
মূলানুগ অর্থে সুকেশী অর্থ ‘যে নারীর উত্তম চুল রয়েছে অর্থাৎ অনেক বেশি চুল রয়েছে’। বিশেষ্যে সুকেশী মানে অপ্সরা বিশেষ। বিশেষণে সুকেশী অর্থ রমণীয় চুল বিশিষ্ট নারী।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর মেঘনাদবধ কাব্যে বেশি চুল অর্থে সুকেশী না লিখে ‘সুকেশিনী’ শব্দটি লিখেছেন (সুকেশিনী মিশ্রকেশী আসি নামিলা, অনম্বর পথে সুকেশিনী কেশব বাসনা দেবী)। তিনি ‘মঞ্জুকেশিনী’ শব্দটিকেও একই অর্থে ব্যবহার করেছেন (তুমি হে মঞ্জুকেশিনী শচী- মেঘনাদবধ কাব্য)।
অনেকেই সুকেশিনী শব্দটিকে অশুদ্ধ প্রয়োগ বলেন। কিন্তু শব্দটি দিব্যি চলছে এবং তা গৃহীত হয়েছে বাংলা ভাষায়। সুকেশী শব্দের গঠন হচ্ছে সংস্কৃত সু + কেশী।
সংস্কৃত সু + তরাম্= সুতরাং। সংস্কৃতে সুতরাং মানে অত্যন্ত, অবশ্য। কিন্তু বাংলায় সুতরাং মানে অতএব, কাজেই, অগত্যা (শাস্ত্র অর্থাৎ বেদ তাহার কারণ ব্রহ্ম সুতরাং জগৎকারণ ব্রহ্ম হয়েন- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; সুতরাং সকলে সজলনেত্রে এই লোমহর্ষক ব্যাপার প্রত্যক্ষ করিল- শেখ ফজলুল করিম; সুতরাং বড়ই ব্যাজার হয়ে উঠলেন- হুতোম প্যাঁচার নক্শা, কালীপ্রসন্ন সিংহ; সে সোমত্থ হয়ে উঠেছে, সুতরাং তার মামুরা যে তাকে আর ঘুবডো রাখবে তা তো মনে করতে পারিনে- কাজী নজরুল ইসলাম; সুতরাং বাস্তবতা চিত্রকলায় অর্জনীয় এবং কাব্যকলায় বর্জনীয়- প্রমথ চৌধুরী)।
বাংলায় ঢোকার পর সংস্কৃত সুতরাং শব্দের ব্যবহার অব্যয় পদের মাঝেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। তবে বাংলা সুতরাং সংস্কৃত সুতরাংয়ের গতি স্তব্ধ করে দেয় অথবা মোড় ঘুরিয়ে দেয়। মূলানুগ অর্থে সংস্কৃত সুতরাং শব্দের অর্থ ‘অত্যন্ত ভালো’। কিন্তু বাংলায় আমরা ‘অতএব’ অর্থে সুতরাং শব্দটিকে চালু করেছি। একইভাবে সংস্কৃত ‘এবং’ শব্দটিকে বাংলায় অব্যয় পদ (সমুচ্চয়ী) হিসেবে ব্যবহার করি। এটার অর্থ ‘ও’, ‘আরও’, ‘এছাড়া’। কিন্তু সংস্কৃতে ‘এবং’ মানে এইরূপে বা এইভাবে।
এদিকে সুদ্ধ অব্যয় পদ। এটার অর্থ সহ, সমেত। সংস্কৃত অব্যয় ‘সার্ধম্’ থেকে বাংলায় সুদ্ধ শব্দটি এসেছে। সংস্কৃত সার্ধম্ মানে সহ। অমরকোষে রয়েছে ‘সার্ধন্তষ্টু সাকং সত্রা সমং সহ (অব্যয়বর্গ)।’
বঙ্গীয় শব্দকোষে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘সহ বা সমেত অর্থে সুদ্ধ সাধু’। বোঝা যাচ্ছে ব্যুৎপত্তি অনুসারে সুদ্ধই সঠিক। কিন্তু দেশশুদ্ধ, সর্বশুদ্ধ শব্দের প্রয়োগ বাংলায় চোখে পড়ে। সঠিক অর্থে শুদ্ধ শব্দের প্রয়োগ আছে। কিন্তু সুদ্ধ শব্দটির প্রয়োগ নেই।
আবার সহ বা সমেত অর্থে সুদ্ধ ও শুদ্ধ শব্দের প্রয়োগ চোখে পড়ে (মানিকতলায় বাড়িশুদ্ধ জমি পাওয়া যেতে পারে- গল্প সংগ্রহ, প্রমথ চৌধুরী; ওদের শুদ্ধ আনতে আমরা সবাই- আর কোনখানে, লীলা মজুমদার; সবশুদ্ধ চল্লিশ শ্লোক- রামকথার প্রাক-ইতিহাস, সুকুমার সেন; ছেলেরা দলশুদ্ধ হেসে উঠল- কল্লোল যুগ, অরুণ কুমার সরকার; সে এখন বেঁচে আছে কিনা তা সুদ্ধ জানি না- সুধীন্দ্রনাথ দত্ত)।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, বাংলা একাডেমির অভিধানে দেখানো হয়েছে সংস্কৃত ‘শুদ্ধ’ শব্দ থেকে বাংলায় সুদ্ধ শব্দটি এসেছে। কারণটা বুঝতে পারিনি।
লেখাটি লেখকের ব্লগ থেকে নেয়া
বিবার্তা/জিয়া
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]