বাংলায় সাহস মানে নির্ভরতা, বিপজ্জনক কর্মে উদ্যম (নতুন বউ-এর দিকে তাকাতে সাহস পেলেন না ছমিরন বিবি- হাজার বছর ধরে, জহির রায়হান; খোদ সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে, ইসলামের মত কট্টর ধর্মাবলম্বীদের দেশে তিনি তাঁর বিদ্রোহ জাহির করিলেন কোন সাহসে- সৈয়দ মুজতবা আলী; নব নব উদ্যমে সিদ্ধি সে নব নব, সাহস সে কিরীট তোমার- সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত; একদিন অনেক প্রতিজ্ঞা করিয়া অনেক সাহসে মামাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল- ছুটি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; এখন ‘বাঁকুড়ার চুলবুলে’ ছটুড়ি এখন আমার মনের সামনে জোর গেঁছে বসেছেন- কাজী নজরুল ইসলাম; সাহস ভরে অধর পরে দিলাম চুপে দিল- মোহর, মোহিতলাল মজুমদার)।
কিন্তু সংস্কৃতে সাহস মানে বলপূর্বক কৃত দুষ্কর্ম।আসলে সাহস শব্দের মূল অর্থ ছিল হঠকারিতা। কিন্তু বর্তমানে এটার প্রচলিত অর্থ হচ্ছে ভয়ের অভাব। এটা শব্দার্থের উৎকর্ষ। সময়ের ব্যবধানে শব্দার্থের শুধু অবনতিই ঘটে না, উন্নতিও হয়। এক সময় সাহস শব্দটি দিয়ে সাধারণের জিনিসপত্র জোর করে হরণ বা ডাকাতিও বোঝাতো। আর এক অর্থে দস্যুতাই সাহস।
যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতায় বলা হয়েছে, ‘যে সাহস করে তার হৃতদ্রব্যের মূল্য অপেক্ষা দ্বিগুণ দণ্ড, আর যে সাহস করে অপালাপ করে ‘কৈ আমিত এমন কার্য করি নাই’ তার চতুর্গুণ অর্থ দণ্ড হবে’।
এক সময় শব্দটি নেতিবাচক ছিল। ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে সাহস শব্দের মূল অর্থ ছিল ‘যা সহসা করা হয়’ অর্থাৎ হঠকারিতা। কিন্তু সাহস শব্দটি এখন বেশ ইতিবাচক (আঁধার ঘরে ঢুকতে পারি এই সাহসের গুণে, আর করে না বুক দুর্ দুর্ জুজুর নামটি শুনে- সাহস, সুকুমার রায়)। শব্দবিজ্ঞান মতে, এটাই শব্দের উন্নতি। শব্দের বাচ্যার্থ বা মূল অর্থ অপেক্ষা অনেক সময় প্রচলিত অর্থ যদি উচ্চতর ভাব বা বিষয় প্রকাশ করে, তা-ই অর্থের উন্নতি। যেমন সংস্কৃত স্থান থেকে উদ্ভূত ‘থান’ শব্দের মূল অর্থ জায়গা বা স্থান। কিন্তু থান বলতে এখন শুধু দেবস্থানকেই বোঝায়।
আবার আদর-স্নেহ করে দুষ্টু, পাজি, বদমাশ, পাগলা ইত্যাদি বলা হয়, তখনো কিন্তু এসব শব্দের অর্থের উন্নতি ঘটে।
সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘মনুসংহিতা’ গ্রন্থের শব্দকোষ অধ্যায়ে সাহস শব্দের অর্থে লিখেছেন ‘গুরুতর হিংসাত্মক অপরাধ, নারী ধর্ষণ।’
অন্যদিকে বাংলায় সাহেব শব্দটি বেশ দাপুটে। দাপট না থাকলে সাহেব শব্দটিকে হয়তো বেমানানও মনে হতে পারে। আবার শব্দটির রয়েছে নানা রূপ। রয়েছে নানা ব্যবহার (সেই দিন বেগম সাহেবের পকেট থেকে জবাল ডিনার আদায় করবো- মীর মশাররফ হোসেন; কিন্তু তাঁহার যে সকল কর্ণকারক কলিকাতায় করে দিল হে সাহেবকে তাহাদের প্রতিভূস্বরূপ আটক করিয়া রাখিলেন- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর; সাহেব লোক অনুগ্রহ করিয়া যথেষ্ট মর্যাদা করিয়া অধিকারের প্রতুল করিয়া দিয়া রাজ্যে বিদায় করিয়া দিলেন- রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়; আমি যাকে ফিট বলে দেব, সাহেব তাতেই রাজী হবে; নাজির সাহেব দহলিজে এসে যুবককে দেখে; আনসার নজির সাহেবের কবজিটা ধরে রামটেপা দিয়ে বললে; মোল্লা সাহেব ওয়াকেফ ছিলেন না যে নিকটাত্মীয়ের উকিল হওয়া বিধি- কাজী নজরুল ইসলাম; ফতোবাবু নয় সন্তুর মতো সাহেব- অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত; শেষে ঐ দলের একটা বড় হঙ্গেরিয়ান হাউন্ড পাদ্রি লং সাহেবকে কামড়ে দিলে- হুতোম প্যাঁচার নকশা, কালীপ্রসন্ন সিংহ; ছেলের দল সব চশমা পরে বসে আছে কাটখোট্টা, সাহেবরা সব গেরুয়া পরছে, বাঙালি নেক্টাই হ্যাটকোট্টা, হাসির গান- দ্বিজেন্দ্রলাল রায়; সাহেব টাকার খাতিরে মুৎসুদ্দিকে তোয়াজ করেন- প্যারিচাঁদ মিত্র; বাচ্চা সাহেবকে আমাদের সারেংদের উপর কাপ্তেন করে পাঠিয়ে দিলে- মাহবুব-উল-আলম; এই তল্লাটে এক মিয়া সাহেব একটি মুরগী পুষেছিল- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর; এই সময়ে সাহেবের এত্তেলা পেয়ে বলাই মনে মনে একটু বিরক্ত হয়- আবুজাফর শামসুদ্দীন; মওলানা সাহেব চওগার দমনে চোখ মুছিলেন- আবুল মনসুর আহমদ; লঙ সাহেবের মর্যাদাকি লুটবে জিঙ্গো পাদরী প্রভু- সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত; নন্দী সাহেবের চেলাগিরি করো না- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; সে যেন ফাঁসীর আগে পাদরী সাহেবের কলমা শুনছে- কেদারনাথ মজুমদার; আনোয়ার সাহেবের ঔদ্ধত্য আর অসহ্য- আ.ন.ম বজলুর রশীদ; সরকার সাহেবের পক্ষে বাড়ি বাড়ি ক্যানভাস করিতেও গিয়াছিল; মাওলানা সাহেব তার দু’একটা লাফজ ছাড়া আর কিছুই বুঝিলেন না; পীর সাহেরে প্রায়ই জযবা আসিত; সরকার সাহেব গলা খাসকি দিতে দিতে বলিতে লাগিলেন- আবুল মনসুর আহমদ; সাহেব চোগা চাপকান টুপীর আশ্রয় নন- মীর মশাররফ হোসেন; জীবনের বিশ বছর কাল এমনিভাবে চৌধুরী সাহেবের ছোহবতে কেটে গেছে- প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহীম খাঁ; ফ্যাশন ও স্টাইলে এরা মেম সাহেবদের টেক্কা দেয়- বেগম শামসুননাহার মাহমুদ; সাহেবের অ্যাটিচুড দেখে কিন্তু আমার তখনই মনে হয়েছিলো যে আপনাকেই সিলেক্ট করবেন- কাজী ইমদাদুল হক)।
বোঝা যাচ্ছে বাংলায় সাহেব শব্দের রয়েছে অকৃপণ ছড়াছড়ি। অমুক সাহেব, তমুক সাহেব, ভাই সাহেব, তালই সাহেব, বেয়াই সাহেব, লাট সাহেব, বড় সাহেব, ছোট সাহেব, মেজ সাহেব, মাওলানা সাহেবসহ হাজারো কিসিমের সাহেব আমাদের জিবের ডগায় নিত্য লাফায়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমরা পশ্চিমা বিশ্বের সাদা চামড়ার লোককেও আমরা সাহেব বলি, আবার অফিসের কাকের মতো কালো কর্তাকেও সাহেব বলি।
সাহেবের সঙ্গে কি মহানবীর (স.) সাহাবীদের সম্পর্ক আছে? অবশ্যই আছে। কারণ সাহেব আর সাহাবী তো একই জিনিস। বাংলা সাহেব শব্দটির মূল আরবি। আরবি ‘সাহিব’ থেকে বাংলায় সাহেব শব্দটির সৃষ্টি। আরবি সাহব মানে সহচর, সঙ্গী বা সাথী। আরবিতে এ সাহব থেকেই সাহাবি শব্দটি তৈরি। সাহেব শব্দটি অবশ্য আরব ভূমি থেকে সরাসরি বাংলায় আসার ভিসা পায়নি। বরং ইরানি পাসপোর্ট নিয়েই ইতিহাসের ডানায় চড়ে বাংলায় ঢুকেছে। আরবি সাহব ইরানের নাগরিকত্ব পাবার পর এটার অর্থ পাল্টে যায়। শব্দটির মাঝে বেশ চাঞ্চল্য আছে। স্বভাবটি বাংলায় ঢোকারও পরও যায়নি। নানা শ্রেণীর লোকের সঙ্গে সাহেব শব্দটির মাখামাখি রয়েছে। তাই বাংলায় কে আসল সাহেব আর কে নকল সাহেব, তা চেনাই ভার। তবে বাংলা সাহেবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটা আরবি সাহবের মতো মানুষের সঙ্গী বা সাথী হতে পারেনি। বরং ইরানি কায়দায় বাংলায় সাহেব প্রথমে হয়েছে প্রভু, তারপর হয়েছে সম্ভ্রান্ত মুসলমান বা মুসলমান ভদ্রলোক এবং তারও পরে হয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের সাদা চামড়ার লোকজন।
বাংলায় এখন ক্ষমতাবান যে কোনো ব্যক্তিই সাহেব এবং সাহেব বাংলা ভাষার এমন একটি শব্দ বিভিন্ন সময়ে যার অর্থের রূপান্তর ঘটার পর এখনও কোন অর্থই সে পরিত্যাগ করেনি।
অভিধানে সাহেব বলতে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, মহাশয়, কর্তা, প্রভু, ইউরোপিয়ন, ইংরেজ ইত্যাদিকে নির্দেশ করে (রবিবাবু থেকে আরম্ভ করে আজকের তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, আর কত সাহেব, চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, রায়- তালেব মাস্টার, আশরাফ সিদ্দিকী; ভূত-বাগান শব্দে লোকে ত্রাহিত্রাহি ডাক ছাড়ে, কান্না শুনে ধন্যি বলি বুথ সাহেবের বাচ্চারে- কাঁদুনে, সুকুমার রায়; কতক সাহেবকে দিতাম, কতক আপনি লইলাম, তারপর এর মুণ্ডু এর ঘাড়ে দিয়া হরবর করিতাম- আলালের ঘরের দুলাল, টেকচাঁদ ঠাকুর)।
বাংলায় ‘সায়েব’ বানানটিও চালু রয়েছে (যত বড় উন্নাসিকই হোক না কেন, পুলিশ সায়েবের বাংলোটি কিছুমাত্র ফেলনা নয়- সৈয়দ মুজতবা আলী)।
সাহেব শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে সাব (মাস্টার সাবের দয়াতেই বেটা এমন লাই পেয়েছে- আবুল মনসুর আহমদ)।
মীর মশাররফ হোসেন তাঁর ‘জমিদার দর্পণ’ গ্রন্থে ‘সাএব’ বানানটি ব্যবহার করেছেন (সাএবদের কাছে বসতে পান, কত খাতির, তাতেই আবার ন্যাজ ফুলে ওঠে)।
ইংরেজ অর্থেও বাংলায় শব্দটির ব্যবহার রয়েছে (ম্যাকলের ভাষায় এদেশবাসীকে চামড়ায় কাল কিন্তু সংস্কৃতিতে, চিন্তাচেতনায় খাঁটি সাহেব করে গড়ে তুলতে হবে- ঐতিহাসিকের নোটবুক, সিরাজুল ইসলাম)।
লেখাটি লেখকের ব্লগ থেকে নেয়া
বিবার্তা/জিয়া
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]