া আসে অজস্র- বিচারক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; মারিতে মারিতে কে হ’ল যোগ্য, কে করিবে রণ-জয়! এ ‘মক্ ফাইটে’ কোন্ সেনানীর বুদ্ধি হয়নি লয়!- হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ, কাজী নজরুল ইসলাম; এইরূপ কথা হইতে হইতেই কথা উঠিল, ‘অগ্নিবৈ দেবানাং সেনানী’ অর্থাৎ অগ্নি দেবতাদিগের সেনানী। সেনানী কিনা সেনাপতি- দেবতত্ত্ব ও হিন্দুধর্ম্ম, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)।


অন্যদিকে সংস্কৃতে সেবা শব্দটি নানা অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন শুশ্রুষা (যে মানুষ ছেলে-বয়স থেকে অন্ধের সেবা করেছে তা সেবা হয় নিখুঁত- শব্নম্, সৈয়দ মুজতবা আলী; সমস্ত দিন বিবিধ উপচারে তাঁতার সেবা করিল- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর), পরিচর্যা (পতিসেবা কর সতী), উপাসনা (ঠাকুরসেবায় তিনি অন্তপ্রাণ), উপভোগ (ইন্দ্রিয়সেবা ছাড়া তিনি অন্য কিছু বুঝতেই চান না), কল্যাণ (নেতাদের মাঝে এখন জনসেবার চেতনা নেই)। কিন্তু বাংলায় সেবা মানে ভোজন (বড় কর্তা সেবায় বসেছেন)।


নগেন্দ্রনাথ বসু তাঁর বিশ্বকোষে (দ্বাবিংশ খণ্ড) সেবা সম্পর্কে বলেছেন, মনু সেবাকে শ্ববৃত্তি অর্থাৎ কুকুরের বৃত্তি বলে নির্দেশ করেছেন। তিনি মনুর উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, ‘বাণিজ্যের নাম সত্যানৃত। বাণিজ্য করিতে হইলে সত্য ও মিথ্যা এই দুইই আবশ্যক হয়। এই জন্য ইহার নাম সত্যানৃত, ব্রাহ্মণগণ বাণিজ্যের দ্বারাও জীবিকা অর্জন করিবে, কিন্তু কদাচ সেবা দ্বারা জীবিকা অর্জন করিবে না, কারণ কারণ সেবা শ্ববৃত্তি বলিয়া অভিহিত হইয়াছে। অর্থাৎ মনুতে চাকরিকেই সেবা বলা হয়েছে।’


এদিকে ইংরেজি থেকে আসা সেলফির বিকল্প বানান সেল্ফি। এটার মান্য পরিভাষা নেই। তবে বাংলা উইকিপিডিয়ায় সেলফি অর্থে ‘নিজস্বী’ শব্দটির উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। সেলফি হলো আত্মপ্রতিকৃতি আলোকচিত্র বা দল আলোকচিত্র, যা সাধারণত হাতে-ধরা ডিজিটাল ক্যামেরা বা ক্যামেরা ফোন ব্যবহার করে নেয়া হয়। ফেসবুক, গুগলপ্লাস, ইন্সটাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, টাম্বলার ও টুইটার ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সেলফি অহরহ শেয়ার করা হয়।


সেলফি শব্দটি প্রথম এসেছে ইংরেজি সেলফিশ থেকে। অক্সফোর্ড অভিধানের মতে, সেলফি হলো একটি ছবি (আলোকচিত্র) যা নিজের তোলা নিজের প্রতিকৃতি, যা সাধারণত স্মার্টফোন বা ওয়েবক্যামে ধারণকৃত এবং যে কোনো সামাজিক মাধ্যমে আপলোড (তুলে দেয়া) করা হয়। বেশিরভাগ সেলফি হাত সামনে তুলে বা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, কখনো-কখনো সেল্ফ টাইমার ব্যবহার করেও নেয়া হয়।


রবার্ট কর্নিলিয়াস নামের একজন মার্কিন আলোকচিত্রী ১৮৩৯ সালে নিজের একটি আত্মপ্রতিকৃতি ক্যামেরায় ধারণ করেন, যা ছিল প্রথম কোনো একজন ব্যক্তির আলোকচিত্র।


সেলফি শব্দটির প্রাথমিক ব্যবহার ২০০২ এর আগে পাওয়া গেলেও ২০০২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়ান এক অনলাইন ফোরামে (এবিসি অনলাইন) প্রথম ব্যবহৃত হয়। ২০১৩ সালে অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারির অনলাইন ভার্সনে ‘সেলফি’ শব্দটি নতুন সংযোজিত হয়।


অতিরিক্ত সেলফি তোলার প্রবণতা সেলফিটিস নামে পরিচিত। এই মানসিক ব্যাধিটির তিনটি স্তর হতে পারে। প্রথম স্তরটি ‘বর্ডার লাইন সেলফিটিস’। দ্বিতীয় স্তরটি হচ্ছে ‘অ্যাকিউট সেলফিটিস’। শেষ স্তরটি হচ্ছে ‘ক্রনিক সেলফিটিস।


আর আরবি ‘সালাম’ শব্দের সঙ্গে বাংলা ‘ই’ প্রত্যয় আগে সেলামি বা সেলামী বা সালামি হয়েছে। আরবি সালাম শব্দের আভিধানিক অর্থ শান্তি অভিবাদন। কিন্তু বাংলা সেলামির সঙ্গে শান্তি বা অভিবাদনের চেতনা আর বাকি নেই। কারণ বাংলায় সেলামি শব্দটি আরবি সালাম শব্দের চরিত্র বিন্দুমাত্র বজায় রাখতে পারেনি। বর্তমানে কোন দোকানের পজেশন বাবত প্রদেয় অর্থই সেলামি। আবার নজরানা বা উপঢৌকন মানেও সেলামি বা সেলামী (না, দেবোত্তর এ গাঁয়ে একফোঁটা নেই, সেলামী না পেলে সমস্ত বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে- দেনা পাওনা, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; ময়ূরও নাচে না তাকে দু-নম্বরী সেলামী না দিলে, হাতুড়ির ঘায়ে না ফাটালে রাজার ভাঁড়ার থেকে এক মুঠু খুদ খেতে পায় না চড়াই- হে স্তন্যদায়িনী, পূর্ণেন্দু পত্রী; এই সৃষ্টিতে হিন্দুস্থানী কায়দা আপন পুরো সেলামি পাবে না, যেমন পায়নি বাংলার কীর্তন- গানে কথা ও সুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; মনে মনে বললে, আমার তালুকের এই সেলামির টাকা রইল সুবোধের জন্যে, তার পর দেখা যাবে- যোগাযোগ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; আসল কথা, জমীদারকে ‘আগমনী’, ‘নজর’, বা ‘সেলামী’ দিতে হইবে- সাম্য, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)।


পল্লীকবি জসীম উদ্দীন উৎকোচ অর্থে সেলামী শব্দটি ব্যবহার করেছেন (সেলামী আর নজরানা, কিস্তি খেলাপ সুদের বোঝায় ভুড়ীর উপর বাড়ছে ভুড়ী, দিনে যতই দিন চলে যায়)। মধ্যযুগে প্রজারা ভূমি রাজস্বের অতিরিক্ত যে কর জমিদারকে দিতো বা দিতে বাধ্য হতো তা-ই সেলামি। এটা এক ধরনের আবওয়াব বা কর।


লেখাটি লেখকের ব্লগ থেকে নেয়া


বিবার্তা/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com